শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ধর্ম দর্শন

শারাবান ত্বাহুরা : জান্নাতের অমিয় সুধা

মোঃ আবদুল গনী শিব্বীর | প্রকাশের সময় : ১২ আগস্ট, ২০২১, ১২:০৬ এএম

জান্নাত পরম সুখের জায়গা। সেখানে কেবল অনাবীল শান্তি আর শান্তি। প্রেম সোহাগ আর ভালোবাসায় ভরপুর সেখানকার সকল বাসিন্দাদের হৃদয়। হাসি খুশি আর পরম আনন্দে কাটবে জান্নাতিদের জীবন। এ জীবনের শুরু আছে তবে শেষ নেই। জান্নাতিগণ যখন যা চাইবে তৎক্ষনাৎ তা হাজির হয়ে যাবে। হৃদয়ের সুখানুভুতির চুড়ান্ত স্বাদ কেবল জান্নাতে রয়েছে। জান্নাতিগণ সকল প্রকারের সুখ ভোগ করবে। সকল প্রকার সুস্বাদু খাবারের স্বাদ আস্বাদন করবে। সকাল প্রকার অমীয় সুধা, উদ্দীপনা ও কামনা সৃষ্টিকারী তৃপ্তিকর পানীয় তারা পান করবে। জান্নাতীগণ হাশরের মাঠে ‘কাওসারের পানি’ পান করার মধ্য দিয়ে তাদের ধন্য জীবনের শুভ সুচনা করবে। জান্নাতে প্রবেশের পূর্বে ‘শারাবান ত্বাহুরা’ পানে সৌভাগ্য লাভ করবে।

জান্নাতের খাবার ও পানীয় সম্পর্কে পবিত্র কুরআন ও হাদীস শরীফঃ
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পবিত্র কুরআন মাজীদে জান্নাতিদের আয়েশী জীবনের প্রসঙ্গে ইরশাদ করেন, ‘এবং তাদের সবরের প্রতিদানে তাদেরকে দিবেন জান্নাত ও রেশমী পোশাক। তারা সেখানে সিংহাসনে হেলান দিয়ে বসবে। সেখানে রৌদ্র ও শৈত্য অনুভব করবে না। তার বৃক্ষছায়া তাদের উপর ঝুঁকে থাকবে এবং তার ফলসমূহ তাদের আয়ত্তাধীন রাখা হবে। তাদেরকে পরিবেশন করা হবে রূপার পাত্রে এবং স্ফটিকের মত পানপাত্রে। রূপালী স্ফটিক পাত্রে, পরিবেশনকারীরা তা পরিমাপ করে পূর্ণ করবে। তাদেরকে সেখানে পান করানো হবে ‘যানজাবীল’ মিশ্রিত পানপাত্র। এটা জান্নাতস্থিত ‘সালসাবীল’ নামক একটি ঝরণা। তাদের কাছে ঘোরাফেরা করবে চির কিশোরগণ। আপনি তাদেরকে দেখে মনে করবেন যেন বিক্ষিপ্ত মনি-মুক্তা। আপনি যখন সেখানে দেখবেন, তখন নেয়ামতরাজি ও বিশাল রাজ্য দেখতে পাবেন। তাদের আবরণ হবে চিকন সবুজ রেশম ও মোটা সবুজ রেশম এবং তাদেরকে পরিধান করোনো হবে রৌপ্য নির্মিত কংকণ এবং তাদের পালনকর্তা তাদেরকে পান করাবেন ‘শারাবান ত¦াহুরা’। এটা তোমাদের প্রতিদান। তোমাদের প্রচেষ্টা স্বীকৃতি লাভ করেছে। (সুরা ইনসান: আয়াত: ১২-২২)।
আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্নিত। নবী সালাøল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আল্লাহ তাআলা বলেছেন, আমি আমার নেক বান্দাদের জন্য এমন সব জিনিস প্রস্তুত রেখেছি যা কখনো কোন চক্ষু দেখেনি, কোন কান শুনেনি এবং কোন অন্তঃকরণ কখনো কল্পনাও করেনি। আল-কুরআনে এর সত্যায়ন রয়েছে ্রকেউ জানে না তাদের জন্য নয়ন প্রীতিকর কী লুকায়িত রাখা হয়েছে তাদের কৃতকর্মের পুরস্কার স্বরূপ।গ্ধ (সূরা সাজদাঃ ১৭)। (সহীহ মুসলিম: হাদিস: ৬৮৭১)।

শারাবান ত্বাহুরার পরিচয়ঃ
‘শারাবান ত্বাহুরা’ জান্নাতবাসিদের বিশেষ পানীয়। এ পানীয় জান্নাতিদের প্রতি মহান আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ, মূল্যবান প্রতিদান। জান্নাতবাসীগণ জান্নাতে নিজেদের ইচ্ছানুসারে খাবে পান করবে। জান্নাতবাসীগণ জান্নাতে প্রবেশ কালে জান্নাতের প্রবেশ মুখে তাদের জন্য সর্বপ্রথম পানীয় হিসেবে যে পানীয় দেয়া হবে সে পানীয়ই হলো ‘শারাবান ত্বাহুরা’। আলী (রা.) বলেন, ‘জান্নাতবাসীগণ জান্নাতে প্রবেশের প্রাক্কালে দেখতে পাবে জান্নাতের প্রবেশ মুখে একটি সুন্দর বৃক্ষ, উক্ত বৃক্ষের নিচ থেকে দুটি ঝর্ণা প্রবাহমান রয়েছে। ঝর্ণা দুটির প্রথমটি থেকে যখন তারা পানি পান করবে তখন তাদের মনে পরম আনন্দের দোলা পরিলক্ষিত হবে। তাঁেদর পরম আনন্দে আর কখনো পরিবর্তন হবেনা, তাদের সুখে কখনো বিন্দু পরিমান ঘাটতি হবেনা। প্রথম নহরের পানি পানে জান্নাতিগণ ‘নদরাতুন নাঈম’ নামক নেয়ামত লাভে ধন্য হবে। এরপর তারা দ্বিতীয় ঝর্ণা থেকে পানি পান করবে, এ পানি পান করার সাথে সাথে তাদের অন্তর পবিত্র হয়ে যাবে। তাদের অন্তরে কোন হিংসা বিদ্ধেষ, জিঘাংসা, কুটিলতা, প্রতিশোধ পরায়নতা ইত্যাদি বদ স্বভাব থাকবে না। এমনকি এ পানি পানের সাথে সাথে তাদের পেট এতই বিশুদ্ধ হয়ে যাবে যে, চির দিনের জন্য পায়খানা ও পেশাবের আর প্রয়োজন হবে না। জান্নাতীগণ জান্নাতের খাবার শেষে যখন ‘শারাবান ত্বাহুরা’ পান করবেন তখন তাদেও খাবার হজম হয়ে দেহে একপ্রকার ঘাম দিবে যেটি খুবই সুঘ্রাণ।’ (তাফসীরে কুরতুবী)। এ প্রসঙ্গ পবিত্র হাদিসে বর্ণিত রয়েছে, জাবির ইবনু আবদুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ সালাøল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘জান্নাতী লোকেরা সেখানে পানাহার করবে। তবে তারা পায়খানা করবে না এবং নাকও ঝাড়বেনা, পেশাবও করবে না। তাদের (ঐ) খাদ্য (নিঃশেষ হয়ে যাবে) মিশকের সুঘ্রান বিচ্ছুরণের ন্যায় ঢেকুর (দ্বারা)। (সহীহ মুসলিম: হাদিস: ৬৮৯১)। তাদের জন্য ‘শারাবান ত্বহুরা’ ব্যতিত আরো পানীয় রয়েছে, এ সম্পর্কে আল্লাহপাক ইরশাদ করেন, ‘পরহেযগারদেরকে যে জান্নাতের ওয়াদা দেয়া হয়েছে, তার অবস্থা নিম্নরূপঃ তাতে আছে পানির নহর, নির্মল দুধের নহর যারা স্বাদ অপরিবর্তনীয়, পানকারীদের জন্যে সুস্বাদু শরাবের নহর এবং পরিশোধিত মধুর নহর। তথায় তাদের জন্যে আছে রকমারি ফল-মূল ও তাদের পালনকর্তার ক্ষমা। (সুরা মুহাম্মদ: আয়াত: ১৫)।

শারাবান ত্বাহুরার বৈশিষ্ট্যঃ
মুফাসসিরগণের মতে, সকল জান্নাতী বিভিন্ন পানীয় পান করবেন, আল্লাহপাক তাদেরকে ‘বিশেষ পানীয়’ পান করাবেন। এ পানীয়টি হলো ‘শারাবান ত্বাহুরা’। এ পানীয়ের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে তারা বলেন, জান্নাতের খাবার খেয়ে জান্নাতীগণ তৃপ্তি লাভ করবেন, তৃপ্তিকে আরো পরিপূর্ণতা দিতে রাব্বুল আলামীন তাদের জন্য সকল শ্রেষ্ঠ উপাদানের সমন্বয়ে বিশেষ পানীয় ‘শারাবান ত্বাহুরা’ এর ব্যবস্থা রেখেছেন। জান্নাতীগণ যখন এ পানীয় পান করবেন তখন তাদের অন্তর সতেজ হয়ে উঠবে, দেহের শক্তিমত্তা বহুগুন বৃদ্ধি পাবে, দেহ থেকে নির্গত ঘাম থেকে মেশকের চাইতেও বেশি সুঘ্রাণ বের হবে। ইমাম বাকের (রহ.) বলেন, আল্লাহপাক ‘শারাবান ত¦াহুরা’ পান করিয়ে জান্নাতিদের কলব তথা অন্তরকে পরিশুদ্ধ করবেন। অর্থ্যাৎ এ পানি যারা পান করবে তাদের অন্তরে কোন হিংসা, বিদ্বেষ থাকবে না।

মুহাক্কিক ওলামায়ে কেরাম বলেন, জান্নাতের সকল পানীয়ের সমম্বয়ে প্রস্তুতকৃত বিশেষ পানীয় কে ‘শারাবান ত্বাহুরা’ বলা হয়। যেমন একটা পানীয় হলো ‘রাহিকুম মাখতুম’ আরেকটি হলো ‘তাসনীম’ নামক পানীয়। জান্নাতের স্বাভাবিক পানির কথা পবিত্র কুরআনে ‘মাউম মুছাফ্ফা’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে।
জান্নাতীগণ যেসব পানীয় পান করবেঃ
১. সালসাবীল নামক পানীয়ঃ জান্নাবাসীগণ সালসাবীল নামক পানীয় পান করবে। এ পানির বৈশিষ্ট্য হলো ইহা একেবারে স্বচ্ছ, সুমিষ্ট ও শীতল। জান্নাতবাসীগণ এ পানি পান করার সময় গলনালিতে মিষ্টতা অনুভব করবে। এ পানি যখন পেটে গিয়ে পৌঁছবে তখন নিদারুন স্বাদ আস্বাদন করবে। মুফাসসিরগণ বলেন, সালসাবীল নামক এ সুপেয় পানির উৎস হলো ‘জান্নাতুল আদন’। এ পানি জান্নাতের সকল স্তরে পাওয়া যায় বিধায় এ পানিকে সালসাবীল বলা হয়।

২. কাফুর মিশ্রিত পানীয়ঃ পবিত্র কোরআন মাজীদে বর্ণিত ‘আবরার’ খ্যাতি লাভ কারী পূণ্যবান জান্নাতীদের জন্য বিশেষায়ীত পানীয় হলো কাফুর মিশ্রিত পানীয়। এ পানির বৈশিষ্ট্য হলো ইহা অত্যন্ত সুগন্ধযুক্ত। মুফাসসিরদের মতে, এ পানির গুনাগুণ বর্ণনাতীত। এ পানি পানের পর জান্নাতীদের মুখ থেকে এমন এক ধরণের সুঘ্রাণ ছড়াবে যাতে অপরাপর জান্নাতীগণ বিমোহিত হয়ে যাবে। এ ধরণের আবহ সকল নেককার জান্নাতীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে।

৩. তাসনীম নামক পানীয়ঃ তাসনীম হলো জান্নাতের একটি বিখ্যাত ঝর্ণা। আরশে পাক থেকে উৎসারিত এ ঝর্ণার পানীয়কে ‘তাসনীম’ হিসেবে পবিত্র কোরআন বর্ণনা করেছে। এ ঝর্ণার পানির বৈশিষ্ট্য হলো জান্নাতের অন্য সকল ঝর্ণার পানির চাইতেও শ্রেষ্ঠতর। এ পানি পানের সৌভাগ্যবান কেবলমাত্র ‘মুর্কারাবিন’ খ্যাত বান্দাহগণ। যে সকল বান্দাহ নেক আমল করার মধ্য দিয়ে আল্লাহ পাকের নৈকট্য লাভ করেছেন তাদেরকে মুকাররাবিন বলা হয়।
৪. খামর নামক পানীয়ঃ জান্নাতবাসীদের জন্য আল্লাহপাক ‘খামর’ নামক বিশেষ পানীয়ের ব্যবস্থা রেখেছেন। দুনিয়াবী খামর এর মধ্যে নেশার প্রভাব বিদ্যমান। খামর পানকারী ব্যক্তি নেশার প্রভাবে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে, ভালো মন্দ কোনটিই বুঝতে পারে না। জান্নাতের ‘খামর’ বৈশিষ্ট্য হলো এ পানীয় অত্যন্ত সুস্বাদু ও রুচিকর। জান্নাতীদের চির যৌবনের সজিবতা উত্তোরোত্তর বৃদ্ধি করবে এ বিশেষ পানীয়। এ পানীয়তে মস্তিষ্ক বিকৃতি কিংবা জ্ঞান বিলোপ হবে না। বরং এর প্রভাবে সকলের জন্য নির্ধারিত জান্নাতি স্ত্রীদের প্রতি অগাধ ভালোবাসার আসক্তি বৃদ্ধি পাবে।

৫. যানযীল নামক পানীয়ঃ জান্নাতবাসী মুত্তাকীদের জন্য আল্লাহপাকের পক্ষ থেকে বিশেষ পানীয় হলো ‘যানযীল’। ‘যানযীল’ নামক পানীয় টি বিভিন্ন উপকারী উপাদেয় উপাদানে ভরপুর। আল্লাহ রাব্বুল এ পানীয়ের মাধ্যমে জান্নাতীদেরকে সম্মানিত করবেন। উল্লেখ্য যে, আরবী শব্দ ‘যানযীল’ দ্বারা ‘আদা’ নামক মসলাকে বুঝায়। আদার মধ্যে বিরাট ঔষধিগুণ রয়েছে। আদার রস বিভিন্ন দুরারোগ্য বাধ্যিতে ব্যবহার করা হয়। আদার রস নিষিক্ত বিশেষ পানি অনেক রোগ জীবাণু বিদুরিত করে, রোগীকে রোগমুক্ত করে, রোগীর দেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।

৬. দুধঃ দুধ অত্যন্ত পুষ্টিকর খাদ্য ও পানীয়। মানবজাতীর প্রতিটি মানুষই প্রথম খাবার ও পানীয় হিসেবে দুধকেই গ্রহন করে। মায়ের দুধ কেবল সন্তানের জন্য খাদ্য ও পানীয়ই নয় রবং এটি একপ্রকার মহৌষোধ। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন জান্নাতবাসীদের জন্য দুধের নহর এর ব্যবস্থা রেখেছেন। প্রত্যেক জান্নাতি নিজ নিজ প্রয়োজন অনুসারে দুধ পান করবে।

৭. মধুঃ মধু আল্লাহপাকের মহা নেয়ামত। প্রাকৃতিক গুনাগুন সম্পন্ন ঔষধি খাবার হলো মধু। মধু মানব দেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরী করে। মহান আল্লাহপাক সকল জান্নাতির জন্য বিশুদ্ধ ও সর্বেৎকৃষ্ট মধুর নহরের ব্যবস্থা রেখেছেন। সকল জান্নাতি প্রয়োজন মাফিক মধু সেবন করবে। নেককার বান্দাহদের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে মধুপান করানো উত্তম মেহমানদারীর শ্রেষ্ঠ নমুনা।

পরিশেষে, আল্লাহপাক আমাদের সকলকে তাঁর প্রকৃত বান্দাহ হিসেবে কবুল করুন। আমলের মাধ্যমে তারঁ সন্তুষ্টি ও নৈকট্য হাসিল করে জান্নাতে তাঁর মেহমান হয়ে জান্নাতের অমিয় সূধা, সকল প্রকার নেয়ামত ভোগ করার তাওফিক দান করুন। আমীন।

লেখকঃ মুহাদ্দিস, নোয়াখালী কারামাতিয়া কামিল মাদরাসা, সোনাপুর, নোয়াখালী।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন