শনিবার, ০৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

তিস্তাপাড়ের মানুষের কান্না থামছে না

হালিম আনছারী, রংপুর থেকে | প্রকাশের সময় : ৭ আগস্ট, ২০২১, ১২:০১ এএম

কান্না থামছে না তিস্তা পাড়ের মানুষের। নদীর দিকে তাকিয়ে চোখের পানি ছাড়ছেন আর বুক চাপড়াচ্ছেন সর্বস্ব হারানো অসহায় মানুষগুলো। সর্বগ্রাসী তিস্তা প্রতিদিনই গিলে খাচ্ছে আবাদী জমি, গাছ-পালা, মসজিদ-মক্তব, রাস্তা, ঘর-বাড়িসহ পৈত্রিক ভিটেমাটি। ভিটে মাটি হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ছেন তিস্তা পাড়ের হতভাগ্য মানুষগুলো। চোখের পানি ছেড়ে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। কান্নাই এখন তাদের নিত্যসঙ্গী।
মহামারী করোনার প্রাদুর্ভাব ও কঠোর বিধিনিষেধ চলাকালীন সময়ে কাজ হারিয়ে বেকার হয়ে পড়ে চরাঞ্চলসহ তিস্তাপারের মানুষ। এরই মধ্যে তিস্তার পানি ৩/৪ দফা বাড়ে এবং কমে। বিভিন্ন স্থানে শুরু হয় ব্যাপক ভাঙন। ফসলি জমি, গাছপালাসহ ভিটেমাটি হারানোর ভয়ে নির্ঘুম রাত কাটাতে থাকে নীলফামারী, লালমনিরহাট, রংপুর, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধা জেলার ১৭টি উপজেলার নদীর তীরবর্তী মানুষ।
জানা গেছে, তিস্তা নদী বেষ্টিত রংপুরের ৫টি জেলা রংপুর, লালমনিরহাট, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধা জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত এই নদী। জন্ম থেকে খনন না করায় তিস্তা নদীর তলদেশ পলি ও বালু জমে ভরাট হয়ে গেছে। তাছাড়া ভারত তিস্তার উজানে গজলডোবা বাঁধ দিয়ে একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করায় শুষ্ক মওসুমে পানির অভাবে ধূ-ধূ বালু চর আর বর্ষা মৌসুমে অতিরিক্ত পানি ছেড়ে দেয়ায় উজানের পাহাড়ি ঢল ও সামান্য বৃষ্টিতেই পানি প্রবাহের পথ না পেয়ে নদীর দু-ক‚ল উপছে বন্যায় প্লাবিত হয়ে যায়। আর বন্যা কবলিত হয়ে পড়ে নীলফামারীর ৩টি, লালমনিরহাটের ৫টি, রংপুরের ৩টি, কুড়িগ্রামের ৪টি এবং গাইবান্ধার ২টি উপজেলা। এ বছর জুন থেকেই থেমে থেমে বন্যা অব্যাহত রয়েছে। প্রতিবার তিস্তার পানি বৃদ্ধির কারণে বন্যা কবলিত হয়ে ৪/৫ দিন কখনও বা সপ্তাাহের অধিক পানিবন্দি থাকে নদী তীরবর্তী এবং বিভিন্ন চরাঞ্চলের মানুষ। পানিবন্দি থেকে মুক্তি মিলতে না মিলতেই আবারো পানিবন্দি হচ্ছে এসব এলাকার মানুষ। এভাবে থেমে থেমে বন্যায় ফসলসহ ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়ছে তারা।
জানা গেছে, এবার আগাম বন্যার কারনে আগাম ভাঙন দেখা দিয়েছে তিস্তার বাম তীরে। কয়েক দিনের ব্যাবধানে লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচা ইউপির কুটিরপাড়, চন্ডিমারী, দক্ষিণ বালাপাড়া এবং সদর উপজেলার চর গোকুন্ডা গ্রামের প্রায় অর্ধশত বসত বাড়ি তিস্তাগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়েছে কুটিরপাড়, চন্ডিমারী ও চর গোকুন্ডা গ্রাম। নদীর গতিপথ পরিবর্তন হওয়ায় দিন দিন ঝুঁকিপূর্ণ হচ্ছে জেলার তিনটি স্পার বাঁধ। ভাঙনে ইতোমধ্যে ৫টি উপজেলায় ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। হাতীবান্ধার ৬টি ইউনিয়নে প্রায় দেড় হাজার পরিবার ঘরবাড়ি হারিয়েছেন। আদিতমারী উপজেলার কুটিরপাড় গ্রামে এক রাতেই তিস্তায় বিলীন হয়েছে ৭টি বসতভিটা। গ্রামবাসীর অনেকেই রাতে ঘরবাড়ি সরিয়ে রাস্তায় আশ্রয় নিয়েছেন। জায়গার অভাবে এখনও ঘর উঠাতে পারছেন না অনেকেই।
এলাকাবাসী জানান, গ্রামবাসীকে রক্ষার জন্য প্রায় এক কিলোমিটারের অধিক দীর্ঘ বালুর বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছিল। কিন্তু তা গত বছরই বন্যায় বিলীন হয়ে ভাঙনের কবলে পড়েছে গ্রামটি। পরে জরুরিভাবে পাইলিং বাঁধ দিয়ে কিছুটা রক্ষা করে পানি উন্নয়ন বোর্ড। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর থেকে সদর উপজেলার চর গোকুন্ডা, আদিতমারী উপজেলার বাহাদুরপাড়া, চন্ডিমারী, কুটিরপাড়, কালীগঞ্জের আমিনগঞ্জ, হাতীবান্ধার গড্ডিমারী, ডাউয়াবাড়ি, সির্ন্দুনা ও সানিয়াজানে তিস্তা নদীর ভাঙন তীব্র আকার ধারণ করেছে। ঝুঁকিতে পড়েছে স্পার বাঁধসহ সব বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ।
একই অবস্থা ঘড়িয়ালডাঙ্গা, বুড়িগ্রামহাট, কালীরহাট, গাবুর হেল্লা, মেদনীপুর, বিদ্যানন্দ, উলিপুরের ঠুটাপাইকোর, দলদলিয়া, থেতরাই, নাগরাকুরা, পশ্চিম বজরা, হোকডাঙ্গা, অজুনের পাড়, দাঁড়িয়ার পাড় ও চিলমারী কাশিম বাজার এলাকায়ও। এসব এলাকাতেও ব্যাপক ভাঙন দেখা দিয়েছে। তিস্তা সেতু থেকে চিলমারী পর্যন্ত নদীর তীরবর্তী প্রায় ২০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ভাঙনের শঙ্কায় নদী তীরের মানুষ।
সরেজমিনে দেখা গেছে, সুন্দরগঞ্জ উপজেলার হরিপুর ইউনিয়নে ভিটেমাটি হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছে তিন শতাধিক পরিবার। প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ঘরবাড়ি সরাতে সবাই ব্যস্ত। হুমকিতে আছে বন্যা নিয়ন্ত্রণ ওয়াপদা বাঁধসহ নাজিমাবাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, নাজিমাবাদ বি-এল উচ্চ বিদ্যালয়, নাজিমাবাদ দাখিল মাদরাসা ও কাশিমবাজার বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়সহ বেশকিছু সরকারি স্থাপনা।
একই অবস্থা রংপুরের ৩টি উপজেলার। এসব এলাকার অনেক স্থানেই দেখা দিয়েছে তীব্র ভাঙন। এতে উপজেলার ৭টি ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চলসহ চরাঞ্চলের প্রায় ১০ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়ে। লক্ষীটারী ইউনিয়নের শংকরদহ থেকে বাগেরহাট যাওয়ার সড়কটি তিস্তার পানির তোড়ে ভেঙে যাওয়ায় তিস্তার গতিপথ পরিবর্তন হয়ে গিয়ে শংকরদহ গ্রামটি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়।
ফলে গঙ্গাচড়া শেখ হাসিনা সেতুর নিচ দিয়ে যাওয়া তিস্তার মূল স্রোতধারা গতিপথ পরিবর্তন করে শংকরদহ গ্রামের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া সেখানে একটি শাখা নদী দিয়ে এখন তিস্তার পানি প্রবাহিত হচ্ছে। এতে ওই শাখা নদী মূল নদীতে পরিণত হয়ে পুরো শংকরদহ গ্রামটি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। এছাড়া জয়রাম ওঝা, পূর্ব ইচলী, পশ্চিম ইচলী, ইশোর কোল, এসকেএস বাজারসহ ৭টি গ্রামের প্রায় দেড় হাজার ঘরবাড়ি, গাছপালা, ফসলি জমি নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এছাড়া বিলীন হয়েছে মসজিদ, মাদরাসা, স্কুল, রাস্তা। ভাঙনে মারাত্মক হুমকির মধ্যে পড়েছে শেখ হাসিনা তিস্তা সেতুসহ সংযোগ সড়ক।
এছাড়া কাউনিয়া ও পীরগাছা উপজেলার বেশ কয়েকটি ইউনিয়নেও তিস্তার ভাঙনে ব্যাপক ক্ষতি হয়। তিস্তার ভয়াবহ ভাঙনে ইতোমধ্যে চরগাবুরা গ্রামটি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। মাত্র ৪/৫টি বাড়ি আর একটি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় (তারমধ্যে চরগাবুরা সরঃ প্রাথমিক বিদ্যালয়) নিয়ে আছে ঐ গ্রামটি। তারমধ্যে চরগাবুরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি একেবারেই নদীর তীরে এসে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে চরম হুমকির মধ্যে থাকা এই বিদ্যালয়টি বালুর বস্তা দিয়ে রক্ষার চেষ্টা চলছে। এটি নদীগর্ভে গেলে এই গ্রামে আর কোন পাকা স্থাপনা থাকবে না। এলাকাবাসী একমাত্র এই বিদ্যালয়টি রক্ষায় জরুরী ভিত্তিতে স্থায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
Mohammed kowaj Ali Khan ৭ আগস্ট, ২০২১, ১:৩৫ এএম says : 0
ভারত দায়ী, ভারতকে ..........................
Total Reply(0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন