সরকারের প্রতি তো বটেই, স্বাধীন হিসেবে থাকার কথা যে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর, তাদের ব্যাপারেও গণমানুষ ক্রমশ আস্থাহীন হয়ে পড়ছে। পুলিশের আইজি, প্রধান নির্বাচন কমিশনার, দুর্নীতিদমন কমিশনের চেয়ারম্যান, বিচার বিভাগের মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিরা যদি ছদ্মবেশে বাস, ট্রেন, জাহাজে (যা গণমানুষের পরিবহন) যাতায়াত করেন তবে ধারণা করতে পারবেন, শপথ নিয়ে দায়িত্ব পালনরত মহান ব্যক্তিত্বদের সম্পর্কে সাধারণ মানুষ কী ধারণা পোষণ করে? বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা এখন দারুণভাবে বিঘিত। পুলিশ ইয়াবা ব্যবসা করে। এ অভিযোগ দীর্ঘ দিনের। নারায়ণগঞ্জ কারাগারে ছয়জন পদস্থ পুলিশ অফিসার ইয়াবা ব্যবসার দায়ে কারারুদ্ধ থাকার সংবাদ থেকেও দেশব্যাপী এ ব্যবসা প্রসারে পুলিশের ভূমিকা কতটুকু সে বিষয়ে সম্যক ধারণা লাভ করতে পারে। গ্রেফতারকৃত সাব-ইন্সপেক্টর আলম সরোয়ার্দীর ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারা রেকর্ড করা বক্তব্য অনুযায়ী, আটক ইয়াবা ওসির, কিন্তু মিডিয়ার চাপে যখন মামলা হলো তখন ওসি আর এ দেশে নেই। ‘চিকিৎসার জন্য’ বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন।
অন্যায়-অবিচারের প্রতিকার যখন মানুষ পায় না এবং যার কাছে প্রতিকার সে যখন দলবাজিতে লিপ্ত হয়ে পক্ষপাতিত্বমূলক আচরণ করে, তখন গণরোষ বিস্ফোরিত না হওয়া পর্যন্ত প্রতিবাদ করতে না পারার ক্ষোভ দারুণভাবে পুঞ্জীভূত হতে থাকে। সা¤প্রতিককালের স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন, উপজেলা, পৌরসভা এবং ইউনিয়ন পরিষদ) নির্বাচনের সুযোগে নির্বাচন কমিশন, পুলিশ ও প্রশাসনের সহায়তায় কায়েম করা স্বেচ্ছাচারকে বৈধতা দেয়ার জন্য একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী উঠেপড়ে লেগেছেন। কিছু দিন আগেও সরকার ও সরকারের তাঁবেদারদের বিরুদ্ধে বুদ্ধিজীবীদের সোচ্চার হতে দেখা গেছে, কিন্তু বর্তমানে তাদের অনেকে স্বৈরতন্ত্রকে বৈধতা দিতে ব্যস্ত। এ জন্য চাপাবাজি করছেন নৈতিক কারণে নয়; বরং কিছু সুবিধার জন্য। কার্যত এখন সত্যকে সত্য বলা যায় না। মিথ্যার আবরণে সব কিছু ঢেকে যাচ্ছে। এ লেখাটি যখন লিখছিলাম, তখনই বরিশাল, রাজশাহী ও সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনের চার দিন আগে অর্থাৎ, ২৬ জুলাই বাংলাদেশের বহুল প্রচারিত একটি জাতীয় দৈনিকে যে সংবাদ প্রকাশিত হয় তা তুলে ধরা হলো। ‘রাজশাহীর পাঠানপাড়া এলাকার বিএনপির কর্মী শাহরিয়ার খন্দকারকে গত সোমবার সন্ধ্যায় নগরের ফায়ার সার্ভিস মোড় থেকে মাইক্রোবাসে তুলে নেয়া হয়। পরদিন পরিবার জানতে পারে, শাহরিয়ার পাবনা সদর থানায়। তার সঙ্গে একই থানায় গ্রেফতার দেখানো হয় যুবদলের ১৫ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম ও বিএনপির কর্মী জুয়েল ইসলামকে। শাহরিয়ারের ভাই খন্দকার আবুল বাশার জানান, সোমবার সন্ধ্যা ৭টার দিকে কয়েকজনের সাথে দাঁড়িয়ে ছিলেন শাহরিয়ার। হঠাৎ একটি মাইক্রোবাস এসে তাকে তুলে নিয়ে যায়। শাহরিয়ার একজন প্রকৌশলী, ঠিকাদারির কাজ করতেন। আগে কোনো মামলাও ছিল না। এবার বিএনপির মেয়র প্রার্থীর নির্বাচনী প্রচারণায় যুক্ত ছিলেন তিনি। শুধু শাহরিয়ারই নন, ১০ জুলাই নির্বাচনী প্রচারণা শুরু হওয়ার পর থেকেই রাজশাহীতে ধরপাকড় চলেছে। এতদিন বিএনপির নেতাকর্মীদের মহানগরীর বিভিন্ন নাশকতা ও বিস্ফোরক মামলায় গ্রেফতার দেখানো হতো। কিন্তু এখন রাজশাহী শহর থেকে আটক করে তাদের গ্রেফতার দেখানো হচ্ছে আশপাশের বিভিন্ন জেলার মামলায়। পুলিশের এই নতুন কৌশলকে জনগণ ‘ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং’-এর পূর্বপ্রস্তুতি মনে করছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, শুধু সোমবার রাতেই রাজশাহী শহর থেকে বিএনপির ১১ জন নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পরে তাদের পাবনা, নাটোর ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিভিন্ন থানায় চালান দেয়া হয়। মঙ্গলবার রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে দেয়া অভিযোগপত্রে বিএনপি ৪৩ নেতাকর্মী গ্রেফতার হওয়ার কথা উল্লেখ করেছে।’
এমন খবর গাজীপুর ও খুলনা সিটি নির্বাচনের সময়েও প্রকাশিত হয়েছিল। হাইকোর্টের শরণাপন্ন হলে গ্রেফতারি পরোয়ানা বা সুনির্দিষ্ট মামলা ছাড়া কাউকে গ্রেফতার না করার জন্য হাইকোর্ট নির্দেশ দেন। এতে পুলিশ কৌশল পরিবর্তন করে। দায়িত্ব নিয়েই বলছি, গাজীপুর জেলার আশপাশের জেলার পুলিশ গাজীপুর সিটি এলাকা থেকে বিএনপি নেতাকর্মীদের ধরে নিয়ে পার্শ্ববর্তী জেলার ভিন্ন ভিন্ন থানায় নাশকতার মামলায় গ্রেফতার করেছে। বিষয়গুলো ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট ও সেশন কোর্টে (জজ কোর্টে) বিস্তারিত উপস্থাপন করলেও রিমান্ড থেকে কেউ রেহাই পায়নি। পুলিশি এই অবৈধ তৎপরতাকে আদালত প্রশ্রয় দিয়েছেন জেনে শুনে। বিচারকরা অবশ্যই দেশের নির্বাচনী কর্মকান্ড সম্পর্কে অবহিত রয়েছেন। তারপরও দেখেও না দেখার ভান করে জামিন না দিয়ে রিমান্ড দেয়া হয়েছে।
৩০ জুলাই বিভিন্ন চ্যানেল ও ফেসবুক এবং ৩১ জুলাই জাতীয় পত্রিকায় বরিশাল ও রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে পোলিং অফিসারের উপস্থিতিতে ব্যালট পেপারে সিল মারার দৃশ্য। দেখা গেলো ওই দুই সিটিতে বিএনপি মেয়র প্রার্থীদের নির্বাচন বর্জন এবং রাজশাহীর মেয়রপ্রার্থী বুলবুলকে একটি কেন্দ্রের মাঠে ব্যর্থপ্রেমিকের মতো অসহায় বসে থাকতে দেখা গেছে। বিএনপি তিন সিটিতে যাদের মনোনয়ন দিয়েছিল তারা সবাই সাবেক নির্বাচিত মেয়র এবং কমবেশি মিথ্যা মামলায় জেল খেটেছেন। কিন্তু একই নির্বাচন কমিশন ও সরকারের অধীনে নির্বাচনে জামায়াতের প্রার্থী থাকা সত্তে¡ও সিলেটে ভিন্ন চিত্র কেন দেখা গেল।
এমন কথা প্রচলিত রয়েছে যে, জামায়াত রাজনৈতিকভাবে বিএনপিকে শক্তির জোগান দেয়। সা¤প্রতিক বাংলাদেশ বার কাউন্সিল নির্বাচনে জামায়াতের প্রার্থী দেয়া হয়নি বলে বিএনপি মনোনীত প্রার্থীরা মার্জিনাল ভোটে পরাজিত হয়েছেন মর্মে একটি প্রচার রয়েছে। কিন্তু সিলেটে জামায়াত মেয়রপ্রার্থী দেয়া সত্তে¡ও বিএনপির সিলেটে বিজয় একটি নতুন দিকনির্দেশনা। এ জয়ের পেছনে মূলত অবদান সিলেটের নেতাকর্মীদের যারা মাঠ ছেড়ে যাননি, রাজশাহীর মতো প্রার্থী হিসেবে প্রতিবাদ না করে কেউ ঘাসের ওপর বসে থাকেনি, বরিশালের ডাকসাইটে নেতাদের মতো দুপুর না গড়াতেই আনুষ্ঠানিকভাবে মাঠ ছেড়ে দেয়া হয়নি। বাস্তবতা হলো, জামায়াত ছাড়াও নির্বাচনে জেতা যায়, সিলেট এর দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। তবুও বর্তমান প্রেক্ষাপটে জামায়াতসহ ২০ দলীয় ঐক্য অটুট থাকা দরকার।
নির্বাচনী মাঠ একটি যুদ্ধের ময়দান। এখানে মান, অভিমান বা ব্যর্থতার কোনো জায়গা নেই। বরং নির্বাচনে অন্যায়টাই বাহবা পাচ্ছে। উন্নত দেশে যেভাবে প্রার্থীর ব্যক্তিজীবন এবং গুণাগুণ বিচার করে ভোট দেয়া হয়, আমাদের দেশে এর কোনো সুযোগ নেই। নির্দলীয় তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠানের নির্বাচনীব্যবস্থা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার বাতিল করে হরিলুটের নির্বাচনী পদ্ধতিতে বৈধ করে দিয়েছে। এমতাবস্থায়, বিএনপিকে যদি জাতীয় নির্বাচন করতেই হয় তবে ভোটকেন্দ্র নিয়ন্ত্রণে রেখে নির্বাচনে যাওয়ার সব প্রস্তুতি নিয়ে এবং রাজনৈতিক, সাংগঠনিক ও আইনগতভাবে আটঘাট বেঁধেই নামতে হবে। ‘এজেন্টদের বের করে দিয়েছে’ এ ধরনের অসহায় উক্তি জনগণ আর শুনতে চায় না।
পুলিশ ও প্রশাসনের মনে জনগণের ভীতি রয়েছে। তারা যেহেতু অনেক অপকর্ম তথা জনগণের স্বার্থবিরোধী কাজে জড়িত, সেহেতু তারা এভাবেই ভয় পায়। যে মিছিলে বিক্ষোভকারীর সংখ্যা কম, সে মিছিলে পুলিশ লাঠি চার্জ করে, যে মিছিলে বিক্ষোভকারীর সংখ্যা মোটামুটি হয়, সে মিছিলে পুলিশ বাধা দেয় আর ব্যানার ছিনিয়ে নেয় এবং যে মিছিলে বিক্ষোভকারীর সংখ্যা বেশি, সে মিছিলে পুলিশ প্রটোকল দেয়। এই নজির থেকেই বলতে পারি, জনতার ঢল নামলে পুলিশের সাহায্যে ব্যালটে সিলমারা সম্ভব হবে না, অন্য দিকে নির্বাচন কমিশনেরও কান খাড়া থাকবে। ফলে সিলেটের নির্বাচন এই বার্তাই দিয়ে গেল, সরকারি দল যে ভাষায় কথা বলে, ভোটকেন্দ্রে সে ভাষাতেই যদি জবাব দেয়া যায়, পুলিশ আর ব্যালটে সিল মারার সুযোগ ক্ষমতাসীন দলকে করে দেবে না, বরং ব্যালেন্স করবে। ফলে নির্বাচনী মাঠে অবস্থান করে জনগণের ইচ্ছা ও আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটানো যাবে, নতুবা ব্যর্থতার গøানি বহন করতে হবে। কারণ ন্যায্য প্রতিকার পাওয়ার পরিস্থিতি এ দেশে আজো সৃষ্টি হয়নি। ক্ষমতার তাঁবেদাররাই স্বার্থান্বেষী মহল, যারা বিবেক দিয়ে পরিচালিত নয়, বরং নিজ স্বার্থেই সবসময় তৎপর থাকে। ফলে বিবেক দিয়ে দায়িত্ব পালনের চেয়ে ক্ষমতাসীনদের মনোরঞ্জনই মুখ্য বলে মনে করে এবং সে মতেই কার্যসম্পাদন করে। এ জন্য বর্তমানে নিজের ভোট নিজে দেয়ার অধিকার থেকে গণমানুষ বঞ্চিত।
যাদের অহঙ্কার বেড়ে যায় তাদের পতন ঘটে বলে মুরব্বিদের বক্তব্য। দাম্ভিক এমপি, মন্ত্রী ও নেতাদের কথাবার্তায় মনে হয়, তাদের মুখে লাগাম দেয়ার সাধ্য জনগণের নেই। যারা একসময় বঙ্গবন্ধুর চরম বিদ্বেষী ছিলেন, তারা এখন ক্ষমতার ছায়াতলে। যারা গণবাহিনীর নেতৃত্ব দিয়েছেন, এখন তারা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবিদার, যে গণতন্ত্র মানুষের ভোটাধিকার কেড়ে নিয়ে কার্যত একদলীয় শাসনব্যবস্থা কায়েম করেছে। সব প্রতিরোধের জন্য জাতীয় ঐক্য অত্যন্ত জরুরি, নতুবা জাতীয় নির্বাচন হলেও দেশটি একটি পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারে, যেখানে গণমানুষের প্রতিবাদের ভাষা চিরতরে স্তব্ধ হয়ে যাবে। তখন উন্নয়নের দোহাই দিয়ে মৌলিক অধিকারের কথা ভুলিয়ে দেয়া হবে। রাজতান্ত্রিক দেশেও উন্নয়ন হয়, কিন্তু কোথাও কোথাও মৌলিক অধিকার একেবারেই নেই। স্মরণ রাখতে হবে, বাংলাদেশ রাষ্ট্র গণপ্রজাতন্ত্রী, রাজতান্ত্রিক নয়। রাষ্ট্রের এই চরিত্র নিশ্চিত করতে হলে জাতীয় ঐক্যমত্যভিত্তিক গণজাগরণের বিকল্প নেই।
লেখক : কলামিস্ট ও আইনজীবী
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন