শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

উপ সম্পাদকীয়

পাকিস্তানের জাতীয় নির্বাচন : জাতীয় ও আঞ্চলিক বাস্তবতা

জামালউদ্দিন বারী | প্রকাশের সময় : ১ আগস্ট, ২০১৮, ১২:০৫ এএম

পাকিস্তানের জাতীয় নির্বাচনে শাহবাজ শরীফের নেতৃত্বাধীন মুসলিমলীগ(নওয়াজ), ভ‚ট্টো পরিবারের কান্ডারি বিলাওয়াল ভট্টোর নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান পিপলস পার্টি, জামায়াতে ইসলামিসহ পাকিস্তানের পুরনো ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দলগুলোকে পেছনে ফেলে সাবেক ক্রিকেটার ইমরান খানের তেহরিক-ই-ইনসাফ(পিটিআই) দলের বিজয়ী হওয়ার মধ্য দিয়ে উপমহাদেশের রাজনীতিতে একটি নতুন মেরুকরণ শুরু হল। দক্ষিণ চীন সাগরের সমুদ্রসীমা বিরোধ, নিরাপত্তা ও আধিপত্যের লড়াইয়ে চীনের কৌশলগত মূল প্রতিদ্বন্দি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হলেও ভারত ও পাকিস্তানের মত দুই পারমানবিক শক্তির অবস্থান এখানে বড় ধরনের অনুঘটকের ভ‚মিকা পালন করছে। পাকিস্তানের গতানুগতিক রাজনীতিতে যে সব রাজনৈতিক দল গত প্রায় ৭ দশক ধরে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখছে তেহরিক-ই ইনসাফ তথা পিটিআিই সে ধারার চাইতে কিছুটা ব্যতিক্রমী ইমেজ নিয়েই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। মোল্লাতন্ত্রের বাইরে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত ও বিশ্বনন্দিত ক্রিকেটার পাকিস্তানকে ক্রিকেটার বিশ্ব শিরোপা এনে দেয়ার নায়ক ইমরান খান এখন পাকিস্তানকে নতুন সম্ভাবনার দিগন্তে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখাচ্ছেন। ইমরান খানের বিজয়ের মধ্য দিয়ে পাকিস্তান একই সঙ্গে একটি বড় সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড়াতে যাচ্ছে। নির্বাচনী সহিংসতা ও আত্মঘাতি হামলার কারণে গত ২৫ জুলাই অনুষ্ঠিত নির্বাচনের আগেই ২ টি আসনে নির্বাচন স্থগিত করে দেয় পাকিস্তান নির্বাচন কমিশন। সে হিসেবে ২৭২টি আসনের মধ্যে ১৩৭টি আসন পাওয়া দল সরকার গঠনের সুযোগ লাভ করবে। পঁচিশে জুলাই অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের জাতীয় নির্বাচনে তেহরিক-ই-ইনসাফ ১২০টি আসন নিয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলেও অন্য দুটি প্রধান দল মুসলিমলীগ(এন) ৬৫ এবং পিপিপি’র (৪৩) প্রাপ্ত আসনের চেয়ে বেশী হওয়ায় ইমরান খানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনা অনেকটাই নিশ্চিত হয়ে যায়। ইমরান খানের দলের প্রতি পাকিস্তানের জনগণের এই ম্যান্ডেট সেখানকার ক্ষমতার রাজনীতিতে দ্বি-দলীয় বৃত্ত ভেঙ্গে দিয়েছে। অনেকে এর জন্য পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর সমর্থন ও ভ‚মিকার কথা বললেও নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় সব দল এবং সাধারণ মানুষের ব্যাপক অংশগ্রহণ, নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত¡াবধায়ক সরকার এবং শক্তিশালী ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের স্বাধীন ও নিরপেক্ষ ভ‚মিকা পালনের মত সমন্বিত বাস্তবতাকে অস্বীকার করা যাবেনা। একটি নবাগত দলের কাছে প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলোর এমন হোঁচট খাওয়ার মত ঘটনা সামলে নেয়া তাদের জন্য কঠিন। নির্বাচনে কারসাজি ও ভোট জালিয়াতির যে অভিযোগ পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলো তুলেছে পরোক্ষভাবে এ ধরনের বির্তকের সাথে সেনাবাহিনীকেও জড়িয়ে ফেলতে চাইছে। তবে এবারের সফল নির্বাচনের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানে তৃতীয় বারের মত গণতান্ত্রিক নির্বাচন এবং ক্ষমতার শান্তিপূর্ণ পালাবদল ঘটতে যাচ্ছে। পাকিস্তানের বিগত ৭০ বছরের রাজনৈতিক ইতিহাসে বার বার সামরিক শাসন এবং বিশৃঙ্খল রাজনৈতিক বাস্তবতায় এটি অনেক বড় অর্জন। কোন রাজনৈতিক দলের প্রতি সামরিক বাহিনীর নিরব সমর্থন থাকলে থাকতেও পারে। মিয়ানমার ও পাকিস্তানের মত সামরিক বাহিনী প্রভাবিত দেশগুলোর রাজনৈতিক পরিবর্তন পুরোপুরি গণতান্ত্রিক ধারায় প্রতিষ্ঠিত হতে কিছুটা সময় লাগতেই পারে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে তার সুবিধামত উপায়ে বিকশিত হতে দেয়ার মধ্যেই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য।
ক্রিকেটার থেকে সম্ভাবনাময় রাজনৈতিক নেতা বনে যাওয়া ইমরান খানকে রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকেই এক ধরনের বিতর্ক ও বৈপরীত্য মোকাবেলা করতে হয়েছে। ক্রিকেট থেকে অবসর নেয়ার পর ১৯৯৬ সালে তেহরিক-ই-ইনসাফ বা জাস্টিস মুভমেন্টস দল গঠনের পর ২২ বছরের মাথায় নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতার ম্যান্ডেট লাভ করল দলটি। এই ২২ বছরে ইমরান খানকে নানা চড়াই-উৎরাই পার হতে হয়েছে। তার রাজনৈতিক সম্ভাবনা আঁচ করেই প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে তার সম্পর্কে নানা অপবাদ প্রচার করা হয়েছে। ইসলামি রাজনীতি, ইসলামি মূল্যবোধের পক্ষে ইমরান খানের শক্ত অবস্থান এবং তালেবান ও মোল্লাতন্ত্রের প্রতি সমর্থনের কারণে তথাকথিত লিবারেলরা তাঁকে মৌলবাদি বা মোল্লাতন্ত্রি খেতাব দিতে দেখা গেছে। আবার সাদা চামড়ার খৃস্টান নারীকে বিয়ে করা, ক্লিন শেভড, ইংরেজী শিক্ষিত ইমরান খানকে অনেকে ইহুদিদের এজেন্ট বলে অপবাদ দিতেও ছাড়েনি। বিভিন্ন সময়ে টেলিভিশনে দেয়া সাক্ষাৎকারে এসব বিষয়ে নিজের খোলামেলা মতামতও দিয়েছেন ইমরান খান। তিনি বরাবরই ইসলামী আদর্শের পক্ষে নিজের আপসহীনতা, কায়েদে আজম ও আল্লামা ইকবালের স্বপ্নের পাকিস্তান গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করে এসেছেন। আল্লামা ইকবালকে পাকিস্তানের স্বপ্নদ্রষ্টা আখ্যায়িত করে ইকবালের কবিতায় কোরানিক শিক্ষা ও অনুপ্রেরণার প্রসঙ্গে ইমরান খানের দৃষ্টিভঙ্গির কারণে পাকিস্তান বিদ্বেষীরা তাকে জঙ্গিবাদ-মৌলবাদী শক্তি হিসেবে চিহ্নিত করতে সচেষ্ট দেখা গেছে। পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আক্বীদা ও তাহজিব-তামাদ্দুন সংরক্ষণের মধ্য দিয়েই তিনি বার বার জাতীয় ঐক্য, আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক মুক্তির কথা বলেছেন। এসব রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে ইমরান খান পাকিস্তানের ধর্মীয়-রাজনৈতিক স্বাতন্ত্র্যের ভিত্তি এবং সমকালীন বাস্তবতা ও সম্ভাবনার সমন্বয় ঘটাতে সক্ষম হয়েছেন। তাঁর নেতৃত্বে দৃঢ়তা সেখানকার সাধারণ মানুষের প্রত্যাশাকে স্পর্শ করেই তাদের আস্থা আদায় করে নিতে সক্ষম হয়েছে। ভোটের রাজনীতিতে প্রথম হিসেবে ২০০২ সালের নির্বাচনে জাতীয় নির্বাচনে একটি মাত্র আসন পেলেও খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশে অভাবনীয় সাফল্য লাভের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের ভবিষ্যত রাজনীতিতে উজ্জ্বল সম্ভাবনা হিসেবে আর্বিভ’ত হয়েছিল তেহরিক-ই-ইনসাফ। দ্বিতীয় ধাপে ২০০৮ সালের প্রথমদিকে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে সরকার এবং নির্বাচন কমিশনের যোগসাজশসহ নানা অনিয়মের অভিযোগে প্রকাশ্য সংবাদ সম্মেলনে নিজের মনোনয়নপত্র ছিঁড়ে ছুড়ে ফেলে দেয়ার মধ্য দিয়ে নির্বাচন বর্জনের ঘোষনা দেন। তার এই দৃঢ় ও আত্মপ্রত্যয়ী ভ’মিকা সাধারণ মানুষের কাছে কিভাবে মূল্যায়িত হয়েছিল তা বুঝা যায় ২০১৩ সালের নির্বাচনে। সে নির্বাচনে পপুলার ভোটের হিসাবে দ্বিতীয় এবং আসন সংখ্যার হিসেবে তৃতীয় স্থান লাভ করেছিল পিটিআই। তবে খাইবার পাখতুনখোয়ায় পিটিআই প্রাদেশিক সরকার গঠনের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের সবচে বড় জাতিগত গোষ্ঠি পাশতুনদের সমর্থন ভবিষ্যতে পাকিস্তানের রাজনীতিতে ইমরান খানের পিটিআই একটি অনিবার্য শক্তি হয়ে ওঠার জানান দিয়েছিল। ২০১৩ সালে জাতীয় নির্বাচনে ইমরান খান অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে জাতির সামনে যে ৬টি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তা যে কোন দেশে ভোটারদের সাধারণ প্রত্যাশার চেয়ে অনেক বেশী কিছু। জনগনের কাছে যে কোন দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের এমন প্রতিশ্রুতি প্রত্যাশিত ও আকাঙ্খিত বিষয়। লাহোরের ইকবাল পার্কে লক্ষাধিক জনতার সামনে তেহেরিক-ই-ইনসাফ দলের সমাবেশে ইমরান খান একটি নতুন পাকিস্তান গড়ার প্রত্যয়ে পাকিস্তানের জনগনকে যে সব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন তা হচ্ছে: ১. আমি পাকিস্তানের জনগনের কাছে সর্বদা সত্য কথা বলব, ২.পিটিআই একদিন সরকার গঠণ করবে এবং সেদিনই পাকিস্তানে অন্যায় অবিচারের পরিসমাপ্তি হবে, ৩. আমি কখনো আমার সম্পদ পাকিস্তানের বাইরে নিয়ে যাব না, ৪. আমি সরকারে থাকলে কখনোই ব্যক্তিগত স্বার্থ দেখব না এবং আমার কোন নিকটাত্মীয়কেও আমার ক্ষমতার দ্বারা স্বার্থ হাসিলের সুযোগ দেব না, ৫. আমি আপনাদের দেয়া রাজস্ব ও রাষ্ট্রীয় সম্পদের সর্বোচ্চ হেফাজত করব, এবং ৬. পাকিস্তানের ভেতরে অথবা বাইরে আমি সর্বদাই পাকিস্তানী স্বার্থের পক্ষে দাঁড়াব। রাজনীতিতে পর্দাপণের শুরু থেকে ক্ষমতায় অবর্তীণ হওয়ার সন্ধিক্ষণ পর্যন্ত ইমরান খান কখনো তার রাজনৈতিক প্রতিশ্রæতির বিপরীত কিছু করেছেন, এমনটা কখনো শোনা যায়নি।
গত ২৫ জুলাইয়ের নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশন, তত্তাবধায়ক সরকার বা সেনাবাহিনীর ভ’মিকা নিয়ে কেউ কোন সন্দেহ বা সংশয় প্রকাশ করেনি। নির্বাচনে সাবেক ক্ষমতাসীনদের ভরাডুবির পরই ভোট রিগিংয়ের সরব অভিযোগ শোনা যায়। নির্বাচন পর্যবেক্ষণে দেশি-বিদেশি অর্ধলক্ষাধিক পর্যবেক্ষক দায়িত্ব পালন করেছিল। ফলাফল ঘোষনার আগ পর্যন্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিদেশী পর্যবেক্ষকরা প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় অবাধ, নিরপেক্ষ ও সফল নির্বাচনের কথা বললেও ক্ষমতার মসনদ পাল্টে যাওয়ার আশঙ্কার মধ্যে ভরাডুবির শিকার প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর কারচুপির অভিযোগ উত্থাপিত হওয়ার পর কিছু বিদেশী নির্বাচন পর্যবেক্ষক এবং বিদেশী গণমাধ্যমকে ভিন্ন সুরে কথা বলতে শোনা যাচ্ছে। ভোটের মাঠে নির্বাচনে জয় লাভের জন্য অনেক কিছুই বলা হয়। তবে পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদের দেশি-বিদেশী কুশীলবদের খুশি রেখে তৃতীয়বিশ্বে জনগনের পক্ষে কাজ করা কঠিন। বর্তমান বাস্তবতায় মধ্যপ্রাচ্য ও মসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোতে প্রায় অসম্ভব। এ ক্ষেত্রে এবারের নির্বাচনে তেহরিক-ই-ইনসাফ দলের নির্বাচনী ইশতেহারের প্রতিশ্রæতিতে গালভরা বা আকাশকুসুম কিছু না থাকলেও পাকিস্তান, ভারত বা বাংলাদেশের বাস্তবতায় ইমরান খানের নির্বাচনী ইশতেহারের ঘোষনাগুলো ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যমন্ডিত। দেশের প্রশাসন, রাজনীতি, অর্থনীতি, কৃষি ও পানি সমস্যার সমাধান, সাংস্কৃতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক অবস্থার পরিবর্তনে ইমরান খানের সংক্ষিপ্ত(১১ দফা)নির্বাচনী প্রতিশ্রæতির সাথে অন্য দলগুলোর প্রতিশ্রুতির মত নয়। তা ছাড়া পিএমএল(এন) বা পিপিপি’র মত দলগুলো ক্ষমতায় থেকে পরিবর্তনের প্রতিশ্রæতি পালন বা নতুন সম্ভাবনা জাগানোর ক্ষেত্রে সাফল্য-ব্যর্থতার খতিয়ান জনগনের অভিজ্ঞতায় রয়েছে বলেই হয়তো তাদের চেয়ে ইমরান খানের প্রতিশ্রæতিশীল নেতৃত্বের প্রতি জনগনের আস্থার প্রতিফলন ঘটেছে। পাকিস্তানের ৭০ বছরের ইতিহাসে ইমরান খানই একমাত্র জাতীয় নেতা যিনি ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির ৫টি আসনে নির্বাচন করে ৫টিতেই বিপুল ভোটে জয়লাভ করতে সক্ষম হয়েছেন। অতীতের নির্বাচনগুলোতে, বিভিন্ন জনসমাবেশে, গণমাধ্যমের সাক্ষাৎকারে পাকিস্তানের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংকট মোকাবেলায় যে সব মতামত, বক্তব্য ও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তার মধ্য দিয়ে তার দৃঢ় ইচ্ছার প্রতিফলন দেখা গেছে। মোদ্দা কথা হচ্ছে, রোড টু নয়া পাকিস্তান শিরোনামে পিটিআই’র নির্বাচনী মেনিফেস্টো পাকিস্তানী জনগনের প্রত্যাশা ও বাস্তবতার সমন্বিত প্রতিফলন ঘটেছে। কারারুদ্ধ নওয়াজ শরীফ বা বেনজির ভুট্টো ও জারদারি পরিবারের নবীন নেতৃত্বের প্রতি মানুষের যে আবেগ সহানুভ‚তি থাকার কথা ইমরান খানের নতুন পাকিস্তান গড়ার প্রত্যয় অনেক বেশী সাবলীল ও শক্তিশালী ছিল। ভোটে বিজয় নিশ্চিত হওয়ার পর ইমরান খান তার অগ্রাধিকার পরিকল্পনা হিসেবে যে সব বিষয় সামনে নিয়ে এসেছেন তা হচ্ছে, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা। ইমরান খান সরকারের মন্ত্রী, এমপি ও আমলাদের ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবনের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার ঘোষনা দিয়েছেন। এ প্রক্রিয়ায় তিনি নিজেকে দিয়েই প্রথম স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা শুরু করতে চান। একটি ভঙ্গুর ও ঝুঁকিপূর্ণ রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক জটিল আবর্তে অনিশ্চিত পাকিস্তানকে নতুন সম্ভাবনাময় পাকিস্তানের পথে নিয়ে যাওয়ার সুকঠিন, চ্যালেঞ্জিং দায়িত্ব বাস্তবায়নে যে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও জাতীয় ঐক্য থাকা প্রয়োজন এই মুহূর্তে তা অনুপস্থিত। নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যানের মধ্য দিয়ে সে সংকট আরো ঘনীভ‚ত হওয়ার আশঙ্কা করছেন কেউ কেউ। আর পাকিস্তানের আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক প্রতিপক্ষ শক্তিগুলোর তরফ থেকেও নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে হতাশা ও বিতর্কিত ভ‚মিকা দেখা গেছে। অর্থাৎ পাকিস্তানে যে ধরনের সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে তাদের স্বার্থ রক্ষিত হতে পারত, ইমরান খান হয়তো সে ধরনের কেউ নন। পরিবর্তনের প্রত্যাশায় উদগ্র নতুন প্রজন্মের পাকিস্তানীদের জন্য এটাই হচ্ছে ভরসার জায়গা।
গত কয়েকদিনে কিছু দেশি-বিদেশী গণমাধ্যমে পাকিস্তানের নির্বাচন নিয়ে যে সব মূল্যায়ণ দেখা যাচ্ছে তাতে মনে হতে পারে পাকিস্তানের নির্বাচনে সেখানকার গণতন্ত্রের মুন্ডুপাত ঘটেছে। অন্যদিকে পাকিস্তানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী ও অংশদার চীনের পক্ষ থেকে একটি সফল নির্বাচনের জন্য পাকিস্তানের জনগন এবং সরকারকে অভিনন্দন জানানো হয়েছে। উল্লেখ্য, ইমরান খানের নির্বাচনী মেনিফেস্টোতে সিপিইসি বা চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর বাস্তবায়নে সুনির্দ্দিষ্ট প্রতিশ্রæতি আছে। পাকিস্তানের নির্বাচিত সরকারের এমন রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক এজেন্ডাই হয়তো চিরবৈরী ও গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী দেশ ভারতের রাজনৈতিক পক্ষগুলোর জন্য এক ধরনের অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সামরিক শাসনের বদলে পাকিস্তানে ধারাবাহিক তৃতীয়বারের মত গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতার পালা বদল ঘটতে চলেছে, ভারত বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিকে অগ্রাহ্য করে বিরোধিদলগুলোর হাইপোথেটিক্যাল রাজনৈতিক ইস্যুকে বেশী গুরুত্ব দিতে দেখা গেছে। এমনকি আমাদের দেশেও কিছু কিছু গণমাধ্যম পাকিস্তানের নির্বাচন নিয়ে ভারতীয়দের সুরে কথা বলতে ও বিচার-বিশ্লেষণ করতে দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশে অংশগ্রহণমূলক, গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য সর্বদলীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে নির্বাচনকালীন তত্ত¡াবধায়ক সরকার ব্যবস্থা গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেছিল। নির্দলীয় তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত কোন নির্বাচনেই ক্ষমতাসীনরা পুনরায় নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ পায়নি। একই ঘটনা ঘটছে পাকিস্তানেও। এ কারণে পাকিস্তানের ক্ষমতাসীনরা নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থার বদলে নিজেদের অধীনে একতরফা নির্বাচনের জন্য জাতীয় ঐকমত্য ও সমঝোতা ভন্ডুল করে প্রহসণের নির্বাচন করে ক্ষমতাকে অনির্দ্দিষ্টকাল পর্যন্ত দীর্ঘায়িত করলে পাকিস্তানে কী অবস্থা দাঁড়াতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। তবে বাংলাদেশে বর্তমান সরকারের রাজনৈতিক অবস্থান এবং আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে আরেকটি একতরফা নির্বাচনের আশঙ্কার মধ্য দিয়ে দেশে যে নতুন রাজনৈতিক পরিস্থিতির আলামত পাওয়া যাচ্ছে দেশের গণতন্ত্রকামী নাগরিকদের জন্য তা খুবই উদ্বেগের বিষয়। কিছু ভারতীয় মিডিয়ার পদাঙ্ক অনুসরণ করে বাংলাদেশের কিছু গণমাধ্যমও পাকিস্তানের নির্বাচনে সেখানকার বিরোধিদলের ফলাফল প্রত্যাখ্যানসহ নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগগুলোর সাথে সুর মেলাতে দেখা গেলেও বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থার হালহকিকত এবং আগামী ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিতব্য একাদশ জাতীয় নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য করার বিষয়ে তাদের যেন তেমন মাথাব্যথা নেই। বিগত একতরফা নির্বাচন প্রতিরোধে বিরোধি জোটের কঠোর অবস্থানের মধ্যেও দেশের একশ্রেণীর মিডিয়া ও নাগরিক সমাজের ভ‚মিকা ও নিরবতা ছিল গণতন্ত্র পরিপন্থী। তবে জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নয়ন সহযোগি দেশগুলো অংশগ্রহণমূলক ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে রাজনৈতিক সংলাপ ও সমঝোতার জন্য ক‚টনৈতিক চাপ বৃদ্ধি করেও কোন ফল হয়নি। বাংলাদেশে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনী পরিবেশ নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আহবান, প্রত্যাশা ও মধ্যস্থতা নিস্ফল হওয়ার পেছনে কাজ করেছে একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের প্রতি ভারতের জোরালো পক্ষপাতমূলক ভ‚মিকা। দু’একটি বিচ্ছিন্ন ব্যতিক্রম বাদ দিলে গত পাঁচ বছরে দেশের কোন স্থানীয় নির্বাচনই অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠিত হয়নি। ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা পরিষদ নির্বাচনেও ৫ জানুয়ারীর মত বিনা প্রতিদ্ব›িদ্বতা, ভোটারবিহীন ও কেন্দ্র দখলের মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হয়েছে। গত সোমবার ৩ সিটি নির্বাচন ছিল তারই সর্বশেষ নজির। বিরোধি রাজনৈতিকদল ও মত দমনের মধ্য দিয়ে যখন প্রতিবাদের কণ্ঠ ও শক্তিকে স্তব্ধ করে দেয়ার সরকারী পরিকল্পনা অনেকটাই সফল হয়ে যায়ম তখন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে গণমাধ্যমই হচ্ছে একমাত্র ভরসার জায়গা। পাকিস্তানে ইমরান খান ও তেহরিক-ই-ইনসাফ দল বিজয়ী হওয়ার পর ভারতীয় কিছু সংখ্যক গণমাধ্যমকে নিরপেক্ষতার নীতির বরখেলাপ করতে দেখা গেছে। ভোটের ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার পর মিডিয়ার সামনে দেয়া প্রথম বক্তব্যেই এ প্রসঙ্গে কথা বলেছেন ইমরান খান। তিনি বলেন,‘ গত কিছুদিন ধরে কিছু সংখ্যক ভারতীয় গণমাধ্যমের ভ‚মিকা দেখে কষ্ট পেয়েছি, তাদের কাছে আমার উপস্থিতি ছিল বলিউড ফিল্মের ভিলেনের মত। তাদের প্রচার দেখে মনে হয়েছে ইমরান খান ক্ষমতায় আসলে ভারতের জন্য খারাপ কিছু ঘটে যাবে। অথচ আমিই একমাত্র পাকিস্তানী যে কিনা ভারতকে আপন করে জানি। আমি সে দেশের সর্বত্র গিয়েছি।” জাতীয় নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী হওয়ার পর এটি ছিল ইমরান খানের প্রথম বক্তব্য। এ উপমহাদেশে শান্তি ও সমৃদ্ধির সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হলে ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের সরকার, রাজনৈতিক শক্তি ও গণমাধ্যমগুলোকে ক্ষমতাকেন্দ্রিক একগুয়েমী পরিহার করে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, আঞ্চলিক শান্তি, নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার স্বার্থে সমঝোতা ও সম্মানজনক অবস্থান গড়ে তুলতে হবে।
bari_zamal@yahoo.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন