ইতিকাফের ফযীলত ও গুরুত্ব
ইতিকাফ অত্যন্ত বড় ও গুরুত্বপূর্ণ একটি ইবাদত। একজন মুমিনের জীবনে এর গুরুত্ব ও উপকারিতা সীমাহীন। যদি এটি একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় আদায় করা হয়, তাহলে তার ফযীলত ও মর্যাদা তুলনাহীন। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-‘আমি ইবরাহীম ও ইসমাঈলকে আদেশ করলাম, তোমরা আমার ঘরকে [বাইতুল্লাহকে] পবিত্র কর তাওয়াফকারী, ইতিকাফকারী ও রুকু-সিজদাকারীদের জন্য।’ (সূরা বাকারা/১২৫) উক্ত আয়াতে আল্লাহ তাআলা তাঁর দু’জন জলীলুল কদর ও বড় মাপের নবীকে বাইতুল্লাহ পুন:নিমার্ণের পরপরই ইতিকাফকারীদের জন্য তা পবিত্র করার নির্দেশ দিয়েছেন। এর দ্বারাই মূলত ইতিকাফের গুরুত্ব ও মহত্ত্ব আন্দায করা যায়। আরও আন্দায করা যায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর আমল দ্বারা। তিনি মদীনায় আগমনের পর অন্য অনেক আমল মাঝে-মধ্যে ছেড়ে দিলেও মৃত্যু পর্যন্ত ইতিকাফের আমল কোনো সময় ছাড়েন নি। আম্মাজান আয়েশা রা. বলেন, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মৃত্যু পর্যন্ত রমযানের শেষ দশকের ইতিকাফ করেছেন। এরপর তার পূণ্যবতী জীবন সঙ্গিনীগণও ইতিকাফ করেছেন। [বুখারী: হাদীস, ২০২৬; মুসলিম: হাদীস, ১১৭২] সাহাবী ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ইতিকাফকারী সর্ব প্রকার পাপ হতে মুক্ত থাকে এবং অন্যরা বাইরে আমল করে যে নেকী লাভ করে, সে ইতিকাফে থেকে বাইরের আমলগুলো না করেও সেই পরিমাণ নেকী লাভ করে। [ইবনে মাজা, হাদীস:১৭৮১] উক্ত হাদীসে ইতিকাফের দুটি বড় ফায়দার কথা বর্ণিত হয়েছে। ১. যাবতীয় পাপ হতে মুক্ত থাকা। বাইরে থাকলে আমাদের মতো মানুষের গুনাহে লিপ্ত হওয়ার আশঙ্কাই প্রবল ছিল; কিন্তু ইতিকাফের দরুণ তা থেকে রক্ষা তো পেলই ২. অধিকন্তু না করেও অনেক নেক আমল; যেমন জানাজায় শরীক হওয়া, রুগীর সেবা করা ইত্যাদির নেকী মুফতে পেয়ে গেল। ইতিকাফকারী যেহেতু ইতিকাফে থাকার কারণে বাইরের অনেক পূণ্যের কাজে অংশ গ্রহণ করতে পারে না, তাই ধারণা হতে পারে যে, সে অনেক পূণ্যের কাজ থেকে বঞ্চিত হলো। এ জন্য পরম দয়ালু আল্লাহ তাআলা তাঁর হাবীবের মাধ্যমে জানিয়ে দিলেন যে, না করেও সে এ সব আমলের সওয়াব প্রাপ্ত হবে। সুবহানাল্লাহ! কি অপূর্ব সুযোগ। ইতিকাফ না করে বাইরে থাকলে হয়তো সে এই আমলগুলো নাও করতে পরতো, কিন্তু এখন ইতিকাফের বদৌলতে সেই আমলগুলোর সওয়াবও পেয়ে গেলো। অপর এক বর্ণনায় এসেছে, সাহাবী ইবনে আব্বাস রা. মসজিদে নববীতে ইতিকাফ অবস্থায় ছিলেন। এমতাবস্থায় জনৈক ব্যক্তি এসে তাঁকে সালাম দিয়ে চুপ করে বসে গেলন। তাকে দেখে ইবনে আব্বাস রা. বললেন, ব্যাপার কি? তোমাকে খুব বিষণœ ও চিন্তাকিøষ্ট মনে হচ্ছে। তিনি বললেন, হে আল্লাহর রাসূলের চাচাত ভাই! হাঁ, নিশ্চয় আমি চিন্তিত ও পেরেশান। কারণ জনৈক ব্যক্তির কাছে আমি ঋণী। এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর রওজার দিকে ইশারা করে বললেন, ঐ কবর ওয়ালার ইজ্জতের শপথ, সেই ঋণ আদায়ের সামর্থ আমার নেই। এ কথা শুনে ইবনে আব্বাস রা. বললেন, আমি কি তোমার জন্য তার কাছে সুপারিশ করবো? লোকটি বললেন, আপনি যা ভালো মনে করেন। এ কথা শুনে ইবনে আব্বাস রা. তৎক্ষণাত জুতা পরে মসজিদের বাহিরে এলেন। এটি দেখে লোকটি বললেন, হযরত, আপনি হয়তো ইতিকাফের কথা ভুুলে গেছেন। তিনি বললেন, না; ভুলি নাই। [তখন তাঁর চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরছিল] বেশি দিনের কথা নয়, [মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রওজার দিকে ইশারা করে বললেন] আমি এই কবরওয়ালার নিকট শুনেছি, তিনি বলেছেন, যে ব্যক্তি নিজ মুসলিম ভাইয়ের কোনো হাজত পুরণার্থে রওনা হয় এবং তাতে সে চেষ্টা করে, তা তার দশ বছর ইতিকাফ করার চেয়েও উত্তম হয়। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য একদিন ইতিকাফ করে আল্লাহ তাআলা তার ও জাহান্নামের মাঝে তিন খন্দক দূরত্ব সৃষ্টি করে দেন, যার দূরত¦ আকাশ ও জমীনের মধ্যবর্তী স্থান হতেও বেশি। [শুআবুল ঈমান, বায়হাকী: ৩৬৭৯] একদিন ইতিকাফের এই পরিমাণ সওয়াব হলে দশ বছর ইতিকাফের কি পরিমাণ সওয়াব হবে? এক বর্ণনায় মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি রমযান মাসে দশ দিন ইতিকাফ করবে, তার এই ইতিকাফ নেকী ও শ্রেষ্ঠত্বের বিবেচনায় দুটি হজ¦ ও দুটি ওমরার সমপর্যায়ের হবে। [শুআবুল ঈমান, বায়হাকী, হাদীস: ৩৬৮০, ৩৬৮১] অন্য এক বর্ণনায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ইতিকাফকারী প্রতিদিন একটি করে হজে¦র সওয়াব পায়। [শুআবুল ঈমান, বায়হাকী, হাদীস: ৩৬৮২]
ইতিকাফের তাৎপর্য
এই বিশাল ফযীলত ও বরকতপর্ণ ইবাদত ইতিকাফের তাৎপর্য ও মর্মকথা হলো, অন্তরকে সকল কিছু থেকে মুক্ত করে আল্লাহর সাথে জুড়ানো। দুনিয়ার সকল কর্ম ব্যস্ততা থেকে ফারেগ হয়ে একমাত্র আল্লাহর জন্য ব্যস্ত হওয়া। পার্থিব সকল সর্ম্পক ছিন্ন করে কেবল মাত্র তাঁরই সাথে সর্ম্পক স্থাপন করা। শয়নে-স্বপনে শুধু তাঁরই যিকর-ফিকর ও ইশক-মহব্বতে আপাদ মস্তক ডুবে থাকা। এভাবে ইতিকাফ করতে পারলে পওয়া যাবে ইতিকাফের প্রকৃত স্বাদ ও মজা এবং সৃষ্টি হবে মহান প্রভুর সাথে গভীর ও প্রকৃত ইশক-মুহব্বত এবং অর্জিত হবে ইতিকাফের বর্ণিত ফাযায়েল। এই মুহাব্বাত উপকারে আসবে নির্জন কবরেও, যেখানে তাঁর মুহাব্বত ছাড়া অন্য কোন মুহাব্বত কাজে আসবে না।
ইতিকাফের উদ্দেশ্য
ইতিকাফের উদ্দেশ্য হলো, আল্লাহর সাথে বান্দার সর্ম্পক সুগভীর ও সুনিবিড় করা। কেননা রোযার মাধ্যেমে প্রবৃত্তিকে দমন করে নফসকে শরীআহ পরিপালনের উপযুক্ত করা হয়। এভাবে রোযা রেখে যখন বিশ দিন অতিবহিত হলো, নফস যেন রুহানী চিকিৎসার একটি কোর্স সম্পন্ন করে ফেললো। এখন আল্লাহ তাআলা বান্দা থেকে চাচ্ছেন যে, আমার বান্দা দুনিয়ার সকল কিছু থেকে মুক্ত হয়ে আমার দরবারে চলে আসুক। আমি ব্যতীত অন্য কারো সাথে কোন তাআল্লুক বা সর্ম্পক না রাখুক। [ফাযায়িলে রামাযান: ৫১]
ইতিকাফের হিকমত ও উপকারিতা
এই ইতিকাফের অনেক হিকমত ও উপকারিতাও রয়েছে। কয়েকটি উল্লেখ করলাম। ১. ইতিকাফের সবচে বড় হিকমত ও উপকারিতা হলো, ইতিকাফ করলে শবে কদরের মত মহিমময় রাতের নছীব হয়। কেননা হাদিসের ভাষ্য মতে শবে কদর রমযানের শেষ দশকেই হয়। যেমন এক হাদীসে আছে- সাহাবী আবূ সাঈদ খুদরী রা. বলেন, হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমযান মাসের প্রথম দশকে ইতিকাফ করেন। অতপর দি¦তীয় দশকেও ইতিকাফ করেন। এরপর তুর্কী তাবু হতে মাথা মুবারক বের করে নবীজী বললেন, আমি কেবল শবে কদরের তালাশেই প্রথম ও দ্বিতীয় দশকে ইতিকাফ করেছিলাম। অনন্তর আমাকে বলা হলো, উহা রমযানের শেষ দশকে। সুতরাং যে কেউ আমার সাথে ইতিকাফ করে সে যেন শেষ দশকে ইতিকাফ করে। উক্ত রাত আমাকে দেখানো হয়েছিল কিন্ত আমি তা ভুলে গিয়েছি। তবে তার আলামত এই যে, আমি আমাকে সেই রাতের সকালে পানি ও কাদা মাটির মধ্যে সিজদা করতে দেখেছি। কাজেই তোমরা শবে কদরকে রমাযানের শেষ দশকে তালাশ কর। [বুখারী: হাদীস,২০২৭] উক্ত হাদীসের ভাষ্য মতে, শবে কদর শেষ দশকে হয়। আর ইতিকাফও শেষ দশকেই করা হয়, তাই ইতিকাফকারীর শবে কদর পাওয়াটা অনেকটাই নিশ্চত। আর শবে কদরের ফযীলতের কথা কে না জানে? কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে- শবে কদর [ফযীলত ও শ্রেষ্ঠত্বের বিচারে] হাজার মাস অপেক্ষা উৎকৃষ্টতর।[সূরা কদর] হাদীস শরীফে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি মুমিন অবস্থায় সুওয়াবের আশায় শবে কদরে ইবাদত করে, তার পূর্বকৃত সকল গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়। [বখারী: ১/২৭০, হাদীস: ১৯০১] অন্য বর্ণনায় আছে- একবার রমযানু মুবারকের আগমন ঘটলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, নিশ্চয় তোমাদের নিকট এমন মাসের আগমন ঘটেছে, যে মাসে এমন এক রজনী (শবে কদর) রয়েছে যা হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। যে এই পূণ্যময়ী রাতে বঞ্চিত হলো সে সর্ব প্রকার মঙ্গল হতে বঞ্চিত হলো আর তার মঙ্গল হতে কেবলমাত্র হতভাগ্যই বঞ্চিত হয়। [ইবনে মাজা, হাদীস: ১৬৪৪] লেখার কলেবর বৃদ্ধির আশঙ্কায় শবে কদর সংক্রান্ত একটি আয়াত ও দুটি হাদীস উল্লেখ করেই ইতি টানলাম। (চলবে)
লেখক : প্রধান মুফতী ও সিনিয়র মুহাদ্দিস জামিয়া মিফতাহুল উলুম মাদরাসা, নেত্রকোনা
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন