শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

আন্তর্জাতিক সংবাদ

আবহাওয়া পরিবর্তনের কড়া মাশুল গুনছে যুক্তরাষ্ট্র

প্রতি তিনজনে একজন আবহাওয়া পরিবর্তনের শিকার

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ৭ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ১২:০২ এএম

আবহাওয়া পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব পড়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। চলতি বছর দেশটির প্রতি তিনজন নাগরিকের একজন আবহাওয়া পরিবর্তনের শিকার হয়েছেন। এখনই পদক্ষেপ না নিলে ভবিষ্যতে দেশটির নাগরিকরা আরও নজিরবিহীন দুর্যোগের মুখোমুখি হতে পারে বলে সতর্ক করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তিন মাস ধরেই একের পর এক প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন যুক্তরাষ্ট্র। গত সপ্তাহেই ইতিহাসের ভয়াবহতম বন্যা দেখল নিউজার্সি ও নিউইয়র্কবাসী। হারিকেন আইডার তান্ডবে লুইজিয়ানায় অন্তত ১০ লাখ মানুষ প্রায় এক সপ্তাহ বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় কাটিয়েছে। আইডার কারণে বিধ্বস্ত হয়েছে বা ভেসে গেছে অনেক স্থাপনা। আবার কয়েক হাজার মাইল দূরের অঙ্গরাজ্য পুড়ছে দাবানলে। এখনো দেশটির বিভিন্ন এলাকায় দাবানল অব্যাহত আছে। শুধু ক্যালিফোর্নিয়াতেই ৭ হাজারের বেশি দাবানলে পুড়েছে প্রায় ২০ লাখ একরের বেশি বনভ‚মি। দাবানল নিয়ন্ত্রণে চলতি বছরের বাকি সময় লেগে যেতে পারে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। এক বিশ্লেষণে ওয়াশিংটন পোস্ট জানিয়েছে, গত জুন থেকে এখন পর্যন্ত বৈরী আবহাওয়ার কবলে পড়ে দেশটিতে মারা গেছে প্রায় চারশ’ জন। এমনকি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের শিকার হয়েছে প্রতি তিনজন আমেরিকানের একজনকে। বিশ্লেষকরা বলছেন, আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণেই হারিকেন, বন্যা, দাবানলসহ নানা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির আবহাওয়া পরিবর্তন মোকাবিলায় কোনো ধরনের প্রস্তুতি নেই উল্লেখ করে তারা আরও বলেন, এখনই সময় যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার। প্রস্তুতি না নেওয়া হলে ভবিষ্যতে পরিণতি আরও খারাপ হবে বলেও সতর্ক করেন তারা। গত জুনে প্রচন্ড গরমে অসুস্থ হয়ে শত শত মানুষ হাসপাতালে ভর্তি হতে বাধ্য হয়। উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় শহরগুলোজুড়ে ওই সময় তাপমাত্রা রেকর্ড ১১৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট ছাড়িয়ে যায়। গত সপ্তাহে আঘাত হানা হারিকেন আইডার প্রভাবে লুইজিয়ানায় বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন হয় অন্তত ১০ লাখ মানুষ। ভারি বৃষ্টিতে সৃষ্ট বন্যায় পাঁচটি অঙ্গরাজ্যে মারা গেছে কমপক্ষে ৫১ জন। বিধ্বস্ত হয়েছে বা ভেসে গেছে অনেক স্থাপনা। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ইমার্জেন্সি ম্যানেজমেন্ট এজেন্সি ও ফ্লোরিডার ইমার্জেন্সি ম্যানেজমেন্ট ডিভিশনের সাবেক প্রধান ক্রেইগ ফিউগেট ওয়াশিংটন পোস্টকে বলেন, একই গ্রীষ্মে আবহাওয়ার এত বিপর্যয়কর ঘটনা তিনি এর আগে আর দেখেননি। চলতি গ্রীষ্মে একের পর এক এমন ঘটনা সংঘটিত হওয়া প্রসঙ্গে আবহাওয়া ও নীতিবিষয়ক বিশেষজ্ঞরা দ্য নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেন, এসব ঘটনা মোকাবিলার প্রস্তুতি যুক্তরাষ্ট্রের ছিল না। সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার শাসনামলে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের আবহাওয়াঝুঁকি মোকাবিলায় পরিকল্পনা তদারকির দায়িত্বে থাকা অ্যালিস হিল টাইমসকে বলেন, ‘এসব ঘটনা আমাদের এটিই বলছে, আমরা প্রস্তুত নই।’ সদস্য দেশগুলোর সঙ্গে বৈঠকে সোমবার (৯ আগস্ট) আইপিসিসি এর রিপোর্টটি পেশ করেন জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তেনিয়ো গুতেরেস। ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০০৮ সালে বিজ্ঞানীরা যা আঁচ করেছিলেন, তার চেয়ে এক দশক আগেই বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বিপজ্জনক জায়গায় পৌঁছে যেতে পারে। ২০৩০ সালের মধ্যে গোটা বিশ্বের সার্বিক তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পাবে। বিশ্ব উষ্ণায়নের জেরে ১৯০১ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত সমুদ্রের জলস্তর যেখানে প্রতি বছর ১.৩ মিলিমিটার করে বাড়ছিল, ২০০৭ থেকে ২০১৮ সালে তা বছরে ৩.৭ মিলিমিটারে গিয়ে ঠেকেছে। সামগ্রিক ভাবে ১৯০১ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত গোটা বিশ্বে পানিস্তরের গড় বৃদ্ধি ছিল ০.২০ মিটার। বর্তমানে আবহাওয়া পরিবর্তন কতটা উদ্বেগজনক জায়গায় পৌঁছেছে, তা বিশদভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে ওই রিপোর্টে। বলা হয়েছে, কোনও নির্দিষ্ট অঞ্চলের মধ্যে এই উষ্ণতা বৃদ্ধি সীমাবদ্ধ নেই। বিশ্বের সর্বত্র লাগাতার এই বৃদ্ধি ঘটছে। দ্রুত গতিতে উষ্ণতা বাড়লেও, তা শীতল হতে সময় লেগে যাচ্ছে অনেকটা, এত দিন যা লক্ষ করা যায়নি। বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণেই আবহাওয়া সহনশীলতার মাত্রা পেরিয়ে যাচ্ছে। তাই ১৯৫০ সালের পর থেকে তাপপ্রবাহের তীব্রতা লাগাতার বেড়ে চলেছে এবং আগের থেকে তা ঘন ঘন তাপপ্রবাহ বইছে। সেই তুলনায় শৈত্যপ্রবাহের তীব্রতা অনেক কম এবং ঘন ঘন তার প্রকোপে পড়তে হয় না বলে দাবি করেছেন বিজ্ঞানীরা। বিশ্ব উষ্ণায়নের জন্য মনুষ্যঘটিত কারণগুলোর ওপরই জোর দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। তাদের দাবি, শহর এলাকাগুলোই উষ্ণায়নের মূল কেন্দ্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। লাগাতার তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে উষ্ণ বাতাস সেখানে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে, যা শীতল হতে দীর্ঘ সময় লাগে। এই একই কারণে নদী, হ্রদ, জলাধার তো বটেই, গাছগাছালিতে ঘেরা সবুজ এলাকাগুলোতেও উষ্ণতা বহুক্ষণ দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে। এভাবে চললে, প্রতি ১০ বছরে এক বার বা প্রতি ৫০ বছরে এক বার যে তীব্র বন্যা কিংবা খরা হয়, আগামী দিনে তা আরও ঘন ঘন দেখা দেবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিজ্ঞানীরা। যে সব জায়গায় এই ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ সচরাচর চোখে পড়ে না, সেগুলিও বাদ যাবে না বলে জানিয়েছেন তারা। এমনকি একই জায়গায়, একই সময়ে তাপপ্রবাহ এবং খরা একই সঙ্গে দেখা দিলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না বলে মত তাদের। বিজ্ঞানীদের দাবি, আবহাওয়া পরিবর্তন এবং বাতাসের গুণমান এই দুটি বিষয় পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। তাই বিশ্ব উষ্ণায়নকে নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে একসঙ্গে দুটির দিকেই নজর দিতে হবে। সে ক্ষেত্রে ঘনবসতি, যত্রতত্র গগনচুম্বী অট্টালিকা নির্মাণে রাশ টানতে হবে। বাড়িঘর, রাস্তাঘাট নির্মাণের সরঞ্জামের দিকে নজর দিতে হবে। আরও বেশি করে সবুজ জঙ্গল, উদ্যান তৈরি করতে হবে। গার্হস্থ্য এবং শিল্পজনিত উষ্ণতাবৃদ্ধির কারণগুলোও খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নিতে হবে সব দেশের সরকারকে। জীবাশ্ম জ্বালানি, গ্রিন হাউস গ্যাসের নির্গমন কমিয়ে আনতে হবে। তাতে চলতি শতকের কিছুটা হলেও বিশ্ব উষ্ণায়নের রাশ টানা সম্ভব হবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন তারা। আমেরিকান মেটেওরজিক্যাল সোসাইটির গবেষক জেমস পি ব্রুস বলছেন, আবহাওয়া পরিবর্তন যদি শার্ক (হাঙর) হয়, পানি শার্কের (হাঙর) দাঁতের মতো কাজ করে। এখন শার্ক (হাঙর) সমুদ্রের ওপরে উঠে এসেছে, তাই আমরা এত ভোগান্তিতে আছি। চলতি বছরের গ্রীষ্মে বিভিন্ন অঞ্চলের ভয়াবহ এ তাপদাহ মানুষেরই সৃষ্টি। ওয়ার্ল্ড ওয়েদার অ্যাট্রিবিউশন প্রোজেক্ট বলছে, তাপদাহ এত ভয়াবহ পর্যায়ে গেছে মানুষের কার্বন নিঃসরণের কারণে। কারণ এ ধরনের তাপদাহ হাজার বছরে একবার হওয়ার কথা। ২০২১ সালের জুন মাস আমেরিকানদের জন্য রেকর্ড তাপদাহের মাস ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের অন্তত ১৩টি অঙ্গরাজ্যের বিভিন্ন স্থানে ৮০টির মতো দাবানল ছিল। ২০০০ সালের পর ১০টি বড় দাবানলের বছর ২০২১। এর কারণে যদি খরা হয়, খাদ্যপণ্যের দাম চলতি বছরই ৪০ শতাংশ বাড়বে। শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, আবহাওয়া পরিবর্তনের ভয়াবহতার সাক্ষী সারাবিশ্ব। জার্মানি বন্যায় ভেসে যাচ্ছে। মারা গেছে অনেক মানুষ, আর্থিক ক্ষতি ৭০০ কোটি ডলার। চীনের বন্যা পরিস্থিতিও ভয়াবহ। আবহাওয়ার বর্তমান অবস্থা বলছে, বৈশ্বিক উষ্ণতা আর ১ থেকে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়তে আর বেশি দেরি নেই। তাপদাহ মানেই পানি বাষ্পীভ‚ত হয়ে বাতাসে মিশে যাচ্ছে, অনেক বেশি বৃষ্টি হচ্ছে, ঋতুর পরিবর্তনের কোনো ধারাবাহিকতা থাকছে না। ফলাফল কোনো স্থানে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত, আবার কোনো স্থানে বৃষ্টিই হচ্ছে না। গবেষণা বলছে, যুক্তরাষ্ট্র, চীনের মতো বৃহত্তম অর্থনীতির দেশসহ অন্তত ৫৭টি দেশ অতিরিক্ত পানি সংকটে পড়বে। এর মধ্যে আছে মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা আর মধ্য এশিয়াও। ২০৪০ সালে পানি স্বল্পতার ভয়াবহতা দেখবে এ দেশগুলো। নিউইয়র্ক টাইমস।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন