শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

বিনোদন প্রতিদিন

দূরদর্শী ও মানবিক চিন্তার ইত্যাদি

কামরুল হাসান দর্পণ | প্রকাশের সময় : ৪ আগস্ট, ২০২১, ১২:০২ এএম

দীর্ঘ তিন যুগের অধিক সময় ধরে দেশের গণমানুষের অনুষ্ঠান ইত্যাদি চলছে। বিশ্বে আর কোনো অনুষ্ঠানকে এত দীর্ঘ সময় ধরে চলতে দেখা যায়নি। ইত্যাদিই একমাত্র অনুষ্ঠান যা সুদীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে অব্যাহত গতিতে চলেছে। বলা হয়ে থাকে, বয়স বাড়ার সাথে সাথে মানুষের রং, রূপ, যৌবন ও কর্মক্ষমতা হ্রাস পায়। সবকিছু পুরনো হয়। তবে ইত্যাদি এমনই একটি অনুষ্ঠান যার রং-রূপের পরিবর্তন এতটুকু পরিবর্তন হয়নি। বরং হিরা কাটার মতোই এর ঔজ্জ্বল্য ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। দ্যুতি ছড়িয়ে দিচ্ছে। অনুষ্ঠানটি স্বর্ণের মতোই। স্বর্ণে যেমন ঝং ধরে না, মরিচিকা পড়ে না, তেমনি ইত্যাদির মানেও এতটুকু আঁচড় পড়েনি, দর্শক চাহিদাও কমেনি। বরং চিরকালের অতিচাহিদাসম্পন্ন স্বর্ণ ও হিরার মতো হয়ে রয়েছে। একটি অনুষ্ঠান শুরুতে যতই জনপ্রিয়তা অর্জন করুক না কেন, কালপরিক্রমায় তার ক্ষয় হতে দেখা যায়। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হয়ে রয়েছে ইত্যাদি। ব্যতিক্রমের সাথে কোনো কিছুর তুলনা হয় না। এটি নিজস্ব বৈশিষ্ট্য নিয়েই মানুষকে বিস্মিত ও বিমুগ্ধ করে থাকে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ইত্যাদি চিরতরুণ হয়ে মানুষের মনে বিচরণ করছে কিভাবে? সাধারণ দর্শক থেকে শুরু করে সচেতন ও মনোযোগী দর্শক যদি লক্ষ্য করেন তাহলে দেখবেন, ইত্যাদি এমনই একটি অনুষ্ঠান যার ভিত্তি আমাদের পরিবার, সমাজ, সংস্কৃতির চিরায়ত মূল্যবোধ, নীতি-নৈতিকতা। ইত্যাদির মূল ভিত্তিটিই সেখানে, যে ভিত্তি কখনোই দুর্বল হয় না। সময়ের পরিক্রমায় যেখানে আমাদের এসব বৈশিষ্ট্য ও মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটছে, সেক্ষেত্রে ইত্যাদি ‘বিবেক’ হয়ে দেদিপ্যমান হয়ে রয়েছে। ‘রাডার’ হয়ে নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধের কাণ্ডারি হয়ে আছে। পরিবার, সমাজ, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্যের ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলোকে এমনভাবে উপস্থাপন করছে যাতে ঘোরের মধ্যে থাকা আমাদের বোধে টোকা দিয়ে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলছে, আমাদের পরিবার, সমাজ, সংস্কৃতি, ইতিহাস কিন্তু এটা। আমরা যারা আমজনতা তারা ইত্যাদির এসব উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে আনন্দ লাভ করি। তবে সচেতন ও বোধসম্পন্ন মানুষ মাত্রই আনন্দ লাভের পাশাপাশি এসব বিষয়ের অন্তর্নিহিত ভাবের বিষয়টি উপলব্ধি করেন এবং তাদের বোধকে শানিত করেন। ইত্যাদি একটি আনন্দদায়ক বা নিছক বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান, এ কথা বলার সুযোগ নেই। বরং আনন্দের পাশাপাশি, শিক্ষা, তথ্য, উন্নয়ন, অগ্রগতি, বোধ, বিবেক ও উপলব্ধিকে জাগ্রত রাখার অনুষ্ঠান। একটি মানবিক এবং মানবিকতার উন্নয়নের অনুষ্ঠান। এমন অনুষ্ঠান বিশ্বে দ্বিতীয়টি নেই। বলার অপেক্ষা রাখে না, চিন্তা-ভাবনার নির্দিষ্ট ব্যপ্তি নেই। তবে সুচিন্তার অভাব রয়েছে। চিন্তা, চিন্তাকে প্রসারিত করে। এটি বহমান স্রোতের মতো। এক্ষেত্রে দেখার প্রয়োজন, সেটি সুচিন্তা নাকি কুচিন্তা। ইত্যাদি এই দুই চিন্তার মধ্যকার পার্থক্য হয়ে রয়েছে। ‘স্ট্রিম অফ কনসাস’ বা চেতনা প্রবাহ হয়ে আছে। সুচিন্তার উপস্থাপন এবং তার যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে এর বিস্তার ঘটিয়ে চলেছে। আমরা যদি লক্ষ্য করি তাহলে দেখব, যে সচেতন মানুষটির বয়স এখন ত্রিশের কোটা পার হয়েছে, তার মধ্যে ইত্যাদির সুকুমারবৃত্তিগুলোর কোনো না কোনো প্রভাব রয়েছে। ইত্যাদি যেমন সুচিন্তার ধারক, তেমনি সুচিন্তাকারিদের পৃষ্ঠপোষকও বটে। দেশের আনাচে-কানাচে, নিবৃত্তে, অনাবিষ্কৃত সুচিন্তকদের রাডারের মাধ্যমে শনাক্ত করে তাদের মহৎ কর্ম তুলে আনার ক্ষেত্রে নিরলসভাবে কাজ করে চলেছে। আমরা যদি গত ৩০ জুলাই প্রচারিত ইত্যাদির নতুন পর্বটি দেখি তাহলে দেখব, নাটোরের বরই গ্রামের একজন অবসরপ্রাপ্ত প্রকৌশলী মো. আমিনুল্লাহ কিভাবে সারাজীবন সৎ থেকে জীবনযাপন করে অন্যকেও সততার সাথে এবং নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধের মধ্যে জীবনযাপনে উৎসাহিত করতে নিরলসভাবে পরিশ্রম করে চলেছেন। তার একটি বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, আমার এই কাজের মাধ্যমে যদি একজন মানুষও সচেতন ও সতর্ক হয়, তাতেই আমার পরিশ্রম সার্থক। আমাদের সমাজে নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয়ের মধ্যেও যে কিছু সচেতন ও মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ রয়েছেন এবং যাদের সুকর্ম মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিচ্ছেন, অন্ধকারের মধ্যে আলোকবর্তিকা হয়ে রয়েছেন, ইত্যাদি তথা এর চিন্তক এবং প্রাণ পুরুষ হানিফ সংকেত অত্যন্ত সূচারুভাবে প্রতিনিয়ত তা তুলে ধরছেন। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রযুক্তির অপব্যবহার কতটা ভয়ংকর হয়ে উঠছে, পারিবারিক বন্ধন আলগা করে দিচ্ছে, মানুষকে বিপথগামী করছে তা অত্যন্ত দক্ষতার সাথে বিরামহীনভাবে উপস্থাপন করে চলেছেন। তবে প্রযুক্তিকে অস্বীকার না করে এর সুষ্ঠু ব্যবহারে যে মানুষ ব্যাপকভাবে উপকৃত হতে পারে, এই ইতিবাচক দিকটিও তুলে ধরেছেন। প্রতি তিন মাস পরপর ইত্যাদি নিয়ে হাজির হয়ে হানিফ সংকেত আমাদের বোধকে জাগিয়ে দিচ্ছেন। এ কাজ বিগত তিন যুগেরও বেশি সময় ধরে তিনি করছেন। ইত্যাদির সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তথ্যের সঠিক উপস্থাপন এবং ইতিহাস থেকে বর্তমানের মেইলবন্ধন রচনা করা। ঐতিহাসিক স্থানগুলোতে অনুষ্ঠানটি ধারণ করে হানিফ সংকেত ইতিহাসের ভিত্তির উপর দাঁড়িয়েই সুতীক্ষè পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে বর্তমান ও ভবিষ্যতের কথা বলেন এবং দিক-নির্দেশনা দেন। কি করা উচিৎ, কি করা উচিৎ নাÑএর সরল বিষয়টি বাৎলে দিচ্ছেন। সুদূর অতীত থেকে বর্তমান পর্যন্ত আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য, দর্শন, শিল্প-সংস্কৃতি, নীতি-নৈতিকতা, মূল্যবোধে মালা গেঁথে যেভাবে তিনি উপস্থাপন করেন তা আমাদের দেশে তো নয়ই, বিশ্বের অন্যকোনো অনুষ্ঠানে দেখা যায় না। আমাদের গৌরবের মেট্রোরেলের সূচনার স্থানে দাঁড়িয়ে এবং এর অনুপুঙ্খ তথ্য যেভাবে তুলে ধরেছেন, তা আমাদের দেশের এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়কে বিশ্বে পরিচিত করেছে। শালবহন বিহার থেকে মহাস্থান গড়সহ আমাদের প্রাচীন ও ঐতিহাসিক নিদর্শনের স্থান থেকে অত্যাধুনিক মেট্রোরেলের কেন্দ্রস্থল পর্যন্ত ইত্যাদি যেভাবে যোগসূত্র স্থাপন করেছে তা সাধারণ কোনো চিন্তা-ভাবনার ফসল নয়। এ এক অলিম্পিয়ান হাইটের চিন্তাভাবনা। আবার শুধু দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্যই নয়, বিশ্বের ঐতিহাসিক স্থানগুলোর তথ্য তুলে ধরে দর্শকের জ্ঞানভান্ডার সমৃদ্ধ করতে ভূমিকা রেখে চলেছেন। একজন সচেতন, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ও সুচিন্তকের চিন্তা-ভাবনা কেমন হয় এবং তার প্রায়োগিক বিষয়টি কিভাবে তুলে ধরতে হয়, তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হানিফ সংকেত। ইত্যাদির পরতে পরতে তিনি বোধ-বুদ্ধি, নীতি-নৈতিকতা, মানবিকতা, মূল্যবোধ, দায়িত্বশীলতা ও সচেতনতার বিষয়গুলো তুলে ধরছেন। এখন বিনোদনের কথা বিচার করলে ইত্যাদির ব্যাপ্তিটিও বিশাল পরিসরের। চলচ্চিত্রকে যদি বিনোদনের সবচেয়ে বড় মাধ্যম ধরা হয়, তবে তা ছাপিয়ে ইত্যাদি বড় মাধ্যম হয়ে উঠেছে। একটি ভাল মানের চলচ্চিত্রে দেশের পারিবারিক ও সামাজিক আচার-আচরণ, মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, শিল্প-সংস্কৃতি, অর্থনৈতিক উন্নয়ন-অগ্রগতি, সমস্যা, ত্রুটি-বিচ্যুতি, আনন্দ-বেদনা, সর্বোপরি মানবিক দিকগুলো তুলে ধরা হয়। এ বিবেচনায় ইত্যাদির কয়েক মিনিটের প্রতিটি স্কিড যেন একেকটি বৃহৎ চলচ্চিত্রের সারসংক্ষেপ। ইত্যাদিকে সাধারণ দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করা সম্ভব নয়, এর জন্য প্রয়োজন গভীর দৃষ্টিভঙ্গি, দূরদর্শী চিন্তা ও মানবিকতা।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (8)
Md. Nurul Alam Khan ৪ আগস্ট, ২০২১, ১১:২৫ এএম says : 0
Best TV performer Bangladesh Hanif Sanket is also a dramatist, good writer and a popular TV personality of country. Best wishes to him.
Total Reply(0)
Arif Billah ৪ আগস্ট, ২০২১, ১১:২৬ এএম says : 0
Your presentation is very beautiful and your speaking style is different from others which is why you like it so much
Total Reply(0)
Zakir Hossain ৪ আগস্ট, ২০২১, ১১:২৬ এএম says : 0
It's a unique program there is no doubt about it! Carry on dear H S.
Total Reply(0)
Halima Jakie ৪ আগস্ট, ২০২১, ১১:২৭ এএম says : 0
অসাধারণ ‌ যুক্তিবাদী‌ উপস্থাপনা
Total Reply(0)
Mashud Rashid ৪ আগস্ট, ২০২১, ১১:২৭ এএম says : 0
ইত্যাদি বাংলাদেশে বিনোদন তথ্যনির্ভর শিক্ষনিয় এবং রুচিবোধ নিয়ে এমন একটি ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান, ,যার সাথে কোন উপমা দেওয়া চলবে না,,,,আর এই অনুষ্টানের মুল পরিকল্পনা ও পরিচালনায় এবং স্হান ইতিহাস ঐতিহ্য কে যিনি দর্শকের কাছে উপস্হাপন করেন তিনি হলেন সর্বশ্রেষ্ঠ গুনিজন জনাব হানিফ সংকেত, তাই এই অনুষ্টান আজিবন মানুষ দেখবে,
Total Reply(0)
Sayed Hasan ৪ আগস্ট, ২০২১, ১১:২৮ এএম says : 0
Tnx Hanif Sanket sir...amader sundor binodon dabar jonno
Total Reply(0)
Musfikur Rahman ৪ আগস্ট, ২০২১, ১১:২৯ এএম says : 0
ইত্যাদি শুধু একটি অনুষ্ঠানমালা ই নয় , এটি একটি অনুভূতির নাম, যা সারা বাংলাদেশের বৃদ্ধ আবাল বনিতা সকল বয়সের মানুষ উপলব্ধী করে ৷ এবং এটা নিঃস্কোচে বলা যায় হানিফ সংকেত সাহেব ই এই অনুষ্ঠান এর মূল আকর্ষন ৷ কেননা তার বচন ভঙ্গী, উপস্হাপনা দেখার জন্যই কোটি কোটি দর্শক শ্রোতা চেয়ে থাকে বাংলাদেশ টেলিভিশন এর দিকে ৷ হানিফ সংকেত সাহেব এর মঙ্গল কামনা করি ৷
Total Reply(0)
Online Aghori ৪ আগস্ট, ২০২১, ৭:১২ পিএম says : 0
tabe hanif sanket na thakle er popularity korme jete pare
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন