‘নির্বাচন খুব ভালো হয়েছে। আই অ্যাম স্যাটিসফায়েড’। কথাগুলো বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের প্রধান কে এম নূরুল হুদার। ৩০ জুলাই অনুষ্ঠিত বরিশাল, রাজশাহী ও সিলেট সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের ভোট গ্রহণ শেষ হওয়ার পর নিজ দফতরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি উপরোক্ত মন্তব্য করেছেন, যা পরদিন দেশের সব সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।
সিইসি নূরুল হুদার বক্তব্য সচেতন মানুষদের বিস্ময়ে বিমূঢ় করে দিয়েছে। সন্ত্রাস কবলিত একটি নির্বাচনকে তিনি কি করে ‘ভালো নির্বাচন’ বললেন এবং ওই নির্বাচনে তার সন্তুষ্টি প্রকাশ করলেন, তা এখন সবার কাছে একটি বিরাট প্রশ্ন। কেননা, ভোটের দিন ওই তিন মহানগরীতে যা যা ঘটেছে, তার বিবরণ ইতোমধ্যেই দেশ-বিদেশে সবাই অবগত হয়েছেন। কেন্দ্র দখল, ব্যালট পেপার ছিনতাই, সকাল ৯ টা থেকে ১০টার মধ্যে মেয়র পদের ব্যালট ফুরিয়ে যাওয়া, বিরোধী প্রার্থীর এজেন্টদের কেন্দ্রে ঢুকতে না দেয়া, যারা সাহস করে কেন্দ্রে গিয়েছিল তাদের মারধর করে বের করে দেয়া, পাইকারি হারে সরকার দলীয় প্রার্থীর মার্কায় সীল মারা যদি ভালো নির্বাচনের নমুনা হয়, তাহলে অবশ্য বলার কিছু থাকে না। বাংলাদেশের সব মানুষ যদি বোকা বা বুদ্ধি-জ্ঞানহীন হতো, তাহলে না হয় তারা সিইসির কথা বিনা বাক্য ব্যয়ে মেনে নিত। কিন্তু সেটা তো সম্ভব নয়। কারণ, দেশবাসী এখন অনেক সচেতন এবং সজাগ। তাছাড়া তথ্য-প্রযুক্তির কল্যাণে দেশ-বিদেশের কোথায় কি ঘটছে তা মুহূর্তেই সবার গোচরে চলে আসে। ফলে ৩০ জুলাই তিন সিটিতে কোথায় কি ঘটেছে, তা টিভি চ্যানেলগুলোর স্পট রিপোর্টিংয়ের সুবাদে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সবাই জেনে গেছে। তো এ অবস্থায় প্রধান নির্বাচন কমিশনারের ওই বক্তব্য যদি কেউ মানতে না পারে, তাহলে তা দোষের কিছু হবে বলে মনে হয় না।
কেমন হলো তিন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন? এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে আমরা এর প্রেক্ষাপটটি একটু বিবেচনায় নিতে পারি। আমাদের জাতীয় সংসদ নির্বাচন সন্নিকটে। বড় জোর পাঁচ মাস বাকি। সে নির্বাচনের ঠিক আগ মুহূর্তের এ নির্বাচনকে ঘিরে সবার মধ্যেই আগ্রহ-ঔৎসুক্য সৃষ্টি হয়েছিল। অনেকেই মনে করেছিলেন, এ নির্বাচন থেকে প্রধান দুই দলের বর্তমান জনপ্রিয়তার আভাস পাওয়া যাবে, একই সঙ্গে বর্তমান নির্বাচন কমিশন একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে কতটা সক্ষম তারও একটা ধারণা পাওয় যাবে। বলাই বাহুল্য, যেভাবে যে প্রক্রিয়ায় শেষ পর্যন্ত নির্বাচনটি সম্পন্ন হয়েছে, তাতে বিএনপি- আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া সম্ভব হয় নি। নূরুল হুদা কমিশন যে একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে একেবারেই অক্ষম তাও দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে গেছে।
বিরোধী দল, বিশেষত বিএনপির পক্ষ থেকে বার বার বলা হচ্ছে যে, বর্তমান নির্বাচন কমিশন মেরুদন্ডহীন, তার নিজস্ব কোনো চলৎশক্তি নেই। সরকারের ইচ্ছানুযায়ী নড়াচড়া করে, কাজকর্ম সারে। মৌখিক কঠোরতা অবলম্বন করলেও কার্যক্ষেত্রে হয়ে যায় মোমের মতো। সরকার বা সরকারি দলের লোকজনের হুকুমের অল্প তাপেই গলতে শুরু করে; এক সময় মিশে যায় মাটির সঙ্গে, আর তার হুংকার, হম্বিতম্বি বাষ্প হয়ে বাতাসের সাথে মিশে যায়।
রাজনীতি সচেতন ব্যক্তিগণ আশা করেছিলেন যে, অন্তত জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে এই তিন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে নির্বাচন কমিশন আন্তরিক হবে। কারণ এ নির্বাচনে ইসির ভ‚মিকার ওপর বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থার বিষয়টি অনেকাংশে নির্ভরশীল ছিল। তাছাড়া ফলাফল যাই হোক, তাতে সরকার পরিবর্তন বা পতনের কোনো আশঙ্কা ছিল না। সবাই ধরে নিয়েছিলেন যে, সিটি কর্পোরেশন তিনটির মেয়র পদ দখলের জন্য সরকার অতটা উদগ্রতা হয়তো দেখাবে না। কিন্তু সবার চিন্তা ভাবনাকে অসার প্রমাণ করে সরকার এমন দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করল, যা কারো ধারণায় ছিল না। যদি বলা হয়, সরকার এবং নির্বাচন কমিশনের যৌথ প্রযোজনায় ৩০ জুলাই তিন মহানগরীতে নির্বাচন নামের এক অঙ্কের নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে, তাহলে কি সেটা খুব অসঙ্গত হবে?
ওই রকম মনে করাটা যে অসঙ্গত নয়, তার চিত্র ফুটে উঠেছে পরবর্তীতে পত্র-পত্রিকার রিপোর্টে। গত ১ আগষ্ট একটি দৈনিকে তিন সিটি নির্বাচনের ওপর যে দু’টি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তাতে ওই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্নকে আরো শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করিয়েছে। পত্রিকাটির প্রধান প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাজশাহী ও সিলেটে অস্বাভাবিক হারে ভোট পড়েছে। রাজশাহীতে ১৩৮ কেন্দ্রের মধ্যে ১২টিতে ৯০ থেকে ৯৭ দশমিক ২০ শতাংশ এবং ৫৮টিতে ৮০ শতাংশ বা তারও বেশি ভোট পড়েছে। আর সিলেটে কোথাও ১৯ আবার কোথাও ৯১ দশমিক ৯৭ শতাংশ ভোট পড়েছে। ভোট পড়ার এ হারকে অস্বাভাবিক উল্লেখ করে বিশিষ্টজনেরা বলেছেন, নির্বাচনে যে জালিয়াতি, কেন্দ্র দখল ও কারচুপি হয়েছে তার প্রমাণ হচ্ছে এ অস্বাভাবিক ভোট।
অপরদিকে তিন সিটির ভোট জনগণকে হতাশ করেছে বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন দেশের বিশিষ্ট নাগরিকগণ। তারা বলেছেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এ ধরণের প্রশ্নবিদ্ধ এবং বিতার্কত নির্বাচন দেখে মানুষের মধ্যে একই সঙ্গে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার সৃষ্টি হয়েছে। পাশাপাশি ভোট অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে আয়োজনে ইসি পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট রাজনীতিক ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. কামাল হোসেন বলেছেন, ‘ভোট নির্বিঘœ করতে নির্বাচন কমিশন পুরোপুরি ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তিন সিটিতে নির্বাচন নিয়ে যা হলো, তাতে ভবিষ্যতে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য ভোট নিয়ে জনমনে সংশয়-সন্দেহ আরো দৃঢ় হবে।’ সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, ‘তিন সিটি নির্বাচনে অনিয়মের যে দৃশ্য দেখা গেছে, তাতে প্রতীয়মান হচ্ছে, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচন কমিশন তাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। এ প্রতিষ্ঠানটি ব্যাপকভাবে জনআস্থা হারিয়েছে।’ বিশ^বিদ্যালয় শিক্ষক ও কলাম লেখক ড. তারেক শামসুর রেহমান বলেছেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে একটি ভালো ভোট হওয়া দরকার ছিল। তা কিন্তু হয় নি। বিশেষ করে বরিশালে ভোটের নামে যা হয়েছে, তা নজিরবিহীন। এটাকে ভোট না বলে প্রহসন বলা যেতে পারে। নির্বাচন কমিশন এ প্রহসনের ভোট মঞ্চস্থ করেছে।
দেশের বিশিষ্ট নাগরিকদের উপরোক্ত মন্তব্য তিন সিটি নির্বাচনের বাস্তব চিত্রের পরিষ্কার প্রতিফলন বলা যায়। তারা তাদের অভিজ্ঞতা দিয়ে সেদিনের ঘটনাসমূহ পর্যালোচনা করেই অভিমত দিয়েছেন। বলাটা অত্যুক্তি হবে না যে, বর্তমান নির্বাচন কমিশন অতীতের যে কোনো কমিশনের চেয়ে অধিকতর অথর্বতার পরিচয় দিয়ে চলেছে। সিইসি যা বলেন আর যা করেন, তার মধ্যে মিল খুঁজে পাওয়া যায় না কখনোই। সরকার বা সরকারি দলের চাওয়া পাওয়ার দিকে দৃষ্টি রেখেই তিনি ও তার কমিশন পা ফেলেন, হাত নাড়েন-এমন অভিযোগ সচেতন মানুষদের। তারা মনে করেন, সিইসি তার নেয়া শপথ থেকে অনেকটাই সরে এসেছেন। শপথ অনুযায়ী তার সংবিধানের প্রতি বিশ^স্ত থেকে নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করার কথা। কিন্তু এ যাবতকালের কাজকর্মে তিনি ও তার কমিশন সরকারের প্রতি অনুগত থাকারই প্রমাণ দিয়েছে। এর দ্বারা যে তিনি নিজেকে এবং নির্বাচন কমিশনকে বিতর্কিত করে তুলেছেন এবং এই সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটির প্রতি জনগণের আস্থা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে এনেছেন তা বোধকরি খেয়াল করেন নি।
তিন সিটির নির্বাচন প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে তৃপ্ত করতে পারলেও জনগণকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। কারণ তারা দেখেছে ৩০ জুলাই তিন মহানগরীতে কী ধরণের ভোট জালিয়াতি ও অনিয়মের দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে। নির্বাচন যদি ভালোই হয়ে থাকবে তাহলে ১৮টি কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ স্থগিত করতে হলো কেন? কেন রাজশাহীর মেয়র প্রার্থী মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল নিজের ভোট না দিয়ে ভোট কেন্দ্র দখল ও জালিয়াতির প্রতিবাদে কেন্দ্রের মাঠে বসে থাকলেন? বিভিন্ন কেন্দ্রে বিএনপির এজেন্টরা কেন ঢুকতে বা অবস্থান করতে পারল না? ভোট কী রকম হয়েছে তার নমুনা তো রয়েছে বরিশালের অপর মেয়র প্রার্থী ডা. মনীষা চক্রবর্তীর প্রতিবাদে। তিনি একটি কেন্দ্রে প্রবেশ করে পোলিং অফিসারের সামনে থাকা নৌকায় সীল মারা ব্যালট বই ক্যামেরার সামনে তুলে ধরেছেন। তীব্র ভাষায় ভর্ৎসনা করেছেন মুখ কাচুমাচু করে বসে থাকা পোলিং অফিসারকে। তিনি প্রশ্ন করেছেন, আপনারা না শিক্ষিত? তাহলে এটা করলেন কীভাবে? ডা. মনীষা চক্রবর্তীর সে সাহসী প্রতিবাদের ভিডিও ক্লিপ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে ছড়িয়ে গেছে বিশ^ব্যাপী। এর মাধ্যমে বিশ^বাসীও প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পেল সিইসি নূরুল হুদার ভালো নির্বাচনের একটু নমুনা।
তিন সিটি নির্বাচনের পর দেশের সংবাদপত্রসমূহে এতদসংক্রান্ত যেসব সম্পাদকীয় বেরিয়েছে, তার কোথাও এ নির্বাচনকে শান্তিপূর্ণ, সুষ্ঠু ও অবাধ বলা হয় নি। বরং এটাকে নির্বাচনের নামে এক ধরণের তামাশা হিসেবেই চিত্রিত করা হয়েছে। পত্রিকাগুলো ভোট নিয়ে সিইসির সন্তোষ প্রকাশকে বিস্ময়কর আখ্যা দিয়ে বলেছে, এখানে আত্মতৃপ্তির কোনো অবকাশ নেই। বরং উত্থাপিত অভিযোগ এবং প্রকাশ্যে সংঘটিত অনিয়মসমূহের যথাযথ তদন্ত করে সন্তোষজনক প্রতিবিধানের দিকে নির্বাচন কমিশনের অধিকতর মনোযোগ দেয়া উচিত যাতে ভবিষ্যতে এসব ত্রæটি-বিচ্যুতি কাটিয়ে উঠে জাতীয় নির্বাাচন সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি নেয়া যায়।
সিইসি বা নির্বাচন কমিশনের কাছে এসব অভিমতের খুব একটা মূল্য আছে বলে মনে হয় না। অন্তত বিগত দিনগুলোর ঘটনাবলী তাই বলে। নইলে সর্বজনস্বীকৃত একটি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনকে সিইসি ভালো নির্বাচন বলতে পারতেন না, আর তা সম্পন্ন করে আত্মতৃপ্তিও লাভ করতে পারতেন না। এ মুহূর্তে আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট আব্রহাম লিংকনের একটি উক্তি মনে পড়ছে। তিনি বলেছিলেন-‘কিছু মানুষকে সব সময়ের জন্য, আর সব মানুষকে কিছু সময়ের জন্য বোকা বানিয়ে রাখা যায়। কিন্তু সব মানুষকে সব সময়ের জন্য বোকা বানিয়ে রাখা যায় না।’ তিন সিটি নির্বাচনকে ভালো বলার সময় সিইসি মহোদয় বোধকরি এ সত্যটি বিস্মৃত হয়েছিলেন।
লেখক: সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন