একজন বিচারক এবং একজন মাত্র ড্রাইভার দিয়ে ২০০৭ সাল থেকে চলছে নরসিংদী নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল। জেলা ও দায়রা জজ পদমর্যাদার এই কোর্টটিতে আর কোনো জনবলের পদ-পদবিই নেই। জেলা আদালত থেকে একজন নিম্নমান সহকারীকে প্রেষণে এনে কোনো রকম চালু রাখা হয়েছে বিচার কার্যক্রম। ট্রাইব্যুনালটির সৃষ্টিলগ্ন থেকেই আর কোনো পদ সৃজন করা হয়নি। নিজস্ব একজন বেঞ্চ সহকারী, একজন স্টেনোগ্রাফারও না থাকায় অন্যান্য কার্যক্রমও চলছে কোনো রকম। ট্রাইব্যুনালটিতে হাজারের বেশি মামলা বিচারাধীন।
প্রায় অভিন্ন দশা রাজশাহী নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-২ এর। ২০০৪ সালে বিভাগীয় শহরের এই ট্রাইব্যুনালটি প্রতিষ্ঠিত হয়। অথচ সৃষ্টি করা হয়নি সহায়ক কোনো পদ। বিচারকের সঙ্গে একজন মাত্র ড্রাইভার ও উমেদার দিয়ে চালানো হচ্ছে কার্যক্রম। প্রয়োজনীয় স্টাফের অভাবে কার্যক্রম এখন মন্থর। জট লাগা মামলার সংখ্যা প্রায় আড়াই হাজার। দু’টি ট্রাইব্যুনালেই জনবল স্বল্পতার বিষয়ে বহুবার মন্ত্রণালয়কে অবহিত করা হয়েছে। কোনো আশু পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।
উপরোল্লিখিত দু’টি নারী ও শিশু ট্রাইব্যুনালের জনবল পরিস্থিতি দৃষ্টান্ত মাত্র। সারা দেশে অনেক নারী-শিশু ট্রাইব্যুনালের বাস্তবতা প্রায় অভিন্ন।
জেলা আদালতের একাধিক প্রশাসনিক কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপচারিতায় জানা যায়, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল চলতে হলে ন্যূনতম কিছু জনবল আবশ্যিকভাবেই প্রয়োজন। এর মধ্যে একজন বিচারক, একজন বেঞ্চ সহকারী, একজন স্ট্যানোগ্রাফার, দু’জন এমএলএসএস ও একজন ড্রাইভারের পদ থাকে। কোনো কোনো ট্রাইব্যুনালে অফিস সহায়ক, প্রসেস সার্ভার কিংবা জারিকারকের পদ রয়েছে। নৈশপ্রহরী এবং পরিছন্নতাকর্মীর পদও আছে কোনো কোনো ট্রাইব্যুনালে। কিন্তু সব ট্রাইব্যুনালে সমহারে জনবলের পদ নেই। এর ফলে মানুষের ভোগান্তি এখন চরমে। বিশেষ করে করোনাকালে পারিবারিক সহিংসতা ও নারী নির্যাতন বেড়েছে দেড় গুণ। ফলে মামলার চাপও বাড়ছে। অথচ সেই তুলনায় নেই জনবল নিয়োগের কাঠামো। এর চেয়েও বড় বাস্তবতা হচ্ছে, পারিবারিক সহিংসতা এবং নারী নির্যাতন ক্রমঃবৃদ্ধির তুলনায় নেই পর্যাপ্ত নারী নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল।
আইন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, দেশের অন্তত: ১৮টি জেলায় কোনো নারী নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল নেই। সূত্রমতে, নারী ও শিশু নির্যাতন দমনে ২০০০ সালের ১৪ ফেব্রæয়ারি প্রজ্ঞাপন হয় ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন’ এর। আইনটির ২৬(১) ধারায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে। তাতে উল্লেখ করা হয়, এই আইনের অধীন অপরাধ বিচারের জন্য প্রত্যেক জেলা সদরে একটি করিয়া ট্রাইব্যুনাল থাকিবে। প্রয়োজনে সরকার উক্ত জেলায় একাধিক ট্রাইব্যুনালও গঠন করিতে পারিবে। একইরূপ ট্রাইব্যুনাল ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল’ নামে অভিহিত হইবে। আইনের এই বাধ্যবাধকতা থেকে দেশের প্রতিটি জেলা সদরে একটি করে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল স্থাপনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। বাস্তবতা হচ্ছে, দেশের ৫৪টি বিভাগীয় ও জেলা শহরে ৯৫টি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ১৮টি জেলায় কোনো ট্রাইব্যুনাল নেই। বিদ্যমান ট্রাইব্যুনালগুলোতে জট লেগে আছে ২ লাখের বেশি মামলা। এর মধ্যে ৫ বছরের পুরোনো মামলাই রয়েছে ৪০ হাজারের বেশি। একটি বেসরকারি সংস্থার তথ্য মতে, করোনাকালে নারী নির্যাতন বেড়েছে দেড় গুণ। এ কারণে নারী নির্যাতন সংক্রান্ত মামলাও বেড়েছে। সর্বশেষ ২০১৭ সালে ৪১টি নারী নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের জন্য ২৪৬টি পদ সৃষ্টি করা হয়। এর মধ্যে ৪১ জন স্টেনোগ্রাফার, স্টেনোগ্রাফার ৪১ ৪১টি ড্রাইভার পদ এবং ৪১টি অফিস সহায়কের পদ সৃজন করা হয়। এছাড়া ওইবছর ১৬ জুন ৪১টি। অফিস সহায়ক ৪১ জন। ৫৩টি নারী নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে অফিস সহায়কের পদ আউট সোর্সিং থেকে রাজস্ব খাতে স্থানান্তর করা হয়। সে সময় ট্রাইব্যুনালের সংখ্যাও বাড়ানো হয়। তখন বলা হয়, সব জেলায় ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চলছে। তবে চার বছর অতিক্রান্ত হলেও অবশিষ্ট জেলায় ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা হয়নি। সর্বশেষ তথ্য মতে, রাজবাড়ী, গোপালগঞ্জ, মাগুরা, ফেনী, ল²ীপুর, রাঙামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, লালমনিরহাট, পঞ্চগড়, জয়পুরহাট, নড়াইল, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, পিরোজপুর, ঝালকাঠি ও ভোলায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যনাল নেই। জেলা জজই এসব জেলায় অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছে। এসব জেলায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে দায়েরকৃত অন্তত ১ লাখ ৬০ হাজার মামলা বিচারের অপেক্ষায় রয়েছে। এ হিসেবে প্রতিটি আদালতে নারী ও শিশু নির্যাতন সংক্রান্ত অন্তত ১০ হাজার মামলার জট সৃষ্টি হয়েছে। বেসরকারি একটি সংস্থার হিসেব মতে, দায়েরকৃত মামলার মাত্র ৩ দশমিক ৬৬ শতাংশ মামলা নিষ্পত্তি হচ্ছে। এসব মামলায় গড়ে সাজা পাচ্ছেন ৪ জন আসামি। অধিকাংশ আসামিও খালাস পেয়ে যাচ্ছে।
ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে মামলা পরিচালনাকারী সিনিয়র অ্যাডভোকেট মাহবুবুর রহমান ইনকিলাবকে বলেন, নারী নির্যাতন মামলাগুলো নানা কারণে বিলম্বে দায়ের হচ্ছে। এসব তদন্তেও লাগছে সময়। এর ফলে মামলা আলামত নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সাক্ষীদেরও যথাসময়ে আদালতে পাওয়া যায় না। এ কারণে অপরাধীরা ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে।
সুপ্রিম কোর্ট বারের অ্যাডভোকেট মো. রেজাউল করিম বলেন, আইনের বিধান অনুযায়ী নারী ও শিশু নির্যাতন মামলার বিচার ১৮০ দিনের (ছয় মাস) শেষ করার কথা। তদন্ত শেষ করতে হবে ৯০ দিনের মধ্যে ওই সময়ের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি না হলে ট্রাইব্যুনালকে কারণ জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টে ৩০ দিনের প্রতিবেদন দাখিল করে একটি অনুলিপি সরকারকে পাঠানোর কথা। তদন্তের ক্ষেত্রেও এ ধরনের বিধান রয়েছে। তা সত্তে¡ও এ ধারায় দায়েরকৃত মামলাগুলো যথাসময়ে প্রসিকিউট হচ্ছে না। আদালত স্বল্পতা এবং আদালতে জনবল সঙ্কটও অন্যতম বড় একটি কারণ। সিনিয়র এই আইনজীবী আরও বলেন, করোনায় নারী নির্যাতন দেড় গুণ বাড়লেও বাড়েনি ট্রাইব্যুনাল। সময়ানুগ ব্যবস্থা না নিলে মামলা জট আরও বাড়বে। তিনি বলেন, উপযুক্ত সাক্ষী, চার্জশিট জটিলতা এবং প্রভাবশালী মহলের হস্তক্ষেপে কারণে তদন্ত প্রভাবিত হচ্ছে।
নারী নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল সৃষ্টি এবং বিদ্যমান ট্রাইব্যুনালে জনবল সঙ্কটের বিষয়ে জানতে গতকাল রোববার সন্ধ্যায় আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তিনি কোনো সাড়া দেননি। মন্ত্রণালয়ের বিচার বিভাগের সচিব মো. গোলাম সারোওয়ারও ফোনে সাড়া দেননি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন