অনেকেই বলেন, দেশে অনিয়ম, দুর্নীতি আর লুটপাটতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাদের কথা অস্বীকার করা যায় না। বলতে গেলে, এমন কোনো ক্ষেত্রের উল্লেখ করা যাবে না যেখানে সুশাসন, স্বচ্ছতা, দায়িত্বশীলতা, নেতিক বাধ্যবাধকতা ও জবাবদিহিতা বিদ্যমান আছে। এসব না থাকার কারণেই অনিয়ম, দুর্নীতি ও লুটপাটের রাজত্ব কায়েম হয়েছে। সাম্প্রতিক কালের দুটি ঘটনা মানুষের মুখে মুখে ফিরছে। এর একটি হলো: বাংলাদেশ ব্যাংকে রক্ষিত সোনার গরমিল। অন্যটি হলো: বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি থেকে কয়লা উধাও হওয়া।
শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে রাখা সোনার মানে ও পরিমাণে গরমিল আছে বলে জানানো হয়। এই প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে একটি পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়। বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর স্বভাবতই জনমনে যুগপৎ বিস্ময় ও উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিরাপদ ভল্টে রাখা সোনায় কীভাবে হেরফের হতে পারে, বিস্ময় এখানেই। আর উদ্বেগের কারণ হলো, এখানেই যদি সোনা বা সম্পদের নিরাপত্তা না থাকে তবে আর কোথায় উপযুক্ত নিরাপত্তা পাওয়া যাবে? শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের প্রতিবেদন মোতাবেক, জমা রাখা তিন কেজি ৩০০ গ্রাম ওজনের চাকতি ও সোনার আংটি হয়ে গেছে মিশ্র বা শঙ্কর ধাতু। ছিল ২২ ক্যারেট সোনা, হয়ে গেছে ১৮ ক্যারেট। দৈবচয়নভিত্তিতে নির্ধারণ করা ভল্টে রক্ষিত ৯৩৬ কেজি সোনা পরীক্ষা করে অধিকাংশের ক্ষেত্রে এ অনিয়ম ও গরমিল দেখা গেছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
খবরটি প্রকাশিত হওয়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংকের তরফে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে দাবি করা হয়েছে, সোনায় কোনোরকম অনিয়ম ও হেরফের হয়নি। সোনার চাকতির মিশ্র ধাতু হয়ে যাওয়ার তথ্য যেমন সঠিক নয়, তেমনি ২২ ক্যারেট সোনা ১৮ ক্যারেট হয়ে যাওয়ার তথ্যও সঠিক নয়। তবে চাকতির বিষয়ে স্বীকার করা হয়েছে, সেখানে করণিক ভুল হয়েছে। আর মানের ক্ষেত্রে বৈপরীত্য হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ধারিত স্বর্ণকারের কষ্ঠিপাথরে সোনা যাচাই আর শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের মেশিনের মাধ্যমে সোনা যাচাইয়ের কারণে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের জবাব বা ব্যাখ্যায় কেউ আশ্বস্ত ও সন্তুষ্ট হতে পারেননি। বরং তাদের মনে ব্যাংকের ভল্টে রক্ষিত সমুদয় সোনার ব্যাপারে সন্দেহ-সংশয় দেখা দিয়েছে। শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত, অধিদফতরের মহাপরিচালক এ প্রসঙ্গে বলেছেন, এক বছরেরও বেশি সময় ধরে আট সদস্যের কমিটি অনুসন্ধান করে এসব অনিয়ম পেয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সহযোগিতা ও উপস্থিতিতে ওই অনুসন্ধান চলেছে। তিনি আরো উল্লেখ করেছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকও বিষয়টি অনুসন্ধান করে ব্যবস্থা নিতে পারে। শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের তদন্ত প্রতিবেদন যথাসময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষের নজরে আসার পরও কোনো তদন্তের ব্যবস্থা হয়নি। কোনোরূপ অনুসন্ধান বা তদন্ত না করার পেছনে বিষয়টি ধামাচাপা দেয়ার কোনো উদ্দেশ্য ছিল কিনা সে প্রশ্ন উঠতে পারে। বিজ্ঞজনেরা মনে করেন, যে অভিযোগ উঠেছে তা গুরুতর ও অতিশয় বেদনাদায়ক। করণিক ভুল ও পরিমাণের কথা হাস্যকর। এ ধরনের হাস্যকর বক্তব্যের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভাবমর্যাদা ক্ষুণœ করা হয়েছে। তারা কোনো তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে বিষয়টির পরীক্ষা ও যাচাইয়ের দাবি করেছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ইতোমধ্যে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। কমিটির প্রধান করা হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক এ এন এম আবুল কাসেমকে। কমিটিতে আছেন ব্যাংকের চারজন জিএম ও একজন এজিএম। কমিটিকে দুই মাসের মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। তদন্তের ব্যাপারে বিশিষ্টজনদের দাবি উপেক্ষিত হয়েছে। তদন্ত কমিটি তৃতীয় পক্ষের না হওয়ায় কতটা নিরপেক্ষ হবে তা নিয়ে শুরুতেই সংশয় দেখা দিয়েছে। আমাদের দেশে প্রতিষ্ঠানিক তদন্ত কমিটির তদন্তের ব্যাপারে জনআস্থা খুবই কম। সে ক্ষেত্রে অধিকতর স্বচ্ছতার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত ছিল তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে তদন্ত করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা। মনে হয়, বিষয়টি সচেতনভাবেই এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। অতএব, তদন্ত কি হবে, সহজেই আন্দাজ করে নেয়া যায়। হয়তো বলা হবে, সবই ঠিক আছে; কিছুই হয়নি। এমনও হতে পারে, বাংলাদেশ ব্যাংকের তরফে যে বক্তব্য রাখা হয়েছে, সেটাই আরো ভালোভাবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করা হবে।
ইতোমধ্যে অর্থমন্ত্রী যে বক্তব্য রেখেছেন, তাতে স্পষ্টই বুঝা যায় তদন্তের ফলাফল কি হবে বা হতে পারে। তিনি আগেই রায় দিয়ে দিয়েছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বর্ণে কোনো সমস্যা নেই। ৯৬৩ কেজি স্বর্ণের মধ্যে মাত্র তিন কেজি স্বর্ণ দূষিত, এটা কোনো সমস্যা নয়। এ ব্যাপারে এনবিআরকেও একহাত নিয়েছেন তিনি। বলেছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের সোনা নিয়ে এনবিআরের কোনো কথা বলারই প্রয়োজন ছিল না। এটি বাংলাদেশ ব্যাংকের বিষয়। যা করার বাংলাদেশ ব্যাংকই করবে। এ বিষয়ে কমিটি গঠনের কোনো প্রয়োজন নেই বলেও তিনি জানিয়ে দিয়েছেন। প্রশ্ন ওঠে, অভিযোগ পরীক্ষা ও যাচাইয়ের আগেই অর্থমন্ত্রী কীভাবে জানলেন যে, স্বর্ণে কোনো সমস্যা নেই? ব্যাংকের ভল্টে রক্ষিত সোনা এক রতিই হোক কিংবা এক হাজার কেজিই হোক, অনিয়ম ও গরমিল হলে পরীক্ষা ও যাচাই করে দেখাই নৈতিক ও আইনগত দাবি। অর্থমন্ত্রী এই দাবি নাকচ করে দিয়েছেন। তার মতে, এটা স্বাভাবিক ও উপেক্ষাযোগ্য। অনেকেরই স্মরণ থাকার কথা, একটি ব্যাংকের চার হাজার কোটি টাকার ঋণ কেলেঙ্কারিকে কোনো পাত্তা না দিয়েই একদা তিনি বলেছিলেন, এটা এমন বেশি টাকা নয়। এভাবে কোনো অনিয়ম-দুর্নীতিই যদি কিছু না হয়, তবে দুর্নীতির বিকাশই ঘটবে এবং দুর্নীতিবাজরা আরো উৎসাহিত হবে।
স্বর্র্ণে অনিয়ম ও হেরফেরের আগে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে রিজার্ভের অর্থ পাচারের নজিরবিহীন ঘটনা ঘটেছে। সেই রিজার্ভের অর্থ বেহাত হয়ে যাওয়ার ঘটনার কোনো কিনারা হয়নি। কি পরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে সেটাও জানা যায়নি এবং পাচারের সঙ্গে যারা জড়িত তাদেরও কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। এ ব্যাপারে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। তদন্ত কমিটি অনেক খেটেখুঁটে একটি রিপোর্টও দিয়েছিল। কিন্তু সে রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়নি। ফলে, কারো পক্ষেই আর জানা সম্ভব হলো না, রিজার্ভের কত টাকা পাচার হয়েছে এবং তার জন্য কারা দায়ী। কেউ না কেউ বা কিছু লোক তো দায়ী হবেই। অনেকেই ধারণা করেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের অভ্যন্তরেই একটি চক্র আছে, যে চক্র রিজার্ভের অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িত। তদন্ত প্রতিবেদনে নিশ্চয় তাদের বিষয়ে উল্লেখ আছে। কিন্তু তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ না হওয়ায় চক্রটির কথা অজানাই থেকে গেল। চক্রের সদস্যরা থেকে গেল অধরা। এরও আগে শেয়ারবাজার লুটপাটের ব্যাপারও সরকার কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এ সংক্রান্ত তদন্ত কমিটি রিপোর্ট দিলেও সে রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়নি। শোনা যায়, সেই রিপোর্টে কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তির নাম ছিল, যারা লুটপাটের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত। তারা সরকারের কাছের লোক হওয়াই সম্ভব এবং সম্ভবত তাদের রক্ষা করার জন্যই তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়নি। কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
ব্যাংক সেক্টরের কথা যত কম বলা যায় ততই ভালো। এই সেক্টরটি অর্থ লুটপাটের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। প্রায় এমন কোন ব্যাংকের কথা বলা যাবে, যার বিরুদ্ধে অনিয়ম, দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের অভিযোগ নেই। ব্যতিক্রম ছাড়া সকল ব্যাংকের বিরুদ্ধে অনিয়ম, দুর্নীতি ও অর্থ লোপাটের অভিযোগ আছে। প্রতি বছর যে লক্ষ-কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে, তার পেছনেও বড় হাত রয়েছে ব্যাংক সেক্টরের। গত অর্থবছরে আমদানির জন্য এলসি খোলা হয়েছে আগের বছরের চেয়ে তিনগুন বেশি। ধারণা করা হচ্ছে, এলসির মাধ্যমে বিপুল অর্থ পাচার হয়ে গেছে। ঋণ জালিয়াতি কোনোভাবেই ব্যাংকগুলোর পিছু ছাড়ছে না। প্রকৃতপক্ষে ঋণ জালিয়াতি গত ১০ বছরে কত হয়েছে তা নির্ণয় করাও মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। সম্প্রতি জনতা ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতির আরো একটি ঘটনা উন্মোচিত হয়েছে। প্রকাশিত খবরে জানানো হয়েছে, ব্যাংকের দুটি শাখা থেকে হাজার কোটি টাকা ঋণ জালিয়াতি হয়েছে। অন্য একটি খবরে বলা হয়েছে এবি ব্যাংক থেকে ৩৪০ কোটি টাকার পাচার হয়েছে।
নিয়মনীতি ভেঙে ঋণ দেয়ায় পেছনে দুর্নীতি ও প্রভাবের ভ‚মিকাই প্রধান। দেখা গেছে, এ ধরনের ঋণের একটি বড় অংশই খেলাপি হয়ে যায়। এক খবরে দেখা গেছে, বিগত তিন মাসে ১৪ হাজার ২৮৬ কোটি টাকা বেড়ে খেলাপি ঋণের মোট পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮৮ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকা। এর আগে ঋণ অবলেপন করা হয়েছে ৪০ হাজার কোটি টাকা। বুঝাই যায়, খেলাপি ঋণ আদায়ের সম্ভাবনা খুবই কম। হয়তো ঋণ অবলেপন করেই ব্যাংকগুলোকে মুক্ত হতে হবে। তবে যেভাবে এই শ্রেণীর ঋণ বাড়ছে, তাতে আসলেই মুক্তি মিলবে কি না সেটাও কম বড় প্রশ্ন নয়।
অনিয়ম-দুর্নীতি এভাবে দেশের সম্পদ, মানুষের অর্থ খেয়ে সাবাড় করে ফেলছে। অর্থমন্ত্রী যখন বলেন, চার হাজার কোটি টাকা এমন বেশি টাকা নয়, তিন কেজি স্বর্ণের দূষণ কোনো সমস্যা নয়, ঘুষ স্পিড মানি, টাকা পাচার সব দেশেই হয়, তখন অনিয়ম-দুর্নীতি ও লুণ্ঠন যে বাড়তেই থাকবে তাতে আর সন্দেহ কি।
বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি যে কিছু লোকের কাছে টাকারও খনি, এই কিছুদিন আগে পর্যন্ত দেশের মানুষের জানা ছিল না। অতি সম্প্রতি জানা গেছে, খনির কোল ইয়ার্ড থেকে প্রায় দেড় লাখ টন কয়লা উধাও হয়ে গেছে। এই বেহদিস কয়লার বাজারেমূল্য ২৩০ কোটি টাকার ওপর। আসলে ওই কয়লা উধাও-বেহদিস কিছুই হয়নি। কয়লা কর্পুরের মতো উড়ে যাওয়ার বস্তু নয়। আসলে কয়লা বেচে দেয়া হয়েছে। এই অপকর্মের হোতা বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানি লিমিটেডের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাবৃন্দ এবং তাদের সহযোগী অন্যান্য কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। সবাই হয়তো নয়, তবে অধিকাংশই যে এ লুটপাটের সঙ্গে জড়িত, তাতে সন্দেহ নেই। কয়লা খনি যে টাকার খনি এবং চোরেরও খনি, এটা হয়তো এখনই জানা সম্ভব হতো না, যদি না কয়লাভিত্তিক একমাত্র বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কয়লার টান পড়ত। ওয়াকিবহাল মহলের জানা, বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির কয়লার ওপর নির্ভর করে সেখানে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছে। ওই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ৩টি ইউনিটের মোট উৎপাদন ক্ষমতা ৫২৫ মেগাওয়াট। একটি ইউনিটের উৎপাদন ক্ষমতা ২৭৫ মেগাওয়াট। বাকি দুটির প্রত্যেকটির উৎপাদন ক্ষমতা ১২৫ মেগাওয়াট করে। তিনটি ইউনিটের উৎপাদন সচল রাখতে প্রতিদিন প্রয়োজন ৪ থেকে সাড়ে ৪ হাজার টন কয়লার। এই হিসাবে দেড় থেকে দুই লাখ টন কয়লা মজুদ রাখার নিয়ম। এই নিয়মে ব্যত্যয় ঘটে ১২৩০ ডি নম্বর কূপে কয়লা উত্তোলন বন্ধ হয়ে যাওয়ায়। মজুদ শেষ হয়ে যাওয়ায় গত মে মাসে কূপটি থেকে কয়লা উত্তোলন বন্ধ হয়ে যায়। নির্ধারণ করা ছিল, ১৩১২ নম্বর কূপ থেকে কয়লা উত্তোলন যথাসময়ে সম্ভব হবে। তখন আর কয়লার জোগানে কোনো সমস্যা হবে না। কিন্তু শ্রমিক অসন্তোষ ও কর্মবিরতির কারণে নতুন কূপটি কয়লা উত্তোলনের জন্য প্রস্তত করা যায়নি। এই বিপত্তিতে বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কয়লার টান পড়ে। আর তখনই কয়লা উধাও হওয়ায় বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর্যায়ে আসে। উল্লেখ করা যেতে পারে, কয়লা সংকটে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি ২২ জুলাই সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেছে। কয়লা লুটপাটের ঘটনা খনি কর্তৃপক্ষ পেট্রোবাংলাকে জানায়নি। এমন কি এ ব্যাপারে কোনো অনুসন্ধানও চালায়নি। বিষয়টি জ্বালানি বিভাগের গোচরে এলে জ্বালানি বিভাগ নড়েচড়ে বসে এবং তাৎক্ষণিকভাবে কোম্পানির এমডিসহ ৪ জন শীর্ষ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়। মেট্রোবাংলার পরিচালক (মাইন অপারেশন) মো: কামরুজ্জামানকে আহŸায়ক করে ৩ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।
বলতে গেলে এখন কেঁচো খুড়তে সাপ উঠে আসার উপক্রম হয়েছে। তদন্ত কমিটি যে রিপোর্ট দিয়েছে তার বিস্তারিত জানা না গেলেও সদ্য সাবেক এমডি ও আগের ৩ জন এমডি কয়লা কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত বলে তদন্ত কমিটির কাছে প্রতীয়মান হয়েছে। এ ছাড়া আরো কিছু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার জড়িত থাকার আভাস রিপোর্টে দেয়া হয়েছে। গত বুধবার তদন্ত কমিটির রিপোর্টের ওপর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে যে বৈঠকটি হয়েছে, সেখানে অধিকতর তদন্তের ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে এবং সে মোতাবেক, জ্বালানি মন্ত্রণালয়ে এক উপসচিবের নেতৃত্বে উচ্চপর্যায়ের একটি তদন্ত কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। কমিটি গত ১৩ বছরের কয়লা খনির অনিয়ম-দুর্নীতির তদন্ত করবে।
এদিকে বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানি লিমিটেড কর্তৃপক্ষ খনির সদ্য সাবেক এমডিসহ ১৯ জনকে আসামি করে একটি মামলা দায়ের করেছে। সেখানে চুরি যাওয়া কয়লার পরিমাণ ১ লাখ ৪৪ হাজার টন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। দুদক থেকে বলা হয়েছে, খনি কর্তৃপক্ষের দায়ের করা মামলার ১৯ আসামির বিরুদ্ধে দুদক তদন্ত করবে। দুদকের ৩ সদস্যের একটি কমিটি ইতোমধ্যেই তদন্ত শুরু করেছে এবং এই কমিটি সদ্য সাবেক এমডিসহ ৪ শীর্ষ কর্মকর্তার বিদেশে যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। স্থানীয় ব্যবসায়ী, ঠিকাদার ও এলাকাবাসীর দাবি. মামলায় চুরি যাওয়া কয়লার যে পরিমাণ উল্লেখ করা হয়েছে, আসলে চুরি যাওয়া কয়লার পরিমাণ এর চেয়ে অনেক বেশি হবে। অনুপুঙ্খ ও অধিকতর তদন্ত এ জন্যই অত্যন্ত জরুরি। এটা ঠিক, বিপুল পরিমাণ কয়লা একদিনে চুরি হয়নি বা এক বছরে হয়নি। দীর্ঘদিন ধরে ধারাবাহিকভাবে এই চুরি হয়ে আসছে। ‘যে যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণ’, এই প্রবাদের বাস্তবতা তদন্ত করলেই বেরিয়ে আসবে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য কয়লা রেখে অতিরিক্ত কয়লা বাইরে বেচে দেওয়ার নিয়মটির সুযোগ নিয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা সেই শুরু থেকেই। এছাড়া খনি থেকে উঠে আসা কয়লার গুড়া, যার পরিমাণ বছরে অন্তত ২০ হাজার টন; এর কোনো হিসাবই নেই। এ কয়লাও বেচে দেয়া হয়েছে এবং টাকা উঠেছে সংশ্লিষ্টদের পকেটে। কাজেই, অধিকতর তদন্ত হতেই হবে। তদন্তের ফলাফল কি হবে, আমরা জানি না। সচরাচর যা হয়, তা হলে অবশ্য এই তদন্তের কোনো অর্থ হবে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে রাখা সোনায় হেরফের ও কয়লা চুরির ঘটনায় সরকার বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে। প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং এ দুই ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়েছেন বলে জানা গেছে। জনগণ পর্যায়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার কথা তো বলাই বাহুল্য। আসলে অনিয়ম-দুর্নীতি ও লুন্ঠন যখন অবাধে চলতে থাকে, দুর্নীতিবাজ-লুটেরারা যখন অধরা থেকে যায় কিংবা দায়মুক্তি পেয়ে যায় তখন ক্ষোভ-উদ্বেগ স্বাভাবিক। কারণ, এতে কিছু মানুষ আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ হয়ে গেলেও অশেষ ক্ষতিগ্রস্ত হয় দেশ ও দেশের মানুষ। জাতীয় বৃহত্তর স্বার্থেই অনিয়ম-দুর্নীতি ও লুণ্ঠন বন্ধ করতে হবে। সেটা করতে হলে সকল ক্ষেত্রেই সুশাসন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। অনিয়মকারী, দুর্নীতিবাজ ও লুটেরাদের আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন