সমস্ত প্রশংসা মহামহিম আল্লাহ তাআলার জন্য যিনি আমাদেরকে বিশ্বনবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উম্মত হিসেবে এ ধরণীতে প্রেরণ করেছেন। অসংখ্য অগণি দুরুদ ও সালাম বর্ষিত হোক ঐ নবীর প্রতি যিনি,
সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ প্রেরিত অবতার
শান্তি-মুক্তির দূত সকল মানবতার।
জাহেলিয়াতের ঘোর আঁধারে নিমজ্জিত মানবজাতিকে হিদায়াতের পথপ্রদর্শনের জন্য আল্লাহ তাআলা যুগে যুগে অসংখ্য নবী ও রাসূল প্রেরণ করেছেন। তাদের মধ্যে সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী ও রাসূল হচ্ছেন মুহাম্মদ (সা)। শিরক, বিদয়াত, অন্যায়, অবিচার, অশ্লীলতা ও অসভ্যতার পঙ্কিলতায় অন্ধকারাচ্ছন্ন এ পৃথিবীকে নব উদ্যমে আলোকোজ্জল করতে আল্লাহ তাআলা তাঁকে এক অনন্য অনুপম আলোকবর্তিকা হিসেবে প্রেরণ করেছেন। তাঁর নবুওয়াত ও রিসালাতের প্রকাশ্য অকাট্য প্রমাণস্বরূপ তাঁকে অসংখ্য মু’জিযা প্রদান করেছেন।
মু’জিযাকে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করা যায়। তবে মূল বক্তব্য হচ্ছে, মু’জিযা এমন স্বর্গীয় বা অলৌকিক কর্ম, যা ঘটানোর ক্ষমতা ও ইচ্ছা একমাত্র আল্লাহর। উদাহরণস্বরূপ, তা এমন একটি কাজ যাকে প্রকৃতির নিয়মে ব্যাখ্যা করা যায় না বা তা এমন একটি বিষয় যা মানুষের ক্ষমতা, যোগ্যতা ও সাধ্যের উর্ধ্বে। কিংবা তা এমন একটি ঘটনা যা মানবিক কার্যকারণ ও যুক্তির মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা যায় না যা সরাসরি আল্লাহ প্রদত্ত।
আল্লামা ইদরীস কান্ধলবী রহ. তাঁর সীরাতে মুস্তফা গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ইমাম বায়হাকী রহ. বলেন, রাসূল (সা) এর মু’জিযা প্রায় ১০০০ (এক হাজার)। ইমাম নববী রহ. এর মতে মু’জিযার সংখ্যা প্রায় ১২০০। কতিপয় উলামায়ে কেরাম বলেছেন, রাসূল (সা) এর মু’জিযার সংখ্যা প্রায় ৩০০০ (তিন হাজার)। তবে বিশুদ্ধ মত হচ্ছে, রাসূল (সা) এর মু’জিযাসমূহ অসংখ্য অগণিত। যা গণনা করা সম্ভব নয়। তাঁর এ অসংখ্য মু’জিযাসমূহের মধ্য থেকে এখানে অন্যতম শ্রেষ্ঠ কয়েকটি মু’জিযা উল্লেখ করা হলো।
জীবন্ত মু’জিযা আল-কুরআন:
যখন আরবজুড়ে যুগশ্রেষ্ঠ বাগ্মী, ভাষাপন্ডিত, সাহিত্যিক ও কবিদের বিচরণ ঠিক তখনই রাসূল (সা) এর উপর অবতীর্ণ হয়েছে সকল ভাষা অলংকার ও সাহিত্যের উচ্চাঙ্গ গ্রন্থ আল-কুরআন। অথচ এ কথা সর্বজনবিদিত যে, রাসূল (সা) ছিলেন উম্মী-নিরক্ষর। তিনি কোনো ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেননি। তাছাড়া আরব উপদ্বীপের বাইরে তিনি তেমন সফরও করেননি, যেখানে তিনি ভাষার উপর পান্ডিত্য অর্জন করতে পারেন। তথাপি কুরআন মাজিদের শব্দ, ভাষা, আয়াত ও সূরা সমভাবে বিস্ময়, সুন্দর ও হৃদয়গ্রাহী। কুরআন মাজীদের পুরোটাই উচ্চাঙ্গের কথামালা, অনন্য ভাষাশৈলীতা ও হৃদয়স্পর্শী উপমায় ভরপুর। কুরআনের হৃদয়গ্রাহী তিলাওয়াত যতই করা হোক না কেন এতে তার স্বাদ ও মাধুর্যে বিন্দুমাত্র ব্যত্যয় ঘটে না। মনে হয় যেন যতই পাঠ করবে ততই অজানা এক স্বাদে মন উত্তরোত্তর উদ্বেলিত হয়েই চলবে। কুরআনের ভীতি প্রদর্শনমূলক আয়াত ও কঠোর সতর্কবাণী ভালো করে অনুধাবন করলে কঠিন মানুষ তো দূরের কথা পাহাড় পর্যন্ত ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে কাঁপতে থাকে। আবার আশ্বাসবাণী ও পুরস্কার বিবরণ দেখলে ও হৃদয়ঙ্গম করলে অন্ধ মনের বন্ধ দুয়ার উন্মুক্ত হয়ে যায়, অবরুদ্ধ শ্রবণশক্তি প্রত্যাশ্যার পদ-ধ্বনি শুনতে পায়। আর মৃত মন ইসলামের অমিত শরবত পানের জন্যে ব্যাকুল হয়ে উঠে। এমন সুন্দর রচনাশৈলী ও ভাষার স্বচ্ছন্দ গতিসম্পন্ন ৬২৩৬ আয়াতের একটি গ্রন্থ রচনা করা কোনো মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। নিঃসন্দেহে সমগ্র সৃষ্টিজগত তার সমকক্ষতার ক্ষেত্রে চূড়ান্ত অক্ষমতার স্বীকৃতি প্রদান করতে বাধ্য। তাই তো তৎকালীন প্রথিতযশা ভাষাবিদ ও কবি-সাহিত্যিকরা কুরআনকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করতে ও তা থেকে ভুল উদঘাটন করতে বহু অপচেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে। কুরআনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে নিজেদের অপারগতা ও অক্ষমতা স্বীকার করে অবশেষে এ কথা বলতে বাধ্য হয়েছে যে,“এটা মানবরচিত কোনো গ্রন্থ নয়।”
এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, সন্দেহাতীতভাবে মহাগ্রন্থ আল-কুরআন এক ঐশীগ্রন্থ। যা আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে তাঁর রাসূল বিশ্বনবী (সা) এর উপর নাযিলকৃত চির অবিনশ্বর বাণী। যা তাঁর নবুওয়াতের সুউজ্জল প্রমাণ বহন করে এবং তাঁর অসংখ্য মু’জিযারাশীর মধ্য থেকে সর্বশ্রেষ্ঠ জীবন্ত মু’জিযা। যা কিয়ামত পর্যন্ত চির অক্ষত অবস্থায় থাকবে। এ প্রসঙ্গে রাসূল (সা) বলেন, প্রত্যেক নবীকে তাঁর যুগের প্রয়োজন মুতাবিক কিছু কিছু মু’জিযা প্রদান করা হয়েছে। আর আমাকে যে মু’জিযা প্রদান করা হয়েছে তা হচ্ছে, আল্লাহ প্রদত্ত ওহী-আল-কুরআন। (বুখারী: ৪৯৮১, মুসলিম: ১৫২)
ইসরা-মিরাজ:
নবুওয়াতের দ্বাদশ বর্ষের ২৭ রজব, সোমবার রজনীতে ঘটে যায় মানব ইতিহাসের এক বিস্ময়কর ঘটনা। যা বিজ্ঞানের সর্বশেষ উন্নতির চাইতেও উন্নততর বৈজ্ঞানিক ঘটনা। মহান আল্লাহ তাঁর রাসূলকে বিশেষ জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা প্রদানের উদ্দেশ্যে এক রজনীর কিয়দংশ সময়ের মধ্যে মক্কা থেকে বায়তুল মাকদাসে অতঃপর সেখান থেকে উর্ধ্বগমন-এক এক করে সপ্তাকাশ, সিদরাতুল মুনতাহা ও বায়তুল মা’মুর ভ্রমণ করান। তাঁর সাম্রাজ্য ও কর্তৃত্বের নিদর্শনসমূহ, জাহান্নামের শাস্তির স্বরূপ ও জান্নাতের অনাবিল শান্তির শোভা প্রত্যক্ষ করান। অতঃপর বিশ্ব জাহানের একচ্ছত্র অধিপতি, অনাদি অনন্ত, চির অবিনশ্বর একক উপাস্য, অদ্বিতীয় স্রষ্টা, মহাপ্রতিপালক প্রভু আল্লাহ তাআলার সান্নিধ্যে ধন্য করিয়ে ঐ রজনীতেই আবার মক্কায় পৌঁছে দেন। যা বহু আয়াত ও বিশুদ্ধ হাদীস দ্বারা অকাট্যভাবে প্রমাণিত। (বিস্তারিত দেখুন: সূরা বনী ইসরাঈল: ০১, সূরা নাজম: ৫-১৮; সহীহ বুখারী: ১/৫০-৫১)
হাতের ইশারায় চন্দ্র দ্বিখন্ডিত:
মক্কার কাফেররা রাসূলুল্লাহ (সা) এর কাছে তাঁর রিসালাতের স্বপক্ষে কোনো নিদর্শন চাইলে মহান আল্লাহ তার সত্যতার প্রমাণ হিসেবে চন্দ্র বিদীর্ণ হওয়ার মুজিযা প্রকাশ করেন। যার বাস্তবতা অকাট্যরূপে প্রমাণিত। কিন্তু কাফেররা তা অস্বীকার করেছে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন, কিয়ামত নিকটবর্তী হয়েছে এবং চন্দ্র বিদীর্ণ হয়েছে। তারা (কাফেররা) কোনো নিদর্শন দেখলে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং বলে, এটা তো চিরাচরিত জাদু। (সূরা ক্বমার: ১-২)
ঘটনার সার-সংক্ষেপ হলো, রাসূলুল্লাহ (সা) মক্কার মিনা নামক স্থানে এক চন্দ্রোজ্জল রজনীতে উপস্থিত ছিলেন। সেখানে মুশরিকরা তাঁর কাছে নবুওয়াতের নিদর্শন চাইল। তখন আল্লাহ তাআলা নবীজির হাতের ইশারায় এই সুস্পষ্ট অলৌকিক ঘটনা দেখিয়ে দিলেন যে, চন্দ্র দ্বিখন্ডিত হয়ে একখন্ড পুর্বদিকে অপরাখন্ড পশ্চিমদিকে চলে গেল এবং উভয় খন্ডের মাঝখানে পাহাড় অন্তরাল হয়ে গেল। রাসূলুল্লাহ (সা) উপস্থিত সবাইকে বললেন, দেখ এবং সাক্ষ্য দাও। সবাই যখন পরিস্কাররূপে এই মুজিযা দেখে নিল তখন চন্দ্রের উভয়খন্ড পুনরায় একত্রিত হয়ে গেল। আনাস (রা) বর্ণনা করেন, রাসূল (সা) এর যুগে চন্দ্র বিদীর্ণ হয়ে দ্বিখন্ডিত হয়েছিল যা সবাই অবলোকন করেছিল। (বুখারী: ৩৮৬৯)
আঙ্গুল থেকে ঝর্ণাধারার প্রবাহ:
হুদাইবিয়ার দিন লোকেরা খুব পিপাসার্ত হয়ে পড়েছিল। তাদের নিকট অযু ও পান করার মতো কোনো পানি ছিল না। শুধুমাত্র রাসূল (সা) এর নিকট একটি চামড়ার পাত্র ভর্তি পানি ছিল। তিনি তা দিয়ে অযু করে নিলেন। তখন লোকেরা তাঁর নিকট এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আপনার চর্মপাত্রের পানি ব্যতীত আমাদের কাছে আর কোনো পানি নেই যা থেকে আমরা অযু ও পান করব। অতঃপর রাসূল (সা) তাঁর হাত ঐ চর্মপাত্রে রাখলেন তখন সাথে সাথে তাঁর আঙ্গুলগুলো থেকে ঝর্ণাধারার মতো পানি প্রবাহিত হতে লাগল। উপস্থিত সকলে তা থেকে তৃপ্তিসহকারে পান করল ও অযু করল। বর্ণনাকারী জাবির (রা) বলেন, সেদিন আমরা ১৫০০ লোক ছিলাম। আমরা যদি একলক্ষ লোকও থাকতাম তবুও এ পানি আমাদের জন্য যথেষ্ঠ হত। (বুখারী: ৪১৫২)
শক্ত পাথর চূর্ণ-বিচূর্ণ হওয়া:
খন্দক খননকালে এক স্থানে অত্যন্ত শক্ত একটি পাথর দৃষ্টিগোচর হলো। পাথরটিকে কোদাল দ্বারা আঘাত করলে সে আঘাতে পাথরটির কিছুই হলো না, বরং কোদাল প্রত্যাখ্যাত হয়ে ফিরে আসতে থাকল। সাহাবায়ে কেরাম বহু চেষ্টার পরও তা ভাঙ্গতে পারেনি। অতঃপর উপায়ান্তর না দেখে নবী করিম (সা) কে ব্যাপারটি অবহিত করা হল। তখন রাসূলুল্লাহ (সা) সেখানে আগমন করলেন, কোদাল হাতে নিয়ে বিসমিল্লাহ বলে পাথরটিকে আঘাত করলেন এতে পাথর চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে বালুকারাশিতে পরিণত হলো। (বুখারী: ৪১০১)
স্বল্প খাবার, আহার শেষেও পূর্বপরিমাণ বহাল:
খন্দকের যুদ্ধে পরিখা খননকালে রাসূল (স) এবং সাহাবায়ে কেরাম তিনদিন পর্যন্ত অনাহারে কাটাচ্ছিলেন। (চলবে)
লেখক: শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন