পবিত্র কুরআনুল কারীমে আল্লাহ তা’আলা বলেছেন: হে রাসূল (সা.) আপনি বলুন: যারা জানে আর যারা জানে না তারা কী সমান মর্যাদার? জ্ঞানীরাই কেবল স্মরণ করে। (সূরা যুমার-৯)। অপর আয়াতে আল্লাহ তা’আলা বলেছেন: আল্লাহ তা’আলা মর্যাদার সুউচ্চ আসনে সমাসীন করেন তাদেরকে যারা তোমাদের মধ্যে ঈমান এনেছে এবং যাদেরকে ইলম বা জ্ঞান দেয়া হয়েছে। আর তোমরা যা কিছু করো সে বিষয়ে আল্লাহ সম্যক অবগত। (সূরা মুজাদিলাহ-১১)।
ইলম বলতে কুরআন, হাদীস, ইসলামী শরীআহ ও ফিকহের জ্ঞান বুঝানো হয়েছে। আর এ ইলম অর্জনের চেষ্টাকারীকে বলা হয় ত্বলেবুল ইলম, যার মর্যাদা সম্পর্কে রাসূল (সা.) বলেছেন: ইলম অন্বেষণে যে ব্যক্তি রাস্তা অবলম্বন করে আল্লাহ তা’আলা তার জন্য জান্নাতের একটি রাস্তা খুলে দেন। ইলম অন্বেষণকারীর সন্তুষ্টি বিধানে ফেরেস্তারা তাদের ডানা বিছিয়ে দেন। আসমানের ও যমীনের অধিবাসীরা আলিমের জন্য মাগফিরাত কামনা করতে থাকেন। এমন কি পানির ভিতরে অবস্থানকারী মতসরাজীও মাগফিরাত কামনা করতে থাকেন। একজন আলিম মর্যাদায় একজন আবেদের চেয়ে এ পরিমাণ শ্রেষ্ঠ যেমন পূর্ণিমার রাতের চাঁদের শ্রেষ্ঠত্ব সকল নক্ষত্ররাজীর উপর।(আবূদ দারদা রা. থেকে বর্ণিত। সহীহ মুসলিম, সুনানু আবি দাউদ, মুস্তাদরাক লিল হাকেম, সহীহ ইবনু হিব্বান)।
আলিমগণের এ মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব আল্লাহ প্রদত্ত। আল্লাহ তা’আলার ফেরেস্তাগণ, জ্বীন ও মানুষ, পশু-পাখি, জীব-জন্তু, জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদরাজী সবাই ব্যস্ত একজন আলিমে দ্বীনের সন্তুষ্টি বিধানে। স্বয়ং সৃষ্টিজগতের রব রহমতের বারীতে সিক্ত করেন আলিমে দ্বীনকে। একজন আবেদের সারাজীবনের রাত্রি জাগরণের ইবাদত দ্বারা এ মর্যাদা অর্জন সম্ভব নয়। আর একজন মূর্খের সাথে একজন আলিমের কোন তুলনাই চলে না। কারণ আলিমগণই আল্লাহ তা’আলা সম্পর্কে অধিক জ্ঞাত, রাসূলগণের অবর্তমানে আল্লাহ তা’আলার ঐশী বাণীর ধারক ও বাহক, রাসূলগণের ইলমুন নবুওয়তের উত্তরাধিকারী, নবুয়ত ও রেসালাতের মুবাল্লিগ, আল্লাহর কালামের ও রাসূল (সা.) এর বাণীর ব্যাখ্যাকার ও ভাষ্যকার।
মুয়াবিয়া (রা.) থেকে বর্ণিত রাসূল (সা.) বলেছেন: আল্লাহ তা’আলা যখন কারো কল্যাণ চান তখন তাকে দ্বীনের সঠিক জ্ঞান-প্রজ্ঞা দান করেন। আমি ইলমের বন্টনকারী এবং আল্লাহ তা’আলা ইলম দাতা। এই উম্মত যতদিন আল্লাহর বিধানের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে তাদের বিরোধিতাকারীগণ তাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না এ পর্যন্ত যে, আল্লাহর নির্দেশ এসে যাবে অর্থাৎ কিয়ামত সংগঠিত হয়ে যাবে। (সহীহুল বুখারী-৭১)।
আবূদ দারদা (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন আমি রাসূল (সা.)কে বলতে শুনেছি: নিশ্চয়ই আলিমগণ নবীগণের ওয়ারিস বা উত্তরাধিকারী। তাঁরা দিরহাম বা দিনারের ওয়ারিস নন, তাঁরা হলেন ইলম বা জ্ঞানের ওয়ারিস। সুতরাং যিনি এটি গ্রহণ করবেন তিনি সম্পূর্ণ অংশই গ্রহণ করবেন। (সুনানুত-তিরমিযী)। হাদীসে স্পষ্টতই আলিমগণকে নবীগণের ওয়ারিস হিসেবে গণ্য করা হয়েছে এবং তাঁরা পার্থিব কোন সম্পদের ওয়ারিস নন, বরং তাঁরা হলেন ইলমুন নুবওয়তের ওয়ারিস বা উত্তরাধিকারী। আল্লাহ তা’আলা বলেন: অত:পর আমার বান্দাহদের মধ্য থেকে পছন্দিত ও মনোনিতদেরকে উত্তরাধিকারী করেছি কিতাবের। (সূরা ফাতির-৩২)। এ আয়াতের ব্যাখ্যায় উপরোক্ত হাদীস উল্লেখ করা হয়েছে। হাদীসে উল্লেখিত ওয়ারাসাত বা উত্তরাধিকারী স্বত্ব বলে দু’টো বিষয় আলিমগণ উল্লেখ করেছেন:
এক. আলিমগণের উপর ওয়াজিব দায়িত্ব হলো দ্বীনের তাবলীগ ও প্রচার করা যাতে সকল দ্বীনের উপর ইসলাম বিজয়ী হতে পারে।
দুই. ইলম অন্বেষণকারীর উপর ওয়াজিব হলো আলিমগণের কথা মনযোগ দিয়ে শুনা এবং তাঁদেরকে সম্মান করা কেননা তাঁরা ওয়ারাসাতুল আন্বিয়া।
প্রথম বিষয়টি দ্বিতীয়টির কারণ বলে গণ্য। আলিমগণের কথা শুনা এবং তাঁদেরকে সম্মান করতে হবে কারণ তাঁরাই রাসূল (সা.) এর সুন্নাহর পুনর্জীবন দানকারী এবং তাঁর শরীআতের প্রতিষ্ঠা দানকারী। যদি তাঁদের দ্বারা এতদুভয়ের কোনটিই না ঘটে তাহলে আলিমগণের কথা শুনা এবং তাঁদের সম্মানের প্রশ্ন অবান্তর। (ইবনু বাত্তাল, শারহু সহীহিল বুখারী)।
আলিমগণ কুরআন, হাদীস, ইসলামী শরীআহ ও ফিকহের জ্ঞানের মাধ্যমে সমাজ, জাতি ও দেশকে সঠিক দিকনির্দেশনা প্রদান করে থাকেন। তাঁদের মৃত্যু সমাজের জন্য মুসিবত ও বড় ধরনের ক্ষতির কারণ। একজন প্রাজ্ঞ আলিমের মৃত্যু ওহীর জ্ঞানের ক্রমহ্রাসমান বিলুপ্তি ঘটায় যা বিশ্ব ব্যবস্থায় অনেক সময় বিপর্যয় ডেকে নিয়ে আসে। আলিমগণ তাঁদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে পিছপা হন না, কারণ তাঁদের এ দায়িত্ব সম্পর্কে তাঁরা জিজ্ঞাসিত হবেন শুধু তাই নয়, কঠোর শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে। রাসূল (সা.) সতর্ক করে বলেছেন: যে ব্যক্তি কোন বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবে যার ইলম তাঁর কাছে রয়েছে সে যদি তা গোপন করে কিয়ামতের দিন তাকে দোযখের বেড়ী পড়ানো হবে। রাসূল (সা.) বিদায় হাজ্জের ভাষণে এ গুরু দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন এ বলে: আমার পক্ষ হতে এক আয়াত পরিমাণ হলেও সেটা মানুষের নিকট পৌছাবে। আলিমগণ এ মিরাসী স্বত্বকে ধারণ করে পথ চলছেন এবং সে পথ চলা কন্টাকাকীর্ণ, ফুল বিছানো নয়। যাদের কাছে রাসূল (সা.) এর আদর্শ জীবনের চেয়েও মহামূল্যবান।
এখানে প্রণিধানযোগ্য দ্বীনের ইলম ও নেতৃত্বদানকারীদের কতিপয় কুরবানী যা এ পৃথিবী প্রত্যক্ষ করেছে:
১. ইমাম আবূ হানিফা (রহ.) খলিফা আল মানসূরের প্রধান বিচারপতির পদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন এই বলে যে, বিচারক হওয়ার জন্য এমন লোক প্রয়োজন যিনি আপনার, আপনার সন্তান ও আপনার সৈন্যবাহিনীর বিপক্ষে ফয়সালা দিতে সক্ষম। এর জন্য ইমাম আবূ হানিফা (রহ.)কে শাস্তির সম্মুখীন হতে হয়েছিল। (চলবে)
লেখক : অধ্যাপক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন