শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

উপ সম্পাদকীয়

স্বাধীন বাংলাদেশ কি ভারতের সৃষ্টি

প্রকাশের সময় : ৬ অক্টোবর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মোহাম্মদ আবদুল গফুর : উনিশশো একাত্তরে এদেশে কি কোনো মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল? সেই যুদ্ধের মাধ্যমেই কি বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল? একশ্রেণীর ভারতীয় নেতা মনে করেন বাংলাদেশকে স্বাধীন করে দিয়েছিল ভারত। সম্প্রতি ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী বলেছেন, ভারতই বাংলাদেশকে স্বাধীন করে দেয়। অর্থাৎ বাংলাদেশ নামক স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যুদ্বয়ের পেছনে বাংলাদেশের জনগণের কোনো অবদান নেই। নেই বাংলাদেশের বীর মুক্তিযোদ্ধাদেরও। স্বাধীন বাংলাদেশের সৃষ্টির সবটুকু কৃতিত্ব ভারতের। ভারতের একশ্রেণীর নেতানেত্রীর ধারণা, ভারতই স্বাধীন বাংলাদেশের প্রকৃত ¯্রষ্টা। বঙ্গবন্ধুসহ বাংলাদেশের নেতৃবৃন্দ যে দাবি করে থাকেন বাংলাদেশের জনগণের মরণপণ লড়াই ও ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে এসব দাবি ভিত্তিহীন। এসব বক্তব্যের কোনো বাস্তব মূল্য নেই। এ কথা সত্য যে, একাত্তরে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের একপর্যায়ে ভারতীয় বাহিনী তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধরত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল। তাতে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ ত্বরান্বিত হয়েছিল। তবে বাস্তব সত্য এই যে, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের স্বাধীনতা তথা মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয় উনিশশো একাত্তরের মার্চের অসহযোগ আন্দোলনের সময় থেকেই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ৭ মার্চের ভাষণের পর থেকেই বাংলাদেশে কার্যত পাকিস্তানি শাসনের অবসান হয় । ক্যান্টনমেন্ট ছাড়া দেশের অন্যান্য সব কিছু পরিচালিত হচ্ছিল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সংগ্রাম পরিষদের মাধ্যমে।
আসলে একাত্তরের ২৫ মার্চের অভিশপ্ত রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নৃশংস ক্র্যাক ডাউনের পর দেশের সমগ্র জনগোষ্ঠীই ফুঁসে উঠেছিল পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে। কেউ কেউ নিজেদের নিরাপত্তার জন্য দেশ ছেড়ে প্রতিবেশী দেশ ভারতে আশ্রয় নেয়। যাদের পক্ষে তা সম্ভব হয়ে ওঠেনি তারা নিজেদের বাড়িঘর ছেড়ে দেশের মধ্যেই এক এক দিন এক এক জায়গায় অবস্থান করে কোনোভাবে প্রাণ বাঁচাতে চেষ্টা করে। এই কঠিন অবস্থায়ই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিবাহিনী গড়ে উঠতে থাকে।
এই বাহিনীতে যোগ দেয় পাকিস্তানি বাহিনীর বাঙালি সদস্যবৃন্দ, পুলিশ ও আনসার, ভিডিপি সদস্যবৃন্দ, স্বাধীনতাকামী বহু তরুণও মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়ে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মুক্তিবাহিনীতে গেরিলা পদ্ধতিতে যুদ্ধ চালানোর ফলে পাকিস্তানি বাহিনী দ্রুত দুর্বল হয়ে পড়তে থাকে। ফলে কয়েক মাসের মধ্যেই তারা নিজেদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে ক্যান্টনমেন্ট ও শহরাঞ্চলে তাদের অবস্থান সীমাবদ্ধ করে রাখে। এভাবে সময় এগিয়ে যেতে থাকে এবং বাংলাদেশে পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থা দ্রুত দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে পড়ার পর একাত্তরের একেবারে শেষ প্রান্তে এসে ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।
এই পটভূমিতে অল্পসময়ের মধ্যে পাকিস্তানের পরাজয় ছিল অবশ্যম্ভাবী। কারণ যুদ্ধে বিজয়ের জন্য শুধুকোনো সেনাবাহিনীর শৌর্যবীর্য, রণকৌশল বা ব্যবহৃত অস্ত্রশস্ত্রের উচ্চমানই যথেষ্ট নয়, যে জনপদে যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে সেখানকার জনগণের সহযোগিতা বা অসহযোগিতার বিষয়টাও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। সে নিরিখে একাত্তরের সেই যুদ্ধকালে এদেশের সমগ্র জনগণ যাদের বিরুদ্ধে জীবনমরণ সংগ্রামে সক্রিয় অংশ নিচ্ছে তাদের বিজয়ের তেমন কোনো প্রশ্নই ওঠে না। আমাদের জনগণের এ মুক্তিযুদ্ধে বিজয় যখন নিশ্চিতভাবে আসন্ন তখন ভারত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে সেই নিশ্চিত বিজয়ের ভাগীদার হয় মাত্র। কিন্তু ভারত সে সময়ও মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সমর্থন ঘোষণা করে তা বাংলাদেশকে একটি প্রকৃত স্বাধীন রাষ্ট্র গড়ে তোলার লক্ষ্যে নয়, তা বোঝা যায় এসময়ে বাংলাদেশের অস্থায়ী অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তির বিভিন্ন দফা থেকে।
বাংলাদেশের অস্থায়ী মুজিবনগর সরকারকে ভারতের জমিনে পেয়ে ভারত ওই সরকারকে এমন এক সাত দফা চুক্তি স্বাক্ষরে বাধ্য করে যার মধ্যে ছিল :
(এক) মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে মুক্তিবাহিনী ভারতীয় সেনাবাহিনীর কমান্ডের অধীনে থাকবে।
(দুই) বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ভারতীয় সেনা বাহিনী বাংলাদেশে অবস্থান করবে। (কতদিনের জন্য তা নির্দিষ্ট ছিল না)।
(তিন) স্বাধীন বাংলাদেশের কোনো নিজস্ব সেনাবাহিনী থাকবে না।
(চার) বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের মধ্য হতে একটি বাহিনী গঠন করা হবে।
(পাঁচ) যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি এমন সকল সরকারি কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করা হবে। প্রয়োজনে ভারতীয় কর্মকর্তা দিয়ে শূন্য স্থান পূরণ করা হবে।
(ছয়) বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে অবাধ সীমান্ত বাণিজ্য চলবে।
(সাত) বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়নকালে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাহায্য নেয়া হবে।
এই জাতিবিরোধী চুক্তি স্বাক্ষরে বাধ্য হওয়ার পরপরই অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম অসুস্থ হয়ে পড়েন।
[দ্রষ্টব্য : বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে র’ এবং
সিআই-এর ভূমিকা : মাসুদুল হক]
ভারতের নেতৃবৃন্দের সম্ভবত ধারণা ছিল যে, পাকিস্তানের কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আর জীবিত ফিরে আসবেন না। তাদের এ ধারণা অমূলক প্রমাণ হয়ে গেল যখন দেখা গেল পাকিস্তানি কারাগার থেকে শেখ মুজিব জীবিত মুক্তি পেলেন। তিনি মুক্তি পেয়ে প্রথমে লন্ডনে চলে গেলেন। লন্ডনে থাকতেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মুজিবনগর সরকারের সঙ্গে স্বাক্ষরিত ভারতের সাত দফা চুক্তি সম্পর্কে অবহিত হন এবং এ ব্যাপারে তাঁর ইতিকর্তব্য ঠিক করে ফেলেন। পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে লন্ডন হয়ে ঢাকা প্রত্যাবর্তনকালে নয়াদিল্লিতে সংক্ষিপ্ত যাত্রাবিরতিকালে প্রথম সুযোগেই বঙ্গবন্ধু ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে জিজ্ঞাসা করেনÑ ম্যাডাম, আপনি কখন বাংলাদেশ থেকে আপনার বাহিনী ফিরিয়ে আনবেন? ইন্দিরা জবাবে বলেন, আপনি যখন বলবেন তখনই।
বলাবাহুল্য, তখন শেখ মুজিবের যে বিপুল জনপ্রিয়তা, তাতে ইন্দিরা গান্ধীর পক্ষে আর কোনো বিকল্প চিন্তা করার অবকাশ ছিল না। অবশ্য বাংলাদেশের কয়েকজন অমুসলিম মন্ত্রী সেসময় ইন্দিরা গান্ধীকে অনুরোধ করেছিলেন, তিনি যেন বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সৈন্য সরিয়ে না নেন। কিন্তু বাস্তববাদী ইন্দিরা গান্ধী তাদের এই বলে বিদায় দিয়েছিলেন যে, ইয়ে না-মুমকিন হায়। অর্থাৎ এটা সম্ভব নয়।
এখানে একটি বিষয় বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। সেটা হলো পাকিস্তানি কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবিত অবস্থায় মুক্ত হয়ে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করতে পারা। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তনের মুহূর্তেই তিনি তদানীন্তন অবস্থা মোতাবেক বাংলাদেশকে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র বলে ঘোষণা দেন। শুধু তাই নয়। পরবর্তীকালে পাকিস্তানের লাহোরে ওআইসি সামিটে যোগদানের আমন্ত্রণ পেলে তিনি ওই সামিটে যোগদানের প্রশ্নে দ্বিধায় পড়েন। কারণ ভারত তার বিরোধিতা করেছিল। শেখ সাহেব তখন মওলানা ভাসানীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এ বিষয়ে তাঁর পরামর্শ কামনা করেন। মওলানা ভাসানী পরোক্ষ পরামর্শ দিয়ে বলেন, তুমি যদি স্বাধীন দেশের নেতা হয়ে থাক, তা হলে যাও, নইলে ওরা যা বলে তা-ই কর।
বঙ্গবন্ধু তার কাক্সিক্ষত জবাব পেয়ে লাহোরে ওআইসি সামিটে যোগদান করতে গেলেন। যেদিন তিনি লাহোরে ওআইসি সামিটে যোগ দিতে যান, সেদিন নয়াদিল্লিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কুশপুত্তলিকা দাহ করা হয়। অথচ এর আগের দিন পর্যন্ত ভারতে তার মর্যাদা ছিল দেবতুল্য। তখন তাঁর কুশপুত্তলিকা দাহ করার বিষয় কল্পনা করাও ছিল অসম্ভব। এসব কথা বলা হলো এ জন্য যে, একশ্রেণির ভারতীয় নেতার ধারণা, ভারত বাংলাদেশের স্বাধীনতা এনে দিয়েছিল এর মধ্যে যে চূড়ান্ত সত্য নেই সেটা প্রমাণ করতে। এ কথা সত্য যে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের একপর্যায়ে ভারত আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সমর্থন জানিয়েছিল। সে কারণে আমাদের স্বাধীনতা অর্জন ত্বরান্বিত হয়। এ জন্য আমরা ভারতের প্রতি কৃতজ্ঞ। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, ভারত সম্পূর্ণ নিঃসার্থভাবে আমাদের সাহায্য দানে এগিয়ে এসেছিল। উপমহাদেশে একটি বৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তান ভেঙে ফেলা ভারতের স্বার্থের অনুকূল ছিল। তাছাড়া বহুদিন উপমহাদেশে কোনো মুসলিম শক্তির পরাজয় দেখার সৌভাগ্য হয়নি বলে যে আফসোস ছিল তদানীন্তন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সে আফসোসের জ্বালারও কিছুটা উপশম হয় একাত্তরে। এ কারণেই একাত্তরের ইন্দিরা গান্ধী একপর্যায়ে বলতে পেরেছিলেন : হাজার সাল কা বদলা লিয়া (হাজার বছরের প্রতিশোধ নিয়েছি)।
একাত্তরে বাংলাদেশের একটি স্বতন্ত্র স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে অভ্যুদয়ের ঘটনাকে অবশ্য ভারতের অনেক ইন্দিরা-বিরোধী নেতা ভালো চোখে দেখেননি। তারা বলেন, ইন্দিরার পিতা একটি পাকিস্তান সৃষ্টির ব্যবস্থা করেছিলেন। আর ইন্দিরা দুই পাকিস্তান সৃষ্টির ব্যবস্থা করেছেন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
Maleq Forazi ৩১ অক্টোবর, ২০১৬, ৫:১৬ পিএম says : 0
Fantastic.
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন