প্রথম তালেবান আন্দোলনের উত্থানের সময় ক্ষমতাসীন সরকারের বাহিনী রকেট হামলা করে কান্দাহার বেতার কেন্দ্র ধ্বংস করে দেয়। এটি ১৯৯৬ এর কথা। তালেবান বাহিনীর জরুরি সংবাদ প্রচারের জন্য বেতার কেন্দ্র ব্যবহার করার আর উপায় ছিল না। অথচ এ ছাড়া অন্যান্য প্রদেশের তালেবানের সাথে তাদের যোগাযোগের আর কোনো উপায় ছিল না। কথাবার্তা শুনে মোল্লা উমর নিজ তাঁবু থেকে বেরিয়ে এসে কমান্ডারকে তার গায়ের পিত রঙের পশমি চাদরটি খুলে দিয়ে বললেন, এটি নিয়ে বিধ্বস্ত ভবনের যন্ত্রপাতির ওপর ছড়িয়ে দাও এবং বিসমিল্লাহ বলে যোগাযোগ শুরু কর। কমান্ডার গিয়ে ঠিক তাই করলেন এবং যথারীতি রেডিও ট্রান্সমিশন শুরু হলো। সব প্রদেশে তালেবানের সাথে যোগাযোগ সম্ভব হলো।
একসময় সউদী শাসকদের নিকটজন হিসাবে ওসামা বিন লাদেন ছিলেন আমেরিকার কাছের মানুষ। বিশেষ করে আফগানিস্তানের সোভিয়েত আগ্রাসনবিরোধী যুদ্ধে মার্কিন সহায়তা নেওয়া এই আরব যুবক যখন গোটা বিশ্বে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লড়াইয়ের ছক তৈরি করছিলেন, তখন এই নিগুঢ় তত্ত¡ ও বিস্তারিত তথ্য জানা হারানো বন্ধুটিকে হত্যার জন্য আমেরিকা আফগানিস্তানের পার্বত্য এলাকায় এমন সব বোমা নিক্ষেপ করে যা দুনিয়ার আর কোনো যুদ্ধে তারা ব্যবহার করেনি। কার্পেট বোমা, ডেইজি কাটার বোমা, কম্পিউটার গাইডেড টার্গেট বোমা দিয়ে বিন লাদেনের অবস্থান করার মতো আফগানিস্তানের সম্ভাব্য সব ঘাঁটি এবং কৌশলগত জায়গা তারা তছনছ করে দেয়। তোরাবোরা পাহাড়কে ধূলি-কংকরময় প্রান্তরে পরিণত করে। একসময় মোল্লা ওমরের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে উসামাকে পাকিস্তানের এবোটাবাদের এক বাড়িতে আশ্রয় নিতে হয়। নিরাপত্তার জন্য তখন তারা কেউই ইলেক্ট্রনিক গ্যাজেট কিংবা ডিভাইস ব্যবহার করতেন না। মোল্লা উমরকে মার্কিনিরা শত চেষ্টা করেও হত্যা করতে পারেনি। তবে তার মাথার মূল্য নির্ধারণ করে কোটি ডলার। আফগান জনগণ ও তালেবান দলের কেউই তাদের নেতার হেফাজতের কোনো ত্রæটি করেনি। বিশেষ করে মার্কিন সমর্থিত আফগান সরকারের প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই মার্কিনিদের ভুল তথ্য দিয়ে মোল্লা ওমরের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেন। যে জন্য বর্তমান সরকার গঠনের সমন্বয় কর্মে তালেবান নেতৃত্ব হামিদ কারজাইকে যুক্ত থাকতে দিয়েছেন।
মোল্লা উমর সোভিয়েত আফগান যুদ্ধের সময় মর্টার শেলের আঘাতে তার একটি চোখ হারান। এই নেতার মৃত্যুর পর মোল্লা আখতার মনসুর হন তালেবান প্রধান। তিনি মার্কিন হামলায় শহীদ হলে নেতা নির্বাচন করা হয় মোল্লা উমরের পুত্র মোল্লা ইয়াকুবকে। কিন্তু তিনি তখন ২১ বছরের তরুন। বিনয় ও ত্যাগে নিজেকে প্রত্যাহার করে তিনি পিতা মোল্লা উমরের এক সহকর্মীকে মূল নেতারূপে গ্রহণ করে নেন। মোল্লা হায়বাতুল্লাহ আখুন্দজাদাহ এই নেতা। তালেবানের প্রথম শাসনামলে মোল্লা উমর যাকে কাবুল শরীয়া আদালতের প্রধান বিচারপতি হিসাবে নিয়োগ দিয়েছিলেন। বর্তমানে তিনি তালেবানের প্রধান আধ্যাত্মিক নেতা।
আগস্টজুড়ে তালেবান শক্তি আফগানিস্তান দখল করে কাবুলে সরকার প্রতিষ্ঠা, সারা দেশে নিরাপত্তা, বিচার, প্রশাসন নিয়ন্ত্রণে নেওয়া, সিআইএ পরিচালকের বৈঠক এবং বিদেশি শক্তির বিদায় ইত্যাদি চললেও তালেবানের মূল নেতাকে কোথাও দেখা যায়নি। মিডিয়ায় বিভিন্ন পর্যায়ের দায়িত্বশীল ও স্পোকসম্যানদের দেখা গেলাও মূল আধ্যাত্মিক নেতার অবস্থান সম্পর্কে কেউ কিছু বলছে না। দৃশ্যমান রয়েছেন তালেবানের রাজনৈতিক শাখার নেতারা। এর কারণ, মূল আধ্যাত্মিক নেতাকে তারা সামনে আনার চেয়ে তার হেফাজতের প্রতিই অধিক মনযোগী। বিদেশি সৈন্যরা যাওয়ার পথে কিংবা তাদের কোনো মিত্র যেন শেষ পর্যায়ে কোনো আঘাত হানতে না পারে। কেননা, তালেবান সরকার ও রাজনৈতিক শাখার যে কোনো ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার সক্ষমতা তাদের রয়েছে। কিন্তু পোড় খাওয়া এবং বিশ্বের সমন্বিত সুপার পাওয়ারকে পরাজিত করে শতভাগ শরীয়াহ প্রতিষ্ঠার মূল আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব আমিরুল মুমিনিনের নিরাপত্তা সবার আগে। কারণ, ৮০ হাজার তালেবান সেনা যুদ্ধক্ষেত্রে শহীদ হওয়ার পর বর্তমানে যে ৭০ থেকে ৭৫ হাজার তালেবান বেঁচে রয়েছেন, এদের প্রত্যেকেই আমৃত্যু আল্লাহর পথে সংগ্রাম করার শপথ নিয়েছেন এই আমিরুল মুমিনিন মোল্লা হায়বাতুল্লাহ আখুন্দজাদাহর হাতেই।
হয়তো মোল্লা উমর, মোল্লা আখতার মনসুর বা বিন লাদেনের শাহাদাত থেকে তারা শিক্ষা নিয়েছেন। আখুনজাদাহ মুজাহিদ আউলিয়াদের জামাত নিয়ে একান্ত কোনো জায়গায় তালেবানের সাফল্যের জন্য আল্লাহর দরবারে দোয়া মুনাজাত মুরাকাবায় রয়েছেন। সব রকম ইলেক্ট্রোনিক ডিভাইস থেকে দূরে রেখে ম্যানুয়াল যোগাযোগ ও প্রতিটি মৌলিক সিদ্ধান্ত নিতে তাকে প্রয়োজন হচ্ছে, তবে তার অবস্থান সহযোদ্ধারা সব দুশমন চলে যাওয়া এবং সরকার গঠন পূর্ণতা না পাওয়া পর্যন্ত প্রকাশ করছেন না। অভিজ্ঞতা মানুষকে সম্পূর্ণ করে। বিপদ ও পরীক্ষা মানুষকে নৈপুণ্য এনে দেয়। আল্লাহর সাহায্য নেক্কার মানুষকে অলৌকিক শক্তিতে বলীয়ান করে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন