বৃহস্পতিবার, ০৯ মে ২০২৪, ২৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের লজ্জাজনক পরাজয়

মোহাম্মদ আবু নোমান | প্রকাশের সময় : ২৬ আগস্ট, ২০২১, ১২:০৩ এএম

অভাবনীয় দ্রুততার সঙ্গে আফগানিস্তানের অবস্থার পরিবর্তন ঘটলো। দীর্ঘ ২০ বছর ধরে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করে, হাজার হাজার সৈন্যের দেহ ক্ষতবিক্ষত ও কফিনবন্দি করে অবশেষে তল্পিতল্পা গুটিয়ে, লজ্জাজনকভাবে খালি হাতেই আফগানিস্তান থেকে ফিরতে হচ্ছে ‘মহাশক্তিধর’ যুক্তরাষ্ট্রকে! যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন আগামী ১১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে পুরোপুরি সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা দেওয়ার পর গত ১০০ দিনে একের পর এক শহর দখল করে সর্বশেষ কাবুল কবজায় নেওয়ার মধ্য দিয়ে ১৯৯৬ সালের পর দ্বিতীয় পর্বের উত্থান ঘটলো তালেবানের। মহাশক্তিধর যুক্তরাষ্ট্র তালেবানকে কেন রুখতে পারল না, এই বিষয়ে নানা ব্যাখ্যা উঠে আসছে। মার্কিনীরা আফগানিস্তানে ঊনবিংশ শতাব্দীতে ব্রিটেনের, বিংশ শতাব্দীতে সোভিয়েত ইউনিয়নের কিংবা ভিয়েতনামে নিজেদের লজ্জাজনক পরাজয় থেকেও শিক্ষা নেয়নি। ৮৮ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে যে আফগান সেনাবাহিনী তৈরি ও প্রশিক্ষিত করা হয়েছিল, তারা কীভাবে এত সহজেই ভেঙে পড়লো? এর অন্যতম কারণ, আফগান সেনাবাহিনীর মনোবলের অভাব। বিশ্ব দেখেছে, বছরের পর বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্র আফগানদের বিষয়ে যেসব তথ্য দিয়েছে, সেগুলো ছিল অতিরঞ্জিত, অসম্পূর্ণ এবং মিথ্যা। আফগানিস্তানে মার্কিন জেনারেলদের ব্যর্থ কৌশলগুলো এখন ইতিহাসের অংশ, যারা বলেছিলেন, সবকিছুই পরিকল্পনামাফিক চলছে। অন্যদিকে তালেবান বলেছিলো, ‘ওদের হাতে রয়েছে ঘড়ি, আর আমাদের হাতে রয়েছে সময়।’

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শেষ প্রান্তে ১৯৪৬ সালের ৬ এবং ৯ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্র হিরোশিমা এবং নাগাসাকিতে আণবিক বোমা নিক্ষেপ করে। এতে জাপান যুক্তরাষ্ট্রের কাছে নিঃশর্তে আত্মসমর্পণ করে। এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র যত যুদ্ধে জড়িয়েছে, শুধুমাত্র জনবিধ্বংসী আণবিক বোমা বিস্ফোরণের কারণে জাপান ছাড়া কোথাও পূর্ণ বিজয় অর্জন করতে পারেনি। কূটনীতিকদের একাংশের মতে, আফগানিস্তানে অহংয়ের লড়াই করতে গিয়েছিল আমেরিকা। কিন্তু তালেবানের কাছে তা ছিল শিকড় রক্ষার লড়াই। তাই যতবার আঘাত নেমে এসেছে, ভূপাতিত হয়েও বারবার মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে তারা। গুলি-বোমায় একজন তালেবান মারা গেলে তার জায়গায় আরও ১০ জন এগিয়ে এসেছে। দেশের ভেতরে গড়ে ওঠা একটি শক্তিকে কেবল বল প্রয়োগ করে মোকাবিলা করা একটি বিদেশি বাহিনীর দায়িত্ব হতে পারে না। বহিঃশক্তি রাষ্ট্র গঠন করতে পারে না, একথা বুঝতে যুক্তরাষ্ট্রের অনেক দেরি হয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকরা কূটনৈতিক ভাষায় ইনিয়ে-বিনিয়ে যেভাবেই ব্যাখ্যা দিন না কেন, আফগানিস্তানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পরাজিত হয়েছে, ন্যাটোর শরিকেরা পরাজিত হয়েছে, এ নিয়ে কোনো রকমের ভিন্নমতের অবকাশ নেই। যুক্তরাষ্ট্রও বুঝেছে, পরাজয়ের পরিণতি ও চেহারা এর চেয়ে ভালো কিছু আশা কর যায় না। সোভিয়েত ইউনিয়নের পর যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে তাদের সমর্থকদের মাথায় কেবল ‘তাল’ দিয়ে চলে গেছে, ‘মিঠা’ দিতে পারেনি।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে টার্গেট করে একটার পর একটা দেশে যুদ্ধ চালিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। পছন্দের সরকার বসাতে গোয়েন্দা বাহিনী দিয়ে দেশে দেশে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটানো ছাড়াও বিশেষ বাহিনীর মাধ্যমে গোপন অভিযান চালিয়ে আধিপত্য বজায় রেখেছে। আধিপত্যবাদী লড়াইয়ের এ মিশনে ১৯৪৫ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ৭৬ বছরে অর্থনৈতিক ও সামরিক পরাশক্তি এই দেশটির হাতে নিহত হয়েছে প্রায় ৩ কোটি নিরীহ বেসামরিক মানুষ। যুক্তরাষ্ট্রের চাপিয়ে দেয়া অবৈধ যুদ্ধ, সামরিক অভ্যুত্থান ও গোপন সামরিক অভিযানের শিকার হয়েছে বিশ্বের অন্তত ৩৭টি দেশ বা জাতি। পশ্চিমাসহ বলতে গেলে গোটা বিশ্বের মিডিয়া ও বুদ্ধিজীবীদের আফগান ও তালেবান প্রশ্নে ভাষা, শব্দচয়ন ও বিশ্লেষণও নাটকীয়ভাবে বদলে গেছে। এতদিন তাদের কাছে অতিচেনা সশস্ত্র সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী, তালেবান জঙ্গি এখন ভাষান্তর হয়ে ‘তালেবান যোদ্ধা’ ও ‘রাজনৈতিক শক্তি’ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী থেকে তালেবানদের ‘ঝানু রাজনৈতিক শক্তির উত্থান’ ও ‘অভাবনীয় কূটনৈতিক সাফল্য’ বলে পশ্চিমা বিশ্লেষকরা অভিমত প্রকাশ করছে। কারণ, ২০১৮ সালে আফগানিস্তানের ‘তোরাবোরা পাহাড়, অরণ্যসহ প্রত্যন্ত এলাকা থেকে কাতারের দোহায় আলোচনার টেবিলে নিয়ে যাওয়া হয় তালেবানকে। তালেবান প্রতিনিধিরা ওয়াশিংটনেও আলোচনায় বসেছেন ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে। গত কয়েক মাসে রাশিয়া, চীন, ইরান, তুরস্ক ও ভারতের সঙ্গে আলোচনায় বসেছেন তারা। ধীরে ধীরে জঙ্গিগোষ্ঠী থেকে তাদের রাজনৈতিক গোষ্ঠী হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার একটা ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসনে ২০০১ সালে ক্ষমতা হারিয়ে কোণঠাসা হয়ে পড়া তালেবান গত ১৫ আগস্ট বিনা রক্তপাতে আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নেয়। বাঁধভাঙা নদীর পানির মতোই অপ্রতিরোধ্য গতিতে সেখানে ঢুকে পড়ে তালেবান। পুরো আফগানিস্তান এখন তাদের দখলে। ১৯৯৬ সালে তালেবান আফগানিস্তানের শাসন ক্ষমতা পুরোপুরি দখলে নেওয়ার পর দেশটিতে শরিয়া আইন চালু করে। পরবর্তীতে ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর মার্কিন সমর্থিত বাহিনী তালেবানকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর তালেবানের প্রতিষ্ঠাতা মোল্লা ওমর আত্মগোপন করেন। যুক্তরাষ্ট্রের ভিয়েতনাম, কোরিয়া, সিরিয়া, ইয়েমেন, ইরাক, লিবিয়ায় ও আফগানিস্তানের যুদ্ধ ও সংঘাতে বিশাল সংখ্যক মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। মৃত্যুর পাশাপাশি ঘটেছে অগণিত আহত হওয়ার ঘটনা। বিমান হামলা আর অত্যাধুনিক সব অস্ত্রের আঘাতে সারাজীবনের জন্য পঙ্গু হয়েছে কোটি কোটি মানুষ।

মার্কিন সেনাদের অপরাধ, কুকর্ম, ধর্ষণ, ধ্বংসজজ্ঞ, আহত, নিহত হওয়াই শেষ কথা নয়, মার্কিন সরকার ওইসব অঞ্চলে দারিদ্র্য, বর্ণবাদ ও সহিংসতা সৃষ্টির মাধ্যমে চরমভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটিয়েছে। অথচ, জাতিসংঘসহ বিশ্বের অন্যান্য মোড়লরা আমেরিকার এসব অপকর্ম না দেখার ভান করে এখন তালেবানদের নসিহত করছে। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা দেশে দেশে মানুষকে মুক্ত করার নামে আগ্রাসন, দখলদারি, বোমা হামলা চালিয়ে জনপদের পর জনপদ ধ্বংস করে শিশু-নারীসহ লাখ লাখ মানুষের জীবনহানি ঘটেছে। ধ্বংস করেছে অর্থনীতি ও মানুষের আবাসভূমি, প্রাচীন সভ্যতার অমূল্য নিদর্শন। অথচ, তারাই এখন আফগানে মানবাধিকার লঙ্ঘন হবে বলে নসিহত করছে। জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, ‘আফগানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের নানা খবরে আমি গভীরভাবে শঙ্কিত।’ তার ভাষ্য, এই খবর ভয়াবহ এবং মন ভেঙে দেওয়ার মতো। এছাড়া বেসামরিক লোকজনের ওপর হামলা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের চরম লঙ্ঘন বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন জাতিসংঘ মহাসচিব। একে যুদ্ধাপরাধ বলেও আখ্যায়িত করেছেন তিনি।
জাতিসংঘ এখন শুধু তালেবানকে নীতি শিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করছে। তথাকথিত সভ্য জগৎ যেভাবে বছরের পর বছর ধরে আফগানিস্তানে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে, তা কি যুদ্ধ অপরাধের চাইতেও বেশি নয়? তালেবান তাদের নিজের দেশ, যেভাবে সম্ভব চালাবে। তালেবানের কী নীতি বা আদর্শ সেটা এখনই দেখার বিষয় নয় বিশ্ব মোড়লদের, সেটা আফগান জনগণের ব্যাপার। তবে তালেবান বিদেশি দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে, তা সেটা আমেরিকা/রাশিয়া যেই হোক, ছেড়া জুতা, ছেড়া জামা আর আধা বেলা খেয়ে বছরের পর বছর দেশপ্রেমের উদ্বুদ্ধ হয়ে যুদ্ধ করেছে। কেন তালেবান স্বদেশকে দখলদার, শত্রুর কবল থেকে উদ্ধার করে মুক্তিযোদ্ধা হবে না!

পেন্টাগন থেকে এখন পর্যন্ত যে পরিসংখ্যান পাওয়া গেছে তাতে, গত ২০ বছরে আফগানিস্তানে যুদ্ধের পিছনে ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি ডলার খরচ করেছে আমেরিকা। এর মধ্যে শুধুমাত্র আফগান সেনাকে প্রশিক্ষণ দিতেই খরচ হয়েছে ৮ হাজার ৯০০ কোটি ডলার। ২০২০ সালের এক রিপোর্টে পেন্টাগন জানায়, সরাসরি যুদ্ধেই তাদের ৮১ হাজার ৫৭০ কোটি ডলার খরচ হয়েছে। আফগানিস্তান থেকে বেঁচে ফিরেছেন যেসব সৈনিক, তাদের চিকিৎসা এবং কল্যাণমূলক ভাতা বাবদ ২৯ হাজার ৬০০ কোটি ডলার খরচ হয়েছে আমেরিকার। যত দিন তারা বেঁচে থাকবেন ততদিন তাদের ভাতা দিতে হবে আমেরিকা সরকারকে।
২০ বছর আগে যুক্তরাষ্ট্র যখন আফগানিস্তানে আগ্রাসন শুরু করে তখনকার পরিস্থিতি আর বর্তমান পরিস্থিত এক নয়। এখন আফগানিস্তানের রাজনীতির সঙ্গে চীন, পাকিস্তান, ভারত, রাশিয়া, ইরান, কাতার ও তুরস্কের স্বার্থও যুক্ত হয়েছে। তবে তালেবানের জন্য এখন বড় চ্যালেঞ্জ, তাদের সশস্ত্র যোদ্ধাদের শান্ত ও নিরস্ত্র করা। বিদেশি সমর্থন আদায় এবং দেশকে যুদ্ধ বিগ্রোহের হাত থেকে বের করে আধুনিক আফগানিস্তান নির্মাণ করা।
লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, নব সংবাদ

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
মোঃ রহমান ২৫ আগস্ট, ২০২১, ৮:১৪ পিএম says : 0
অফুরন্ত শ্রদ্ধা আর আভালোবাসা লেখকের জন্য। লিখতে কার্পণ্য করেননি!
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন