আর্থিক খাতের কয়েকটি প্রতিষ্ঠান থেকে ৩ হাজার ৬শ’ কোটি টাকা লোপাটের হোতা প্রশান্ত কুমার হালদার (পি কে হালদার)’র অন্যতম সহযোগী হাফসা আলম (ওরফে হাফসা মালিক) দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। যে কোনো মুহূর্তে উড়াল দেয়ার পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়েছেন পি কে’র আরেক সহযোগী মাহমুদ মালিক। হাফসা আলম এবং মাহমুদ মালিক সম্পর্কে স্বামী-স্ত্রী। হাফসা মালিকই পরিচয় গোপন করে ‘হাফসা আলম’ নামে ‘সুকুজা ভেঞ্চার লি:’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিযুক্ত হন। এটি পি কে হালদারেরই একটি বেনামী প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ লাভের ক্ষেত্রে হাফসা আলম স্বামীর নাম গোপন করেন। ব্যবহার করেন পিতার নাম-ঠিকানা। এই দম্পতিকে দিয়ে তিনটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে পি কে হালদার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে জানা গেছে।
নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, হাইকোর্টের নির্দেশনায় বাংলাদেশ ব্যাংক পাঁচ সদস্যের একটি ‘ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটি’ গঠন করে। কমিটি কার্যক্রম শুরু করলে ঈদুল আজহার পরপরই যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান হাফসা মালিক। স্বামী মাহমুদ মালিক ‘ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড’(ইডকল)র প্রধান নির্বাহী হওয়ায় তিনি দেশে রয়ে যান। গত ৩১ জুলাই প্রতিষ্ঠানটিতে তার চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়। ইডকলে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে নিয়োগ লাভের আগে (২০০৮-২০১২ পর্যন্ত) মাহমুদ মালিক ‘বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স কোম্পানি’ (বিআইএফসি)’র প্রধান নির্বাহী ছিলেন। এ সময় প্রতিষ্ঠানটিকে অন্তত: ৫শ’ কোটি টাকা ঋণ দেয়া হয় বিনা জামানতে। ধারণা করা হচ্ছে, ঋণের এই টাকার চ‚ড়ান্ত গন্তব্য হচ্ছে পি কে হালদারেরই প্রতিষ্ঠান। এ বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গতকাল (সোমবার) মাহমুদ আলীকে তলব করে ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটি। আজ (মঙ্গলবার) সকাল সাড়ে ১১টায় কমিটির সামনে হাজির হয়ে তার বক্তব্য দেয়ার কথা। মাহমুদ মালিককে তলবি নোটিশে বলা হয়, ‘সুপ্রিম কোর্ট অব বাংলাদেশ’র হাইকোর্ট ডিভিশনের কোম্পানি ম্যাটার নং-৩২/২০২০ এর ভিত্তিতে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে সংঘটিত অনিয়ম-অসঙ্গতি উদ্ঘাটনে ডেপুটি গভর্নর-৩ মহোদয়কে সভাপতি করে ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটি গঠন করা হয়। আপনি বিআইএফসিতে তৎকালিন ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। কমিটি বিআইএফসিতে সংগঠিত অনিয়ম সংক্রান্তে পুনরায় আপনার বক্তব্য গ্রহণ প্রয়োজন মনে করছে। এমতাবস্থায়, আগামী ৩ আগস্ট-২০২১ তারিখ রোজ মঙ্গলবার সকাল ১১.৩০ ঘটিকায় মতিঝিলস্থ বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের মূল ভবনের ৪র্থ তলায় মিনি কনফারেন্স কক্ষে উপস্থিত থাকার জন্য আপনাকে অনুরোধ করা যাচ্ছে।
অথচ নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, এই তলবি চিঠি ইস্যুর আগেই মাহমুদ মালিক দেশছাড়ার সকল প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন বলে জানা গেছে।
সূত্রমতে, গত ২৬ জুলাই কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই মর্মে একটি আদেশ জারি করে যে, আর্থিক প্রতিষ্ঠান প্রধানদের বিদেশ যেতে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি লাগবে। আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইন, ১৯৯৩ এর ১৮ (ছ) ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে এ নির্দেশনা জারি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এদিকে মাহমুদ মালিক ছিলেন আর্থিক প্রতিষ্ঠান ‘ইডকল’র প্রধান নির্বাহী। গত ৩১ জুলাই ইডকলে তার চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। তাই তিনি এখন আর প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী নেই-এই মর্মে যুক্তি দেখিয়ে ইতোমধ্যে বিদেশ যাত্রার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন (এনওসি) নিয়ে নিয়েছেন। ফলে তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই নির্দেশনার আওতায় পড়ছেন না। তাই মাহমুদ মালিকের বিদেশযাত্রার ক্ষেত্রে আইনগত কোনো বাধাই থাকছে না। এরই মধ্যে তিনি দেশত্যাগের লক্ষ্যে বিমানের টিকিটও সংগ্রহ করেছেন বলে জানায় নির্ভরযোগ্য সূত্র। অথচ ‘ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি’ মাহমুদ মালিক এবং তার স্ত্রী হাফসা আলম ওরফে হাফসা মালিক পি কে হালদারের সহযোগী হিসেবে হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন মর্মে আলামত পেয়েছে বলে জানায় সূত্রটি। স্ত্রীর নিরাপদ দেশত্যাগের পর কূটকৌশলী মাহমুদ মালিকও যদি দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান তাহলে পি কে হালদারের অর্থ লোপাটের বড় দুই সহযোগীই নাগালের বাইরে চলে গেলেন। এতে হাইকোর্ট নির্দেশে গঠিত ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটি তিন প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এবং দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করলেও তাদের আইনের আওতায় আনা যাচ্ছে না।
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)র একটি সূত্র জানায়, বিআইএফসি’তে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে মাহমুদ মালিকের অন্তত: ৫শ’ কোটি টাকা বিনা জামানতে ঋণ দেয়ার অভিযোগে একটি মামলা হয়। মামলার তদন্ত শেষে তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের উপ-পরিচালক এসএম সাহিদুর রহমান ২০১৭ সালে মামলার চার্জশিট দাখিলের সুপারিশ সম্বলিত এম.ই (মেমো অব এভিডেন্স) কমিশনে জমা দেন। কিন্তু দুদকের বিগত কমিশন চারবছর সেই চার্জশিটের অনুমোদনটি রহস্যজনক কারণে ঝুলিয়ে রাখে। ফলে শত শত কোটি টাকা তসরুপ করেও মাহমুদ মালিক নির্বিঘেœ ‘ইডকল’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটি ধারণা করছে, ইডকল থেকেও পি কে হালদারের ঘনিষ্ঠ সহযোগী মাহমুদ মালিক বিপুল অর্থ হাতিয়েছেন। এ অর্থের চ‚ড়ান্ত গন্তব্যও পি কে হালদার।
প্রসঙ্গত: পি কে হালদারের সংশ্লিষ্টতায় পিপলস লিজিংসহ কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ডুবতে বসার কারণ অনুসন্ধানে সাত সদস্যের ‘কারণ উদ্ঘাটন’ (ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং) কমিটি চ‚ড়ান্ত করে দেন বিচারপতি মুহাম্মদ খুরশিদ আলম সরকারের হাইকোর্ট বেঞ্চ। বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর এ কে এম সাজেদুর রহমান খানকে সভাপতি ও বৈদেশিক মুদ্রা পরিদর্শন বিভাগের উপমহাব্যবস্থাপক মো. সারোয়ার হোসেনকে কমিটির সদস্য সচিব করা হয়েছে। কমিটিতে সদস্যরা হলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক এ কে এম ফজলুর রহমান, ফাইন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি ডিপার্টমেন্টের মহাব্যবস্থাপক মো. কবির আহাম্মদ, ব্যাংক পরিদর্শন বিভাগ-৪-এর মহাব্যবস্থাপক মো. নূরুল আমীন, সাবেক জেলা ও দায়রা জজ মঈদুল ইসলাম ও সাবেক সচিব নূরুর রহমান। কার্যক্রমের ধারাবাহিকতায় এ কমিটি পি কে হালদারের ঘনিষ্ঠ সহযোগী মাহমুদ মালিক এবং হাফসা আলম ওরফে হাফসা মালিককে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করে। এর আগে পি কে হালদারের হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ এবং পাচারের ঘটনায় বেশ কয়েকটি মামলা করেছে দুদক। পি কে হালদার এবং তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে আরো অন্তত: ৩৩টি মামলার প্রস্তুতি নিয়েছে। মামলার তদন্ত প্রক্রিয়ায় পি কে হালদারের আশ্রয়-প্রশ্রয় দাতা বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর এস.কে সুর, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মো. শাহ আলমসহ ৮ ব্যাংক কর্মকর্তার দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেয় দুদক। এছাড়া হাইকোর্ট ১২২ ঋণ খেলাপির দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেয় দুদক।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন