মিয়ানমারে শত শত বছর ধরে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের বিতাড়ন পর্ব এখনও শেষ হয়নি। রোহিঙ্গাদের অপরাধ তাদের কথাবার্তায় বাংলা ভাষার প্রভাব রয়েছে। তাদের দ্বিতীয় ও আরো বড় অপরাধ তারা ধর্ম বিশ্বাসে মুসলমান। আর মিয়ানমারের নাগরিক বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। বাংলাদেশের অধিকাংশ নাগরিক ধর্মাবিশ্বাসে মুসলমান হলেও দেশের পূর্বদিকের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে মিয়ানমারের সীমান্তঘেঁষা এলাকায় বাস করেন বেশ কিছু সংখ্যক বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। এটা অত্যন্ত স্বাভাবিক।
বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলে মিয়ানমারের সীমান্তঘেঁষা এলাকায় পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে যেমন বাস করেন বেশ কিছু বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী, তেমনি মিয়ানমারের দক্ষিণ-পশ্চিম এলাকায় আরাকান অঞ্চলে বাস করেন বেশ কিছু বাংলা ভাষাভাষী মুসলমান। ড. মুহম্মদ এনামুল হক প্রমুখ পন্ডিত ব্যক্তিদের গবেষণাধর্মী রচনায় আরাকান রাজসভায় বাংলাভাষা ও সাহিত্যের মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত থাকার বিষয় আমরা জানতে পেরেছি।
এই স্বাভাবিকতার সুবাদেই মিয়ানমারের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে বাংলাদেশের পূর্ব-দক্ষিণ সীমান্ত ঘেঁষা মিয়ানমারের সমুদ্র উপকূল এলাকায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ বাস করেন যারা বাংলা ভাষাভাষী এবং ধর্ম পরিচয়ে মুসলমান একে কিছুতেই অস্বাভাবিক মনে করা যায় না। এভাবেই বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ভারতের আসাম রাজ্যে এমন বহু লোক শত শত বছর ধরে বসবাস করে যারা বাংলাভাষাভাষী এবং ধর্মীয় পরিচয়ে মুসলমান।
এদের এই দুটি পরিচয়ই যথেষ্ট নয়। আসাম এক সময় ছিল বন-জঙ্গলে পরিপূর্ণ মনুষ্যবাসের অনুপযোগী একটি এলাকা। বাংলাদেশের বৃহত্তর ময়মনসিংহ, রংপুর প্রভৃতি অঞ্চল থেকে যাওয়া কৃষকরাই আসামের বন-জঙ্গল সাফ করে আবাদ করে এবং আসামকে মনুষ্যবাসোপযোগী করে তোলে। সেই সুবাদে বনজঙ্গল পূর্ণ আসামকে মনুষ্যবাসোপযোগী আধুনিক আসামে পরিণত করে তোলে যারা, তারা অনেকেই ছিলেন বাংলাদেশের কয়েকটি জেলা থেকে যাওয়া কৃষক, ধর্মীয় পরিচয়ে যাদের অধিকাংশই ছিলেন মুসলমান।
পরবর্তীকালে এই বাঙ্গালী কৃষকদের আসাম থেকে তাড়িয়ে দেবার ষড়যন্ত্র শুরু করে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসসহ বিভিন্ন হিন্দু-প্রধান রাজনৈতিক সংগঠন। ইতিহাসে এই ষড়যন্ত্রই বাঙ্গাল-খেদা আন্দোলন নামে পরিচিত হয়ে আছে। এই বাঙ্গাল-খেদা ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে কৃষক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে সমগ্র উপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে ওঠেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং তিনি আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। সে সময় অর্থাৎ বৃটিশ আমলের শেষ দিকে আজকের বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ সিলেট ছিল আসাম প্রদেশের অন্তর্গত। আসাম প্রদেশে দুটি বিভাগ ছিল : (এক) আসাম ভ্যালি ও (দুই) সুর্মা ভ্যালি। সিলেট ছিল সুর্মা ভ্যালির অন্তর্গত। ১৯৪৭ সালে বৃটিশ শাসনের অবসান ও স্বাধীনতা অর্জন তথা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রাক্কালে একটি গণভোটের মধ্যে দিয়ে সিলেটকে পূর্ব পাকিস্তান তথা পূর্ব বাংলায় যোগ দিতে হয়। ১৯৪৭ সালে যে গণভোটের মাধ্যমে সিলেট বাংলাদেশ তথা তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে যোগদান করে, সে গণভোটে অবিভক্ত বাংলার প্রবীণ ও তরুণ মুসলিম লীগ কর্মীরা ব্যাপকভাবে গ্রহণ করেন। ব্যক্তিগতভাবে আমি সে বছর আই-এ পাশ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির অপেক্ষা গ্রামের বাড়ীতে ছুটি কাটাচ্ছিলাম। সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে আমিও মুসলিম অধুষিত সিলেট গণভোটে মুসলিম লীগ ন্যাশানাল গার্ডের সদস্য হিসাবে যোগ দিতে সমর্থ হয়েছিলাম। ফলে ও গণভোটের অনেক ঘটনা এখনও আমার চোখের সামনে ভেসে উঠে। এখানে তার দু’একটা উল্লেখের লোভ এড়াতে পারছি না। এই গণভোট প্রধান দুটি পরস্পরবিরোধী পক্ষ ও দাবী ছিল। পাকিস্তান-সমর্থক মুসলিম লীগের দাবী ছিল সিলেট তাদের দাবি মোতাবেক পূর্ব পাকিস্তানে যোগ দেবে। অপর পক্ষে সমস্ত ভারতের সমর্থক কংগ্রেসের দাবী মোতাবেক সিলেট আসামেই থেকে যাবে। স্বাভাবিকভাবে গণভোটে কংগ্রেসের পরাজয় আমরা কামনা করেছিলাম। তাই আমাদের প্রধান শ্লোগান ছিল : ‘সিলেটের’ গণভোটে কংগ্রেসের পরাজয়-নিশ্চয়’। আসামে তখন চলছিল কংগ্রেস সরকার। এই সরকার একবার ঈদের নামাজ আদায়রত মুসল্লীদের উপর গুলী চালায়, গুলী চালিয়ে বহু মুসলমানকে হতাহত করে। তাই আমাদের অন্যতম প্রধান শ্লোগান ছিল : ‘আসামে আর থাকবো না-গুলী খেয়ে মরবো না’ এবং ‘আসাম সরকার জুলুম করে- নামাজের উপর গুলী করে’।
সিলেট গণভোট চলাকালে আমরা যারা গিয়েছিলাম, তাদের ওপর বিশেষকর আমরা যারা মুসলিম লীগ ন্যাশনাল গার্ডের সদস্য ছিলাম, তাদের ওপর ছিল গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। যেখানেই মুসলিম লীগের নেতাকর্মীদের উপর প্রতিপক্ষের আক্রমন হতো, সদস্য হিসাবে সেখানেই আমাদের ছুটে যেতে হতো, মুসলিম লীগের নেতাকর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চত করতে। এভাবে কতবার যে আমাদের সামান্য বিশ্রামের সুযোগও জলাঞ্জলি দিতে হতো, তার ইয়ত্তা নেই।
আসামে গণভোট হয় পরপর দুই দিন। সিলেটের যেসব এলাকায় মুসলিম জনসংখ্যা বেশী ছিল না, সে সব এলাকায় গণভোট উপলক্ষে আগত মুসলিম লীগ কর্মীদের নিরাপত্তার স্বার্থে গণভোট সংক্রান্ত জরুরী কাজ সব এক দিনে অর্থাৎ প্রথম দিনের মধ্যে সেরে ফেলতে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল এবং এ জন্য সংশ্লিষ্ট ভোটারদের বাড়ীতে বাড়ীতে যেয়ে এ ব্যাপারে তাদের প্রথম দিনের মধ্যে ভোটদানের কাজটা সেরে ফেলতে পরামর্শ দিয়ে আসা হয়েছিল। সিলেটে গণভোট উপলক্ষে বাইরে থেকে যারা গিয়েছিলেন সেই সব মুসলিম লীগ নেতাকর্মীদের সিংহভাগই ছিলেন তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার। তবে ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রদেশ থেকে মুসলিম লীগ নেতাকর্মীরা যে সে সময় সিলেটে একেবারে যাননি, তা নয়। তারা গেছেন তবে সংখ্যায় অনেক কম। সংখ্যায় কম হলেও তাদের যথেষ্ট মূল্য দেয়া হয়েছিল। সাধারণ বাঙ্গালীদের চাইতে তারা দৈহিকভাবে দীর্ঘতর হওয়াতে সিলেটের হিন্দুরা তাদের বিশেষ ভয় পেতো। তাই বাঙ্গালীদের মধ্যে যারা যথেষ্ট দীর্ঘদেহী ছিলেন তাদের অনেককেও অবাঙ্গালী (পাঞ্জাবী, পাঠান ইত্যাদি) বলে চালিয়ে দেবার চেষ্টা চালানো হয় হিন্দুদের মনে ভয় ধরিয়ে দিতে।
আমাদের গ্রাম থেকে দুজন আমরা সিলেট যাই গণভোট উপলক্ষে। আমি ছাড়া আরেকজন ছিলেন আমার এক চাচীর ভাই, নাম এছাহাক আলী। বয়সে তিনি আমার চাইতে সামান্য বড় হলেও দৈহিকভাবে তার চাইতে আমি দীর্ঘদেহী হওয়াতে আমাকে সংশ্লিষ্টজনেরা অবাঙ্গালী হিসাবে সিলেক্ট করে বসেন। এতে আমি প্রথম প্রথম একটু ভয় পেলেও পরবর্তীকালে আমার ভয় কেটে আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়। সাধারণ বাঙ্গালীর তুলনায় আমি দীর্ঘদেহী হওয়াতে অবাঙ্গালী হয়ে গেলাম তো বটে, তবে ভাষার সমস্যা কাটবে কী করে? এই সমস্যার সমাধানের জন্য আমাকে পরামর্শ দেয়া হয় কথা কম বলতে এবং যতটুকু কথা বলি, তা যেন যথাসাধ্য উর্দুভাষায় বলার চেষ্টা করি। পরবর্তীকালে তমদ্দুন মজলিসের একজন সক্রিয় সদস্য হিসাবে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার সংগ্রামে যোগ দিয়ে আমি একজন ভাষা সৈনিক হিসাবে পরিচিতি লাভ করে সেদিন সিলেটে গণভোটের কাজ করার সুবির্ধাথে নকল উর্দুভাষী সাজতে হয়েছিল বলে আজও আমি গভীর কৌতুক অনুভব করি।
মুসলিম অধ্যুষিত সিলেটের করায় গণভোটে যে মুসলিম লীগই জয়লাভ করবে, এ বিশ্বাস আমাদের মনে সৃষ্টি হয়েছিল গণভোট চলাকালেই। তাই আমরা যখন সিলেট গণভোট থেকে নিজ নিজ জেলায় ফিরছিলাম পথে আমরা ফিরছিলাম গণভোট বিজয়ীর বেসে শ্লোগানে শ্লোগানে ট্রেনকে কাঁপিয়ে তুলে। তাই আমাদের সাময়িক ভুলে শ্লোগান উচ্চারণ বাদ পড়ে যাওয়ায় একই ট্রেনে প্রত্যাবর্তনকারী কংগ্রেস কর্মীরা যদি শ্লোগান তুলতে চেষ্টা করত, সঙ্গে সঙ্গে আমরা বৃহত্তর উৎসাহ নিয়ে আরও উচ্চকণ্ঠে শ্লোগান তুলতে শুরু করে দিতাম।
এভাবে সিলেট গণভোট আমরা সম্পূর্ণ বিজয় লাভ করলেও পূর্ণ বিজয় থেকে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান তথা আজকের বাংলাদেশকে বঞ্চিত করা হয়েছে। কুখ্যাত র্যাডক্লিফ রেয়েদাদের মাধ্যমে, যেমনটি আমাদের আরও কয়েকটি জেলায় আমাদের ন্যায্য প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করা হয় ষড়যন্ত্রমূলকভাবে। এটা ছিল বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের সাথে ভারতীয় আধিত্যবাদের ষড়যন্ত্রমূলক আতাঁতের এক দৃষ্টান্ত।
আজকের মত আবার এ লেখার ইতি টানার আগে যে আসাম নিয়ে লেখা শুরু করছিলাম, সে আসাম থেকে নতুনভাবে ষড়যন্ত্র শুরু করা হয়েছে। বাঙ্গালী বিতাড়নের নামে বাঙালী মুসলমান কৃষকদের বিতাড়নই এ-ষড়যন্ত্রের লক্ষ্য উল্লেখযোগ্য যে, আসাম রাজ্যে এমন শাসন চালাচ্ছে ভারতের উগ্র সম্প্রদায়িক রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি। বিজেপির মত চরম সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক সংগঠনের কাছে এর চাইতে ভাল কিছু আশা করা যায় না, তা আমরা জানি। তবে তার চাইতেও বড় কথা, শক্তি আছে বলেই যদি ন্যায়-অন্যায় বিবেচনা না করে শক্তির অপব্যবহার করা হয় তার পরিণতি একদিন ভোগ করতেই হবে প্রতিবেশী দেশ ভারতকে।
আসাম থেকে বহিরাগত বিতাড়নের নামে যে বাঙ্গালী (মুসলমান) কৃষক বিতাড়নের পাঁয়তারা চালানো হচ্ছে তার পরিনাম শুভ হবে না, তার লক্ষণ ইতোমধ্যেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। খোদ ভারতের বিজেপি বিরোধী রাজনৈতিক সংগঠনগুলো ইতিমধ্যেই আসামের ব্যাপারে বিজেপির সাথে দ্বিমত প্রকাশ করেছে। এই প্রশ্নে সব দল বিজেপির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে।
বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র যে রাষ্ট্রের অভ্যুদয় হয়েছে একটি মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে। একথা কারো ভুলে যাওয়া ঠিক হবে বলে মনে করিনা। আসাম থেকে বহিরাগত বিতাড়নের নামে যদি তাদের বাংলাদেশে ঠেলে দেয়ার চেষ্টা হয়, বাংলাদেশের মানুষ তা কোনোভাবেই মেনে নেবে না। যারা এককালে বনজঙ্গলপূর্ণ আসাম থেকে বনজঙ্গল পরিষ্কার ও আবাদ করে আসামকে মনুষ্যবাসযোগ্য আধুনিক আসামে পরিণত করেছে তাদের প্রতি এটা হবে চরম অবিচার এবং সে কাজটি হবে মানবতার প্রতি চরম অবমাননা। সুতরাং অন্যায় থেকে বিরত থাকতে আমরা ভারত সরকারের প্রতি আহ্বান জানাই।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন