এখন বিশ্ব রাজনীতির সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে চলেছে আফগানিস্তানে। বিশ্বের সবচাইতে শক্তিশালী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের সাম্রাজ্যবাদী শাসনের অবসান ঘটিয়ে রাজনৈতিক বিবেচনায় গুরুত্বপূর্ণ এই দেশটিতে তালেবান তার শাসন কায়েম করতে সক্ষমতা দেখিয়েছে। অন্য কথায় বলা যায়, আফগানিস্তানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদী শাসনের অবসান ঘটিয়ে নিজস্ব শাসন কায়েম করতে সক্ষম হয়েছে।
এ ঘটনার প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে পৃথিবীজুড়ে। এর সাথে অনেক অন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ তুলনা করেছেন ভিয়েতনামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যর্থতার। তারা বলতে চেয়েছেন, আফগানিস্তানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরাজয়কে বলা যেতে পারে দ্বিতীয় ভিয়েতনাম।
আফগানিস্তান পরিস্থিতির সঠিক বিশ্লেষণ এবং সে দেশের সর্বশেষ ঘটনা থেকে বাংলাদেশের শিক্ষা গ্রহণের আন্তরিক প্রয়াসের গুরুত্ব অত্যধিক। কারণ প্রথমত, দু’টি দেশই মুসলিম অধ্যুষিত। দ্বিতীয়ত, দু’টি দেশের প্রতিবেশীদের মধ্যে রয়েছে অমুসলিম দেশ। সে ক্ষেত্রে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে সুসম্পর্ক করাও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার নিরিখে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এসব বিষয় বিবেচনায় এনে পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণের গুরুত্ব কতটা বেশি তা নিশ্চয়ই কোনো আন্তর্জাতিক নীতিবিশেষজ্ঞকে নতুন করে বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না। এ ব্যাপারে আফগনিস্তানে তালেবান কর্তৃপক্ষকে যে অতি মাত্রায় সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে, তা বলাই বাহুল্য। আফগানিস্তানের ক্ষেত্রে একটা বাড়তি সমস্যা হলো, আফগানিস্তান মুসলিম অধ্যুষিত রাষ্ট্র হলেও তার অন্যতম প্রতিবেশী ইরানের সঙ্গে তার একটা পার্থক্য রয়েছে। তারপরও পাকিস্তান, তুরস্ক প্রভৃতি মুসলিম রাষ্ট্রের মতো ইরানও আফগানিস্তানের পরিণতিকে স্বাগত জানিয়েছে। এটা যে আধুনিক ইরানের প্রতিষ্ঠাতা আয়াতুল্লাহ খোমেনীর নীতির অনুসরণ, তাতে সন্দেহ নেই। ইমাম আয়াতুল্লাহ খোমেনী দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলে গেছেন, মুসলিম মিল্লাতকে উন্নতির দিকে এগিয়ে নিতে হলে যে কোনো মূল্যে তাদের শিয়া-সুন্নির ছোটখাটো পার্থক্য ও বিরোধিতার ঊর্ধ্বে উঠতে হবে। তিনি যতদিন জীবিত ও সুস্থ ছিলেন, ততদিন এই উদার নীতিকে কঠোরভাবে অনুসরণ করে গেছেন।
ইসলামী রাষ্ট্রনীতিতে প্রতিবেশী সে মুসলিম হোক বা অমুসলিম হোক, তাদের সাথে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করাও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। কারণ, ইসলাম সব সময় প্রতিবেশীদের সাথে সুসম্পর্ক রক্ষা করাকে অতিশয় গুরুত্ব দিয়ে এসেছে। এই নীতির আলোকে বিশ্বনবী (সা.) মদিনায় হিজরতের পর সেখানকার ইহুদিদের সাথে সুসম্পর্ক করার ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করতেন। দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর ফারুকের (রা.) খিলাফত আমলের একটি ঘটনাও এ ব্যাপারে বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমরের (রা.) আমলে একপর্যায়ে হযরত আমর ইবনুল আস (রা.) মিসরের গভর্নর নিযুক্ত হন। তাঁর গভর্নর থাকাকালে মিসরের এক অমুসলিম ছেলেকে আমর ইবনুল আসের সন্তান অন্যায়ভাবে চপেটাঘাত করে। এই চপেটাঘাতের বিচার চেয়ে নালিশ দেয় সেই অমুসলিম ছেলে। কিন্তু সে বিচার হয়নি।
এই বিচার না হওয়ার বিষয়টা খলিফা হযরত উমর ফারুকের (রা.) কানে আসে। তিনি এতে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হন এবং সংশ্লিষ্ট সবাইকে মদিনায় হাজির হতে হুকুম দেন। সকলে মদিনায় এলে অমুসলিম ছেলের কাছে আদ্যোপান্ত ঘটনা শোনার পর অমুসলিম ছেলেকে হুকুম দেন, আমার সামনে তুমি গভর্নর নন্দনকে সেইভাবে চপেটাঘাত করবে, যেভাবে সে তোমাকে চপেটাঘাত করেছে। এই সঙ্গে তিনি মিসরের গভর্নর আমর ইবনুলকে বলেন, তোমরা আর কতদিন ইসলামের সুবিচারের নীতিকে পদলিত করে যাবে?
আমরা এখনও জানি না, আফগানিস্তানে যে সরকার কায়েম হতে চলেছে, সে কি খোলাফায়ে রাশেদার আমলের ইসলামের আদি উদার সুবিচারের নীতি প্রতিষ্ঠা করবে, না আজকের বিশ্বের বহু মুসলিম নামধারী রাষ্ট্রের মতো শুধু নামেই হবে ইসলামী রাষ্ট্র? শেষোক্তটা যদি হয়, তাহলে তা হবে অন্যান্য রাষ্ট্রের মতো নামেই ইসলামী রাষ্ট্র; তার মধ্যে প্রকৃত ইসলামী রাষ্ট্রের মতো ইসলামের উদার, সাম্য-ভ্রাতৃত্বের মহান আদর্শের প্রতিফলন হবে না।
আমরা চাই না, পৃথিবীতে নতুন করে চরমপন্থি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হোক। আমরা চাই, খোলাফায়ে রাশেদার যুগের মতাদর্শের আলোকে প্রকৃত ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হোক, যেখানে ইসলামের মহান উদার সাম্য-ভ্রাতৃত্বের আদর্শ অনুসৃত হবে।
আমরা সেই অনাগত দিনের জন্যই অপেক্ষায় থাকব, যেদিন আমরা আফগানিস্তানসহ সমগ্র মুসলিম বিশ্বে এমন রাষ্ট্রব্যবস্থা দেখবো, যেখানে ইসলামের নীতি-আদর্শ অনুযায়ী সব কিছু চলবে। সকলের আধ্যাত্মিক ও মানবিক বিকাশ নিশ্চিত হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন