পূর্ব প্রকাশিতের পর
আমার খুব হাসি পেয়েছিলো সেদিন যেদিন দেখলাম আমারই এক ক্লাসমেট যিনি খুব নিচু নং পেয়ে কেন্দ্রীয় পরীক্ষায়ে ফেল করেছেন তাকে বানানো হয়েছে একটা ছাত্র সংগঠনের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক। আমি ছাত্র রাজনীতির একেবারে বিপক্ষে ছিলাম- তা ঠিক নয়, বরং ছাত্র রাজনীতিতে এই ধরণের দৈন্যতার বিপক্ষে তখনো ছিলাম এখনো আছি। যে ছাত্রটা পরীক্ষায় পাশ করতে পারে না, ভালো করে বাংলা লিখতে পারে না, আরবি জানে না, ইংরেজী জানে না তাকে দেওয়া হয়েছে একটা বড় সংগঠনের জাতীয় দায়িত্ব। এটা একটা রাজনীতি ও জাতির পংগুত্বের লক্ষণ। যে রাজনীতিতে নেতৃত্ব বাছাইয়ের ক্ষেত্রে বুদ্ধি, শিক্ষা, অভিজ্ঞতা ও মেধার চেয়ে চিরাচরিত রীতিবদ্ধতা, আনুষ্ঠানিকতা ও অন্ধ আনুগত্যকে বেশী গুরুত্ব দেওয়া হয় সে রাজনীতি কোনদিন কল্যান বয়ে আনে না। কারণ আদর্শ মানে পুরানোকে অন্ধভাবে মানা নয়, আদর্শ মানে নতুনকে নতুন রেখেই পুরানোর স্পিরিট অনুযায়ী চলা ও চালানো। যা হোক- ফখরুদ্দীন হুজুরও কোন রাজনীতির সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন না, কিন্তু তিনি রাজনীতি ও ছাত্র রাজনীতি সম্পর্কে এমনই ভাবতেন। তাঁর একটা ছোট্ট রেডিও ছিলো। তিনি রেডিওতে খবর শুনতেন। নিয়মিত পত্রিকা পড়তেন এবং রাজনীতির অত্যন্ত খুটিনাটি বিষয়েও খোঁজ-খবর রাখতেন।
এভাবেই, ফখরুদ্দীন হুজুরের সান্নিধ্যের মজা পেয়ে গেলাম। বিকেল বেলায় ছাত্ররা যখন বাজার-ঘাটে, রেস্তোরাতে আর খেলার মাঠে সময় কাটাতো, আমরা কয়েকজন তখন হুজুরের সান্নিধ্যেই কাটানো শুরু করলাম। তবে, এক্ষেত্রে আমাদের কয়েকজনের মধ্যে বেশ প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেলো। সিলেটের বিশ্বনাথের ছাত্র আযীযুদ্দীন শামীম এ ব্যাপারে এগিয়ে ছিলো। সেও প্রায়ই আমাদের আগেই হুজুযের দরবারে গিয়ে হাযির হতো। আমরা মাগরিবের আগেই চলে আসতাম হলে।
হুজুর প্রথম বছরে আমাদেরকে বুখারী প্রথম খন্ড পড়াতেন। তবে, সাথে সাথে বুখারী দ্বিতীয় খন্ডও নিয়ে যেতে হত। কারণ তিনি সব হাদীসের সনদের রেফারেন্স দিতেন। এক হাদীসের সমার্থক রেওয়ায়েত আর কোথায় আছে তা তিনি পাতা খুলে খুলে বিশ্লেষণ করতেন। আমি হাদীসের অনেক আলোচনা শুনেছি, মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ে হাদীস শাস্ত্রে পিএইচডি ধারী শিক্ষকদের কাছে হাদীস পড়েছি। কিন্তু শায়খ ফখরুদ্দীন (র) যেভাবে হাদীসের সনদের ও মতনের গভীরে গিয়ে বিশ্লেষণ করতেন তার তুলনা হয় না। দুই ঘন্টার ক্লাসে মাঝে মাঝে একটা হাদীসও পড়ে শেষ করা যেত না। তিনি একটা চুম্বকের মত আকর্ষন দিয়ে পড়াতেন। লম্বা লেসনেও কোন বিরক্তি আসতো না। মনে হতো যা পড়াচ্ছেন তা আমাদের মাথায় ও বুকে গেথে যেত। শায়খের উপস্থাপনা ছিলো খুবই প্রাণভরা। মনে হতো আমাদেরকে পড়িয়েও তিনি নিজেও খুব মজা পাচ্ছেন। যারা মনে করেন আলিয়া মাদ্রাসায় পড়াশুনা হয় না তারা যদি শায়খের হাদীসের দারসে বসতেন তাহলে বুঝতেন কতো গভীরতা দিয়ে তিনি একেকটা লেসন তৈরী করে আসতেন। একেকটা দারসের জন্যে তিনি নিজে কয়েক ঘন্টা পড়াশুনা করে আসতেন এবং আমাদেরকেও পড়ে আসার উৎসাহ দিতেন।
একদিন সকালে ক্লাসে এসে হাসতে হাসতে বলেছিলেন- তুমি আমার সারা রাতের ঘুম হারাম করে দিয়েছো। আমি তো অবাক। আমি কিভাবে উনার রাতের ঘুম হারাম করলাম? আমি অবাকের সুরেই বললাম- হুজুর, কিভাবে? আমি তো বুঝতে পারছি না। তখন তিনি আমাকে মনে করিয়ে দিলেন গতকালের ক্লাসে এক নবীর স্ত্রীর নামের বানানের ব্যাপারে আমি উনার সাথে দ্বিমত করেছিলাম। আমি একটা অক্ষরে যের দিয়ে পড়েছিলাম আর উনি পড়েছিলেন যবর দিয়ে। আমার দ্বিমতকে তিনি এতো গুরুত্ব দিবেন তা আমি কল্পনাও করি নি। তিনি আমার মতটা সঠিক না উনার মতটা সঠিক তা জানার জন্যে সারা রাত ঘুমান নি। অনেক কিতাব পড়াশুনা করেছিলেন।
যে সমস্ত হুজুররা পরিবার দূরে রেখে একা একা মাদ্রাসায় থাকেন তাদের ব্যাপারে আমার খুব দয়া লাগে। কারণ স্ত্রী ও সন্তানদের ফেলে রেখে থাকা আসলেই খুব কষ্টকর। কিন্তু হুজুরকে দেখে আমার মনে হতো- উনার পরিবার কাছে নেই দেখে এতো পড়াশুনা করতে পারতেন। আমি নিজে একজন শিক্ষক হয়ে একথা ভালোকরেই বুঝি যে পোস্টগ্রাজুয়েট লেভেলের (বিএ, কামিল, এম এ পিএইচডি) একজন শিক্ষকের যে পরিমাণ পড়াশুনা ও গবেষনা করা লাগে তাতে পরিবারের যাবতীয় দায়িত্ব পালন করা আসলেই কষ্টকর হয়ে পড়ে। এ ক্ষেত্রে শায়খের স্ত্রীরা যে ত্যাগ স্বীকার করেছেন- আমরা ছাত্র-ছাত্রীদের পক্ষ থেকে তাদেরকে গভীর কৃতজ্ঞতা জানাই। আল্লাহ যেন আমাদের মহান শিক্ষকদের সহধর্মিনীদেরকে বিশেষ পুরস্কার দান করেন।
হুজুরের কাজ কর্ম ছিলো অসম্ভব রকমের গোছানো। তিনি যে কাজ করতেন তা একেবারে পাকাপোক্তভাবে করতেন। তাঁর কারণিক বা অফিসিয়াল কাজ-কর্ম ছিলো অত্যন্ত নিখুঁত। রুলার দিয়ে খাতায় যেভাবে সুন্দর করে দাগ কাটতেন তা ছাপাকেও হার মানাতো।
আমি যখন ছাত্র ছিলাম তখন শায়খ ফখরুদ্দীন ছিলেন আলিয়া মাদ্রাসার একজন অধ্যাপক। তিনি মাদ্রাসার পরীক্ষার নিয়ন্ত্রক ছিলেন। তবে, মাদ্রাসার সামগ্রিক উন্নয়ন নিয়ে তিনি যে রকম ভাবতেন তা আর কেউ ভাবতেন বলে মনে হয় না। তিনি এটাকে চাকুরী মনে করতেন না, মনে করতেন তার মিশন। সারা আলিয়া মাদ্রাসাটা তখন খুব বেহাল অবস্থায় চলে এসেছিলো। আলিয়া মাদ্রাসার হোস্টেল ছিলো জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা অন্যান্য অছাত্রদের দখলে। আমরা যারা তখন ছাত্র ছিলাম, তাদেরকে ঐ সব অছাত্রদের কাছ থেকে সীট কিনে নিতেও দেখেছি। আমরা ডাবলিং করে থাকতাম। আমি কামিলের ফার্স্ট বয় হওয়ার কারণে আমার ওপর অন্যান্য সাধারণ ছাত্রদের অনেক দাবী ও চাপ ছিলো। ছাত্র সংগঠনগুলো সীট দখলের একটা বিশাল প্রতিযোগিতা করত এবং তাদের পছন্দের নেতা কর্মী ছাড়া তারা কাউকে সীট দিতো না। আমি সারা বাংলাদেশে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হওয়ার পর বা মিল্লাতের ছাত্র হওয়ার পরও কোন ছাত্র নেতার সামান্য একটু দয়া হলো না আমাকে কোথাও একটা সীট দেওয়া। শুধু আমি নই, আরো অনেক ভালো ছাত্রদেরও একই অবস্থা ছিলো। এগুলো নিয়ে হুজুরের সাথে আমি ও অন্যান্যরা দৈনিকই কথা বলতাম এবং নানান চিন্তা ও প্লান প্রোগ্রাম করতাম। হুজুরের সাথে বলার কারণ এটাই ছিলো যে হল সুপার বা হাউস টিউটররা ছিলেন ছাত্রদের কাছে একেবারেই বন্দী। তারা কিছু বললে তারা ছাত্রদের কাছে অপমানিত হবেন বলে তাদেরকে বহুবার বলেও কোন লাভ হয় নি। এবং আমাদেরকে নিয়ে তাদের কোন চিন্তা ছিলো বলেও মনে হয়নি। এ ক্ষেত্রে ফখরুদ্দীন হুজুরের যেমন ছিলো আন্তরিকতা তেমন ছিলো সাহস। তিনি বলতেন- যারা হলের দায়িত্বে আছেন এটা তাদের কাজ এবং তারা ইচ্ছা বা সাহস করলে অনেক কিছু করতে পারেন।
আমরা বুঝেছিলাম- হুজুর চেষ্টা করলে কিছু করতে পারবেন এবং বেশ কিছু বাস্তব পদক্ষেপ নেওয়া হলো। এর প্রথম ধাপ হিসাবে, হুজুরকে আমরা খাজে দেওয়ান থেকে মাদ্রাসার একাডেমিক বিল্ডিং এর একটা রুমে নিয়ে আসি প্রিন্সিপ্যাল অধ্যাপক ইউনুস শিকদারের অনুমোদন ক্রমে এবং হুজুরকে হলের একজন টিউটরও করা হলো। এ সময় ভাইস প্রিন্সিপ্যাল ছিলেন জনাব আব্দুস সালাম। তিনি খুব ভালো মনের মানুষ ছিলেন এবং মাওলানাদেরকে তিনি শ্রদ্ধা করতেন। তিনি ফখরুদ্দীন হুজুরকে খুব সাপোর্ট করতেন।
হুজুরকে এ কাজে আরো বেশী সাপোর্ট করেছিলেন মুহাদ্দিস ওয়াজিউল্ল্যাহ সাহেব। কোন এক কারণে হুজুরের সাথে ওয়াজিউল্লাহ সাহেবের খুব মন কষাকষি ছিলো। মুখ দেখাদেখিও ছিলো না। আমি, সালাম আজাদী, শামীম, নূর মোহাম্মদ, জাকির মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম আমাদের আলিয়ার পরিবেশ বদলাতে হলে দুই মুহাদ্দিস হুজুরের মধ্যে সম্পর্ক ভালো করতে হবে। কারণ প্রিন্সিপ্যাল সাহেবের সাথে ওয়াজিউল্ল্যাহ হুজুরের সম্পর্ক ভালো ছিলো। আর ফখরুদ্দীন হুজুরের সাথে ভাইস প্রিন্সিপ্যাল হুজুরের ভালো খাতির ছিলো। ওয়াজিউল্ল্যাহ হুজুরও আলিয়া মাদ্রাসার একাডেমিক ভবনের কোনায় একটা ছোট্ট রুমে। খুব সাধারণ অবস্থায়।
ওয়াজিউল্ল্যাহ হুজুর ও ফখরুদ্দীন হুজুরের মধ্যে সম্পর্কোন্নয়নের জন্যে আমি আর আযীউদ্দীন শামীম বিশেষ করে উদ্যোগ নিলাম। আমাদের সাথে সহযোগিতায় ছিলেন (ডঃ) সালাম আজাদী, নূর মোহাম্মদ ও জাকির হোসাইন। আমরা নিজেরা আগে পরিকল্পণা করলাম এইভাবে যে আমরা দুই গ্রুপ হয়ে যাব- প্রত্যেকদিন বিকালে দুই গ্রুপই নাস্তা কিনে দুই মুহাদ্দিসের কাছে যাব এবং তারা একে অন্যের প্রশংসা করেন সে কথা বলব। এই বুদ্ধিতে কাজ হলো। দুই সপ্তাহের মধ্যেই দুই হুজুরের মন একটু একটু নরম হতে শুরু করলো। এরপর ফখরুদ্দীন হুজুরের রুমে ওয়াজিউল্লাহ হুজুরকে ডাকা হলো নাস্তার জন্যে। তিনি সে দাওয়াত সাদরে কবুল করলেন এবং ফখরুদ্দীন হুজুরও তাকে সাদর অভ্যররথনা জানালেন। বহুদিন পর তারা এভাবে কোন ঘরোয়া পরিবেশে মিশেন নাই এবং দু’জনেই খুব আনন্দিত হলেন বলে বুঝা গেল। (চলবে)
লেখক: ইসলামী চিন্তাবিদ ও গবেষক। মুদীর, ইউরোপিয়ান জামিয়া ইসলামিয়া, ইউকে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন