ভারতের কয়েকটি রাজ্যের বন্যার পানি নামাতে হঠাৎ করে গজলডোবা বাঁধ খুলে দেয়া হয়। ফলে তিস্তা নদীর আশপাশের শত শত গ্রাম অসময়ে বন্যার কবলে পড়ে। পানির তোড়ে গ্রামের পর গ্রাম তালিয়ে যাওয়ায় ডালিয়ায় তিস্তা ব্যারেজের গেইট খুে দেয়া হয়। ফলে উত্তরাঞ্চলের ৮ জেলার বিস্তীর্ণ এলাকা অসময়ে পানিতে ডুবে যায়। অকাল বন্যায় তলিয়ে যায় ধানক্ষেতসহ কৃষকের ফসলি জমি। এতে বন্যায় তিস্তাপাড়ের উত্তরাঞ্চলের ৮ জেলায় কৃষি, মৎস্য, প্রাণীসম্পদ ও অবকাঠামোগত প্রায় ২০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এছাড়া সাড়ে ৬ হাজার ঘর বাড়ি বিলিন হয়েছে। কুড়িগ্রামে ৯টি উপজেলা এবং লালমনিরহাটের ৮টি উপজেলার ২১টি ইউনিয়নের ৩২ হাজার কৃষক পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা উচ্চ পর্যায়ের ও মাঠপর্যায়ে পরিদর্শন করে ক্ষতির পরিমাণ ও তালিকা প্রস্তুত করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে দিয়েছে। কুড়িগ্রাম এবং লালমনিরহাট জেলা প্রশাসন এবং সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর প্রস্তুতকৃত ক্ষতিগ্রস্ত তালিকা থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
গত ১৯ অক্টোবর মঙ্গলবার রাত থেকে উজানে ভারতের পানির তোড়ে তিস্তা ব্যারেজের গেট খুলে দেয়ার কারণে তিস্তা নদীর পানি অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে থাকে। বুধবার সকাল থেকেই তিস্তাপাড়ের জেলা কুড়িগ্রাম. লালমনিহাট, নীলফামারী, রংপুর, গাইবান্ধা জেলা এলাকার চর, দ্বীপচর ও নদী তীরবর্তী গ্রামগুলো পানির নিচে তলিয়ে যায়। শুক্রবার সকাল থেকে দুর্গত এলাকাগুলো থেকে পানি নামতে থাকলে ক্ষতির পরিমাণ দৃশ্যমান হয়। তবে কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাটের ভিতর দিয়ে বয়ে চলা তিস্তা নদীর ভাঙন এখনো অব্যাহত আছে। এই ভাঙন পরিস্থিতি কোথাও কোথাও তীব্র আকার ধারণ করেছে। নদীগর্ভে চলে যাচ্ছে বসতভিটা, আবাদি জমি। অসময়ে বন্যার পর নদী ভাঙনের কবলে পড়ে ভূমিহীন ও নিঃস্ব হয়ে পড়ছে তিস্তাপাড়ের শত শত পরিবার। এদিকে তিস্তা পাড়ের ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক ও অসহায় মানুষ গুলোর পুর্নবাসনের ব্যবস্থা করা হয়নি এখনো। বন্যা মোকাবিলায় কোনো পূর্বস্তুতি না থাকায় অকাল বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছে তিস্তাপাড়ের জেলাগুলো কৃষক ও কৃষি।
কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসক মো. রেজাউল করিম ইনকিলাবকে বলেন, বন্যাদুর্গতদের আপাতত নগদ অর্থ ও খাদ্য সহায়তা দেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতির পরিমাণের তালিকা প্রস্তুত করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে। কিভাবে ক্ষতিগ্রস্তদের পুরবাসন করা হবে তা এখনো নিদেশনা পাইনি।
লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক আবু জাফর ইনকিলাবকে বলেন, তিস্তা ব্যারেজের ফ্লাড বাইপাস সড়ক ভেঙ্গে যাওয়ায় নীলফামারীর সঙ্গেও সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিলো। পানির তোড়ে কাকিনা-মহিপুর সড়ক ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ায় এখনও লালমনিরহাটের সঙ্গে রংপুরের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিলো।
সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতির পরিমাণের তালিকা প্রস্তুত করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে দহগ্রাম, গড্ডিমারী, সানিয়াজান, সিন্দুর্না, ডাউয়াবাড়ী, ভোটমারী, মহিষখোঁচা, গোকুন্ড, খুনিয়াগাছ, রাজপুর, ঘড়িয়ালডাঙ্গা ও উলিপুর উপজেলার থেতরাই, গুনাইগাছ, ও বজরা, চিলমারী, অষ্টমীরচর, মাটিকাটাসহ তিস্তার পাড় ঘেঁষা আরও কয়েকটি ইউনিয়নে ভাঙন তীব্র হয়েছে। ভিটা হারানো মানুষের সংখ্যা বাড়ছে।
কৃষি সম্প্রচারণ অধিদপ্তর জানায়, তিস্তার হঠাৎ বন্যার কারণে ৪ হাজার হেক্টর জমির আমন ধান, ভুট্টা, বাদাম, আলুসহ বিভিন্ন সবজি নষ্ট হওয়ায় ক্ষতি হয়েছে ৬৫ কোটি টাকা। ১ হাজার ৮০০টি পুকুরের মাছ ভেসে যাওয়ায় ক্ষতি হয়েছে ৮ কোটি টাকা। ৩০০টি খামারের মুরগিসহ ৩ হাজার পরিবারের হাঁস-মুরগি পানিতে ভেসে যাওয়ায় ক্ষতি হয়েছে ৭ কোটি টাকা। বিভিন্ন স্থানে কালভার্ট- সেতু, সড়ক ও অবকাঠামো ভেঙে যাওয়ায় ক্ষতি হয়েছে ৮০ কোটি টাকা এবং ১ হাজারের বেশি পরিবারের ঘর-বাড়ি ভেসে যাওয়ায় ক্ষতি হয়েছে ৪০ কোটি টাকা। লালমনিরহাটে আকস্মিক এ বন্যায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে হাতীবান্ধা উপজেলার সানিয়াজান, গড্ডিমারী, সিন্দুর্না, ডাউয়াবাড়ী ইউনিয়ন, পাটগ্রাম উপজেলার দহগ্রাম ইউনিয়ন, কালীগঞ্জ উপজেলার ভোটমারী ও কাকিনা ইউনিয়ন, আদিতমারী উপজেলার মহিষখোঁচা ইউনিয়ন এবং সদর উপজেলার গোকুন্ডা, রাজপুর ও খুসিযাগাছ ইউনিয়ন। পানিতে তলিয়ে ছিল ৫ উপজেলার ২০টি ইউনিয়নের তিস্তাপাড়ের ৯০টি গ্রাম এবং চর ও দ্বীপ চরের ১৫ হাজার একরের বেশি জমির আমন ধান, ভুট্টা, আলু ও বিভিন্ন জাতের শাকসবজি। ভেসে গেছে শতাধিক পুকুরের মাছ।
লালমনিরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মিজানুর রহমান ফোনে ইনকিলাবকে বলেন, বন্যায় সব চেয়ে ক্ষতি হয়েছে আমাদের। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মীরা ভাঙন কবলিত জায়গাগুলো পরিদর্শন করছেন। ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতির পরিমাণের তালিকা প্রস্তুত করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে।
কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার গতিয়াশ্যাম গ্রামের ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক আউয়াল হোসেন জানান, এমনিতে তিস্তা নদীর ভাঙনে তারা নিঃস্ব হয়েছেন। তার ওপর অকালে আকস্মিক বন্যায় তারা সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েছেন। ১০ বিঘা জমির বাদাম ও আলু নষ্ট হওয়ায় তিনি দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। অকাল বন্যা সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারনাই ছিল না। কুড়িগ্রাম জেলার উলিপুর উপজেলার থেতরাই ইউনিয়নের দড়িকিশোরপুর গ্রামের কৃষক আব্দুল মানান জানান, অসময়ে তিস্তার বন্যায় তার ১৫ লাখ টাকা মরিচ আলু ও ধানের ক্ষতি হয়েছে। সমানে কি দিয়ে সংসার চলতে তা নিয়ে ভাবছেন।
লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলার ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক নজীর হোসেন বলেন, আমার ৫ বিঘা জমিতে আমন ধান ও ৩ বিঘা জমিতে ভুট্টা লাগিয়েছিলেন। আকস্মিক বন্যায় জমির সবগুলো ফসল নষ্ট হয়েছে। তার ৬০টি মুরগি ও হাঁস পানিতে ভেসে গেছে। ৪টি ঘরের একটি ঘর ভেসে গেছে পানিতে। এরকম বন্যা আমি দেখিনি। কোনো কিছু বুঝে উঠার আগেই আমাদের সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। এত বেশি ক্ষতি হয়েছে যা ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না। এ ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া খুব কষ্টের।›
লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার দহগ্রামের ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক আমজাদ হোসেন বলেন, সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে দহগ্রামে। ভারত থেকে ছেড়ে দেয়া পানি প্রথমে সরাসরি দহগ্রামে এসে আঘাত হানে। জমির ফসল, ঘর-বাড়ি ও গবাদি পশু-পাখি হারিয়ে আমরা নিঃস্ব হয়েগেছে অনেক মানুষ। এ ক্ষতি কাটিয়ে উঠে ঘুরে দাঁড়ানোর কোনো উপায় নেই।
লালমনিরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক শামিম আশরাফ ইনকিলাবকে জানান, তিস্তার আকস্মিক বন্যায় জমির সবগুলো ফসল নষ্ট হয়েছে। কৃষক পরিবারগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কৃষকের তালিকা ও ক্ষতির পরিমাণ প্রস্তুত করে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের সরকারিভাবে কী ধরনের সহয়তা দেবে, তা এখনও মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়নি।
লালমনিরহাট এলজিইডি›র নির্বাহী প্রকৌশলী আশরাফ আলী খান বলেন, অকালে আকস্মিক বন্যায় সেতু-কালভার্ট ও সড়কের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এসব ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।
লালমনিরহাট সদর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান সুজন বলেন, ভারত থেকে ছেড়ে দেয়া পানির কারণে আকস্মিক ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় তিস্তায়।
হাতীবান্ধা উপজেলার তিস্তাপাড়ের সিন্দুর্না ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুরল ইসলাম জানান, বন্যা মোকাবিলায় কোনো পূর্বস্তুতি না থাকায় অকাল বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছে তিস্তাপাড়ের কৃষক ও কৃষি। বিভিন্ন স্থানে সড়ক ও বাঁধ ভেঙ্গে যাওয়ায় চলাচলের ক্ষেত্রে চরম দুর্ভোগে পড়ছে মানুষ।
রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলায় ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে ক্ষতির মুখে থাকা কৃষকরা দুর্বিষহ জীবন কাটাচ্ছে। এক হাজার ৭১৫ হেক্টর জমির আমন ধান, বাদাম ও মিষ্টি কুমড়া ক্ষেতের ক্ষতি হয়েছে। ভেসে গেছে ১৫ কোটি টাকা পুকুরের মাছ।
গঙ্গাচড়া উপজেলা কৃষি অফিসার শরিফুল ইসলাম জানান, বন্যায় উপজেলায় প্রায় এক হাজার ৬৫০ হেক্টর জমির আম ক্ষেত, ৩০ হেক্টর জমির বাদাম ক্ষেত, ৩৫ হেক্টর জমির মিষ্টি কুমড়া ক্ষেতসহ বিভিন্ন ফসল ও সবজি ক্ষেতের ক্ষতি হয়েছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন