আল্লাহর নবী (সা.) কর্তৃক স্বপ্নযোগে আদিষ্ট হয়ে বাহ্যিক বিবেচনায় এক অসম অযৌক্তিক যুদ্ধে অবতীর্ণ হন মোল্লা উমর। তার শহীদী মৃত্যুর পর তালেবান নেতা আখতার মনসুরও মার্কিনীদের রকেট হামলায় শাহাদত বরণ করেন। এরপর মোল্লা উমরের পুত্র মোল্লা ইয়াকুবের ওপর ন্যাস্ত হয় তালেবানের নেতৃত্ব। আধ্যাত্মিক এ সামগ্রিক নেতৃত্ব ২১ বছর বয়সী এ বালক তুলে দেন তার মুরব্বী হায়বাতুল্লাহ আখুন্দজাদাহর হাতে। বর্তমানে মোল্লা ইয়াকুবের বয়স ৩১/৩২ এর মাঝে। তালিবানের দ্বিতীয় প্রধান আধ্যাত্মিক নেতা, সামরিক শাখার প্রধান এবং নতুন সরকারের বড়ো কোনো পদে দেখা যাবে তাকে। তার সেক্রিফাইসে মনোনীত বর্তমান আধ্যাত্মিক নেতার পরিচয় সঠিকভাবে পাওয়ার আগে পাঠক এ ক’টি লাইন পড়ে নিতে পারেন।
‘যুবকটির নাম আব্দুর রহমান। আমি সেই সময়ের গল্প বলছি যখন তার বয়স ছিলো মাত্র ২৩ বছর। এই বয়সের একজন যুবকের স্বপ্ন কি হয়? সুন্দর আগামীর এক দীর্ঘ পরিকল্পনা। অথচ যুবকটি নাম লিখিয়ে দিলো এক শহীদি কাফেলায়। সে ছিলো সেই কাফেলার সদস্য যেখান থেকে কেউ ফিরে আসেনা। ইসতিশহাদি কাফেলা। যারা কৌশলগত স্থানে নেতার নির্দেশে শাহীদি মত্যুকে জেনে শুনে বরণ করে নেয় এবং শত্রুর সমরশক্তির বিনাশ ঘটিয়ে নিজেদের বিজয় নিশ্চিত করতে মুজাহিদ মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করে।
২০ জুলাই ২০১৭, বৃহস্পতিবার সংবাদ সংস্থা রয়টার্সের রিপোর্ট অনুযায়ী লশকরগাহের উত্তরের শহর গেরেশক এ একটি বিস্ফোরক বোঝাই করা গাড়ি নিয়ে মার্কিন ন্যাটো আর্মির মিলিটারি বেইসে ইসতিশহাদি আক্রমণ পরিচালনা করে এই যুবক। পান করে শাহাদাতের অমিয় সুধা।
আক্রমণের পূর্বে তার বাবাকে যখন একজন কমান্ডার বিষয়টি অবহিত করেন এবং অনুমতি চান, তখন তার উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি কি তাকে আল্লাহর পথে শহীদ হওয়া থেকে নিবৃত করবো? জানেন এই বাবাটির নাম কি?’ হ্যা, তিনিই তালেবানের বর্তমান আমিরুল মুমিনিন, আফগান সরকারের সর্বোচ্চ আধ্যাত্মিক নেতা মুফতি হায়বাতুল্লাহ আখুন্দজাদা।
তিনি এমন নেতা নন যে কর্মীকে আগে ঠেলে নিজের সন্তানকে পিছনে রাখবেন। একজন বাবার জন্য তার সন্তান হারানোর চেয়ে বড় বেদনার আর কি আছে। কিন্তু ইসলাম তাদেরকে হাসিমুখে নিজের প্রাণ ও প্রিয়জনকে বিসর্জন দিতে শিখিয়েছে। স্বাধীনতা, সাহস, মুক্তির চেতনা, ত্যাগ, সাধনা, সংগ্রাম, আত্মমর্যাদা ও ঈমান সবদিক দিয়ে পিছিয়ে থাকাদের কি যোগ্যতা আছে তাদের সমালোচনার?
তালেবান প্রধান মোল্লা উমরকে আল্লাহর নবী (সা.) স্বপ্নযোগে বিজয়ের সুসংবাদ দিয়েছিলেন। কেমন বিজয় হয়েছে তা পৃথিবী দেখতে পাচ্ছে। আর যুদ্ধলব্ধ অস্ত্র ও সম্পদ তালেবানরা কী পরিমাণ পেয়েছে তার সংক্ষিপ্ত একটি তালিকা এখানে রয়েছে। এক পরিসখ্যানে দেখা যায়, ২০০২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানের সামরিক বাহিনীকে ২ হাজার ৮০০ কোটি টাকার সমরাস্ত্র দিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে বন্দুক, রকেট, নাইট-ভিশন গগলস, গোয়েন্দা নজরদারি চালানোর জন্য ড্রোন। তবে উপহারের তালিকায় সবকিছুর উপরে ছিল বø্যাকহক হেলিকপ্টার। তালেবানের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আফগান সেনাদের এটা বেশ এগিয়ে রাখত।
মার্কিন গভর্নমেন্ট একাউন্টিবিলিটি অফিসের ২০১৭ সালের তথ্য অনুসারে, আমেরিকা আফগানিস্তানকে ৭৫,৮৯৮টি গাড়ি; ৫,৯৯,৬৯০টি অস্ত্র; ১,৬২,৬৪৩টি যোগাযোগের সরঞ্জাম, ২০৮টি বিমান ও হেলিকপ্টার এবং ১৬,১৯১টি গোয়েন্দা ও নজরদারি সরঞ্জাম দিয়েছে। ২০০৩ সাল থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে এসব অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম দেওয়া হয়। আফগানিস্তানকে দেওয়া বিমান ও হেলিকপ্টারের ৪৬টি এখন উজবেকিস্তানে রয়েছে। তালেবানদের কাবুল দখলের পর এসব এয়ারক্রাফট ব্যবহার করে প্রায় ৫০০ আফগান সেনা উজবেকিস্তানে পালিয়ে যায়।
এছাড়া, ২০১৭ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তানকে ৭ হাজার ৩৫টি মেশিনগান; ৪ হাজার ৭০২টি হামভি গাড়ি, ২ হাজার ৪০টি হ্যান্ড গ্রেনেড, ২ হাজার ৫২০টি বোমা ও ১ হাজার ৩৯৪টি গ্রেনেড লাঞ্চার দিয়েছে ওয়াশিংটন। আফগানিস্তান পুনর্গঠনের বিশেষ মহাপরিদর্শকের ত্রৈমাসিক প্রতিবেদনের হিসাব অনুসারে, শুধু গত দুই বছরে আমেরিকা আফগান সামরিক বাহিনীকে ১৮ মিলিয়নেরও বেশি রাউন্ড ৭.৬২ মিমি এবং .৫০-ক্যালিবারের গোলাবারুদ দিয়েছে। একজন মার্কিন কর্মকর্তা রয়টার্সকে বলেছেন, ‘যা কিছু ধ্বংস হয়নি, এখন তা তালেবানদের।’ এদিকে মার্কিন পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিটি রয়টার্সকে জানিয়েছে, ‘আমরা ইতোমধ্যেই তালেবান যোদ্ধাদের আফগান বাহিনীর কাছ থেকে মার্কিন তৈরি অস্ত্র দিয়ে সজ্জিত হতে দেখেছি।
এরপর আসে আফগানিস্তানের প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদের কথা। এরও একটি সংক্ষিপ্ত ধারণা এখানে দেওয়া হলো। প্রায় ছয় লাখ বায়ান্ন হাজার বর্গকিলোমিটারের আফগানিস্তানকে বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ খনিজ সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। দেশটিতে আনুমানিক ১৪০০-র অধিক বিভিন্ন খনিজ ক্ষেত্র রয়েছে। খনিজ ক্ষেত্রগুলোর আনুমানিক মূল্য ৩ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। কিছু তথ্য অনুযায়ী সেটা ৭ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার পর্যন্ত হতে পারে। স্বর্ণ, রৌপ্য, প্লাটিনাম, ইউরেনিয়াম, অ্যালুমিনিয়াম, তামা, লোহা, ক্রোমাইট, লিথিয়াম ইত্যাদি আছে খনিজ পদার্থের তালিকায়। সেই সঙ্গে রয়েছে উচ্চ মানের পান্না, রুবি, নীলকান্তমণি, ফিরোজা ইত্যাদি রত্ম-পাথরের মজুদও।
বর্তমান পৃথিবীতে বলিভিয়ায় লিথিয়ামের সর্বোচ্চ মজুদ রয়েছে বলে মনে করা হয়। কিন্তু আমেরিকার তথ্য অনুযায়ী আফগানিস্তানের শুধুমাত্র গজনি প্রদেশেই বলিভিয়ায় চেয়ে বেশি লিথিয়ামের মজুদ রয়েছে। মূল্যবান রত্মপাথরের পাশাপাশি আফগানিস্তানে স্বর্ণেরও যথেষ্ট মজুদ রয়েছে। শতাব্দীকাল ধরে আফগানিস্তানের গজনী, জাবুল, কান্দাহার এবং তাখার প্রদেশসহ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল থেকে স্বর্ণ উত্তোলন করা হচ্ছে। এছাড়া বাদাখশান ও হেলমান্দ প্রদেশেও স্বর্ণের বিশাল মজুদ রয়েছে।
পাহাড় সমৃদ্ধ আফগানিস্তানের বেশ কয়েকটি নদীর উপত্যকায় বিশেষ করে আঞ্জির, হাসার, নুরাবা এবং পাঞ্জ নদীর উপত্যকায় স্বর্ণের মজুদ রয়েছে। পাঞ্জ নদীর উপত্যকায় অবস্থিত সমতি খনিতে আনুমানিক প্রায় ২০ থেকে ২৫ মেট্রিক টন স্বর্ণ রয়েছে। এছাড়া দেশটির গজনি প্রদেশে থাকা স্বর্ণ ও তামার মজুদের আনুমানিক মূল্য ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
আল্লাহর রহমত ও সাহায্য ছাড়া এ কথা চিন্তাও করা যায় না। পাহাড়ি দেশটির মাটির নিচের এ সম্পদ আর স্থলভাগের কৌশলগত অবস্থানের জন্যিই আফগানিস্তানের প্রতি যুগে যুগে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির এতো লোভ। দেশীয় রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নও এ সম্পদ গ্রাসের জন্যই। দেশের মানুষের সবচেয়ে বিশ্বস্ত দরদি যোগ্য ও আল্লাহভীরু শক্তি হচ্ছে মাদরাসা ছাত্র তালেবান। উলামা মাশায়েখ ও সাধারণ মানুষ মিলে ২০ বছর যুদ্ধ করে আজ তারা দেশের ক্ষমতায়। এতো বিশাল অস্ত্র ভান্ডার আর খনিজ সম্পদ আফগান জনগণের। যাদের নেতৃত্ব দিচ্ছে পরাশক্তির আতংক তালেবান।
একজন মার্কিন সৈনিক সাজাতে গড়ে ৩০ লাখ টাকার সামরিক ইনস্ট্রুমেন্ট লাগে। অপরদিকে কাবুল বিজয়ের দিন বিশ্ব মিডিয়ার কল্যাণে পৃথিবীর মানুষ দেখতে পেয়েছে কাবলি ও পায়জামা পরা খালি পা তালেবান মুজাহিদদের। যারা বিশটি বছর পাহাড়ে পর্বতে খেয়ে না খেয়ে অনিশ্চয়তার জীবন কাটিয়েছে। অর্ধেক সাথী তাদের শহিদ হয়ে গেছে। তারা যখন কাবুল দখলের পর রাজপথে সেজদায় লুটিয়ে পড়ে কাঁদছিল, সে কান্নার কী অর্থ? এমন দীর্ঘ জিহাদের মাধ্যমে অর্জিত বিজয় ও সম্মানের কতবেশি তাৎপর্য? এশিয়ার বুকে নতুন ইসলামী বিজয়ী শক্তির উত্থানে দুনিয়াকে এ নিয়ে অবশ্যই নতুন করে ভাবতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন