সম্প্রতি দেশের প্রাচীনতম বাংলা দৈনিক ইত্তেফাকে বিশিষ্ট সঙ্গীত শিল্পী সাদিয়া আফরিন মল্লিকের এক সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। যার শিরোনাম ছিল : নজরুলের অনেক গান হারিয়ে যাচ্ছে। এটা আমাদের জন্য অত্যন্ত দু:খজনক ও দুর্ভাগ্যজনক তথ্য। কারণ, নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের জাতীয় কবি। জাতীয় কবির অনেক গান হারিয়ে যাওয়ার অর্থ হলো, আমাদের স্বাধীন জাতীয় সত্তা অনেকটা দুর্বল হয়ে যাওয়া।
নজরুল ইসলামের রচনা এবং কবিতা ও গানে স্বাভাবিকভাবেই যেমন এসেছে হিন্দু বিষয়াবলী, তেমনি এসেছে মুসলিম বিষয়াবলী। এদিক দিয়ে আমরা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম উল্লেখ করতে পারি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন শুধু বাঙ্গালীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম কবি নন, তিনি সমসাময়িক বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠতম কবি ছিলেন। নোবেল প্রাইজ জয় করে তিনি বাংলাভাষাকে সারাবিশ্বের অন্যতম প্রধান ভাষার মর্যাদা নিশ্চিত করে যান। তবে তিনি একটি বিষয়ে তাঁর সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠতে পারেননি। বাঙ্গালী মুসলমানদের সমাজ-জীবন ও ঐতিহ্য নিয়ে খুব কমই কবিতা ও গান রচনা করেন তিনি। বাঙ্গালী মুসলমানদের কোন স্বপ্ন, আশা-আকাক্সক্ষা বা ঐতিহ্যচেতনা তাঁর সৃষ্টিতে স্থান লাভ করতে পারেনি। সাংবাদিক-সাহিত্যিক আবুল মনসুর আহমদ এ বিষয়ে দু:খ করে বলে গেছেন, বিশ্বকবির আকাশে ঈদের চাঁদ উঠতো না।
পক্ষান্তর নজরুল ছিলেন এরূপ সংকীর্ণতার বহু ঊর্ধ্বে। তিনি যেমন একজন মুসলমান হিসাবে লিখেছেন অসংখ্য ইসলামিক কবিতা ও গান, তেমনি লিখেছেন অসংখ্য হিন্দু ঐতিহ্যের কবিতা ও গান। এ কারণে তিনি ছিলেন, হিন্দু ও মুসলিম উভয় ধর্ম সম্প্রদায়ের কাছে সমান জনপ্রিয় ও শ্রদ্ধেয়।
এর প্রমাণ পাওয়া যায় হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের কবিতা-প্রেমিকদের কাছে তাঁর গ্রহণযোগ্যতার মধ্যদিয়ে। রবীন্দ্রনাথ নোবেল প্রাইজ লাভের মাধ্যমে যখন সমগ্র বিশ্বেই খ্যাতি লাভ করেন, সে সময় কলিকাতা অ্যালবার্ট হলে তদানীন্তন অবিভক্ত বাংলার শ্রেষ্ঠ হিন্দু মুসলমান বুদ্ধিজীবিদের উদ্যোগে নজরুলকে বাঙালী জাতির পক্ষ থেকে সম্বর্ধনা দেয়া হয়। সংবর্ধনা সভায় যারা ছিলেন তাদের মধ্যে যেমন ছিলেন এম. ওয়াজেদ আলী, সৈয়দ বদরুদ্দোজা প্রমুখ নেতৃস্থানীয় মুসলিম, তেমনি ছিলেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু প্রমুখ হিন্দু ব্যক্তিত্ব। মোটের উপর নজরুল ইসলাম ছিলেন এমন এক কবি, যিনি বাঙ্গালী হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের কাছে সমান গ্রহণযোগ্য ও শ্রদ্ধেয়। এছাড়া আরেকটি বিষয়ে ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও নজরুল ইসলামের মধ্যে পার্থক্য ছিল বিশেষভাবে লক্ষ্যযোগ্য। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন বংশগতভাবে জমিদার। অপর পক্ষে নজরুল ইসলাম ছিলেন দারিদ্র্যের সাথে যুদ্ধরত একজন কবি। রবীন্দ্রনাথের জমিদারীর অবস্থান ছিল মুসলিম অধ্যুষিত পূর্ব বঙ্গে। তিনি যে এলাকায় জমিদারী করেছেন, সে এলাকার সাধারণ মানুষদের শিক্ষা ও সংস্কৃতির উন্নতির লক্ষ্যে বলতে গেলে প্রায় কিছুই করেননি। তিনি জমিদারী করে অশেষ ধনসম্পদের মালিক হয়েছেন পূর্বঙ্গ থেকে। আর সে সম্পদে পশ্চিমবঙ্গে গড়ে তোলেন বিশ্বের অন্যতম শিক্ষা ও সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠান বিশ্বভারতী।
এসব কারণে অনেকে তাঁকে সাম্প্রদায়িক বলতে চাইলেও, আমরা তাঁদের সাথে সুর মিলাতে রাজী নাই। বরং তাঁকে বিশ্বকবি হিসাবে তাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে যাওয়ার পক্ষপাতী।
আরেকটি বিষয়ের প্রতি আমরা পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও নজরুল ইসলাম উভয়ে জন্ম গ্রহণ করেন সাম্রাজ্যবাদী বৃটিশ শাসনামলে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মৃত্যুবরণও করেন বৃটিশ শাসনামলে। নজরুল ইসলাম যদিও বৃটিশশাসন থেকে আমাদের মুক্তি লাভের পর বেঁচে ছিলেন, তবে এক দুরারোগ্য রহস্যজনক রোগে আক্রান্ত হওয়ায় তিনি কথা বলার বা লেখার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন বৃটিশ শাসন আমলেই। ফলে তিনিও প্রকৃত অর্থে বৃটিশ আমলেই মৃত্যুবরণ করেন। একারণে তাঁর কবি-জীবনের সমাপ্তি ঘটে বৃটিশ শাসন আমলেই। এসব কারণে তাঁর কবিজীবন সীমাবদ্ধ হয়ে যায় ঐ দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হওয়ার পরই। তবে এই সীমাবদ্ধ জীবনের মধ্যে তিনি জাতির সাংস্কৃতিক বিকাশের জন্য যে অবদান রেখে গেছেন, তাঁকে অনেকে বাঙ্গালী ও বাংলাদেশের সংস্কৃতির পিতা বলার পক্ষপাতী। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনৈতিক পিতা। আমরা উপরে যে মন্তব্য করলাম, তার সপক্ষে কোন যুক্তি ও তথ্য নেই, এমনটা হতে পারে না। ১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাবে অবিভক্ত ভারতবর্ষকে হিন্দু ও মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলসমূহে বিভক্ত করে দুই মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় দুটি স্বতন্ত্র স্বাধীন দেশ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব য়েদিন গৃহীত হয়, সেদিনই নজরুল ইসলাম ছুটে গিয়েছিলেন তদানীন্তন বাঙ্গালী মুসলমানদের মুখপত্র কলিকাতার দৈনিক আজাদ অফিসে। অনাগত পূর্বাঞ্চলের স্বতন্ত্র, স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের প্রতি তাঁর দ্ব্যর্থহীন সমর্থন জ্ঞাপন করতে একটি কবিতা নিয়ে তিনি সেখানে গিয়েছিলেন। কবিতাটির শিরোনাম ছিল ‘মোবারকবাদ’। এই কবিতার মাধ্যমে তিনি পূর্বাঞ্চলে মুসলিম প্রধান, স্বতন্ত্র ও স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের প্রতি অভিনন্দন জ্ঞাপন করেন। তার মধ্যে ছিল সেই অনাগত রাষ্ট্রের নাগরিকদের প্রতি সমর্থন। অনাগত রাষ্ট্রের নাগরিকদের ছোট থেকেই গড়ে তোলার লক্ষ্যে দৈনিক আজাদের জন্য ‘মুকুলের মাহফিল’ নামের একটি ছোটদের বিশেষ পাতা খোলার প্রস্তাবও দিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, এই পাতার প্রথম পরিচালক ও তিনি ঠিক করে দেন বিখ্যাত শিশু-সাহিত্যিক মোহাম্মাদ মোদাব্বেরকে। সেই প্রস্তাব মোতাবেকই দৈনিক আজাদে ‘মুকুলের মাহফিল’ নামের একটি শিশু-কিশোরদের পাতা খোলা হয়। এই ‘মুকুলের মাহফিল’ তদানীন্তন শিশু কিশোরদের সাংস্কৃতিকভাবে গড়ে তোলার কাজে ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করে। পাশাপাশি মুকুল ফৌজ নামের একটি শিশু-কিশোর সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে তোলা হয়, যার প্রথম পরিচালক ছিলেন বিখ্যাত শিল্পী কামরুল হাসান। পাকিস্তান আন্দোলনে শিশু-কিশোরদের এই সংগঠন শিশু-কিশোরদের সংগঠিত করার গুরু দায়িত্ব পালন করেন তিনি। এসব তথ্য পাওয়া যাবে মোহাম্মদ মোদাব্বের রচিত ‘সাংবাদিকের রোজনামচা’ নামক পুস্তকে। এভাবেই পাকিস্তান আন্দোলনে তদানীন্তন পূর্ববঙ্গ তথা আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার কাজে শিশু-কিশোরদের সক্রিয় অংশগ্রহণ বাস্তবে নিশ্চিত করা হয়।
পরিশেষে যে কথাটি বলে আজকের এ লেখার সমাপ্তি টানতে চাই তা হলো, পৃথিবীতে বড় ঘটনা রাতারাতি ঘটতে পারে না। এর জন্য সময় লাগে এবং জনগণের সাথে পথ চলতে হয়। একথা যেমন অন্যান্য বড় ঘটনার জন্য সত্য, তেমনি সত্য স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মত বড় ঘটনার জন্য। যদি ১৯৪৭ সালে অখন্ড দেশ হিসাবে তদানীন্তন ভারতবর্ষ যদি স্বাধীন হতো, তাহলে আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ বলে কোন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব হতো না। ১৯৪০ সালে লাহোর শহরে মুসলিম লীগের যে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় যা ‘লাহোর প্রস্তাব’ হিসাবে ইতিহাসে স্থান লাভ করে আছে, তা উত্থাপিত হয়েছিল তদানীন্তন জনপ্রিয়তম নেতা শেরে বাংলা এ. কে ফজলুল হক কর্তৃক। পরবর্তীকালে ফজলুল হক এক পর্যায়ে মুসলিম লীগ ত্যাগ করলেও হোসেন শহীদ সোহরওয়াদী এবং তার একান্ত সমর্থক শেখ মুজিবুর রহমান এই পাকিস্তান আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যান। তাদের ঐকান্তিক চেষ্টা ও সংগ্রামের ফল হচ্ছে, তদানীন্তন পাকিস্তান এবং আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ। এর একটি ঘটনার সাথে আরেকটি ঘটনা ছিল নিবিড় ভাবে সংশ্লিষ্ট। যদিও পাকিস্তান আন্দোলনে আজকের বাংলাদেশের অবদান ছিল সর্বাধিক, পরবর্তীকালে পাকিস্তান বাস্তবে প্রতিষ্ঠিত হলে তার একাধিক রাজধানী এবং প্রতিরক্ষা বাহিনী (সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমান বাহিনী) সব কিছুর প্রধান দফতর প্রতিষ্ঠিত হয় তদানীন্তন পাকিস্তানের পশ্চিমাঞ্চলে। অবিভক্ত পাকিস্তানের পশ্চিমাঞ্চলে সমস্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হলে অবিভক্ত পাকিস্তানের যাত্রা শুরু হয় পাকিস্তানের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতাদের অবহেলার মাধ্যমে। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠেন পাকিস্তানের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম শহীদ সোহরওয়াদীর একান্ত অনুগত শিষ্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। জনগণ লাহোর প্রস্তাবের বিধানের আলোকে রাষ্ট্র ব্যবস্থা কায়েম করতে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হয়। শেখ মুজিবসহ যারা পাকিস্তান আন্দোলন করতেন, তারা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলতেন, পাকিস্তান (স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র) হবে দু’টি। একটি পূর্বে, আরেকটি পশ্চিমে। ভারতীয় উপমহাদেশের সেই পূর্বাঞ্চলের পাকিস্তানই আজকের বাংলাদেশ। এই আন্দোলনের যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন তাদের প্রতি রইল আমাদের আন্তরিক সমর্থন ও অভিনন্দন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন