একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছে ছয় মাস হলো। এ নির্বাচন নিয়ে দেশে-বিদেশে আলোচনা-সমালোচনা কম হয়নি। নতুন নতুন ইস্যুর আড়ালে সে আলোচনা কিছুটা থিতিয়ে এলেও কয়েকদিন আগে সেটি আবার আলোচনায় এসেছে। বিষয়টি নতুন করে জাগিয়ে তুলেছে খোদ নির্বাচন কমিশনের প্রকাশিত কিছু তথ্য-উপাত্ত। নির্বাচন সম্পন্ন হয়ে যাওয়ার প্রায় ছয় মাস পর নির্বাচন কমিশন তাদের ওয়েবসাইটে কেন্দ্রভিত্তিক নির্বাচনী ফলাফল আপলোড করেছে। কমিশনের প্রকাশিত কেন্দ্রভিত্তিক এ ফলাফলে অস্বাভাবিক ভোট পড়ার চিত্র উঠে এসেছে। নির্বাচন কমিশনের প্রকাশিত ফলাফল পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ১৯৭টি কেন্দ্রে ১০০ শতাংশ ভোট পড়েছে। আর ১ হাজার ৮৮৯টি কেন্দ্রে ভোট পড়েছে ৯৫ থেকে ৯৯.৯৯ শতাংশ। অর্থাৎ কিছু কেন্দ্রে ‘শতভাগ’ ভোটার ভোট দিয়েছেন। সেখানে যেমন মৃত ব্যক্তিরাও ভোট দিয়েছেন, তেমনি কারাগারে বন্দি থাকা বা জীবিকার জন্য এলাকার বাইরে থাকা বিশেষ করে মালয়েশিয়ায়, সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশে যারা প্রবাসী আছেন, তারা বাংলাদেশে না এসেও সশরীরে ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত হয়ে ভোট দিয়েছেন! বাংলাদেশে নির্বাচনী পর্যবেক্ষণের সঙ্গে যুক্ত বেসরকারি সংস্থা ফেয়ার ইলেকশন মনিটরিং অ্যালায়েন্স’র (ফেমা) প্রেসিডেন্ট মুনিরা খান বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘বিষয়টি উদ্বেগের। বাংলাদেশের বাস্তবতায় কোথাও ৭০ শতাংশের বেশি ভোট পড়লেই কমিশনের আলাদা নজর দেয়া উচিৎ, সেখানে শতভাগ ভোট পড়ার বিষয়টি একটা হাস্যকর ব্যাপার। পৃথিবীর কোথাও এটা হয় না। তবে আমরা শুধু এটা দেখেছি মিলিটারি আমলে ডিক্টেটরদের সময়। যখন তারা গণভোট নিয়েছে তখন আমরা দেখেছি হান্ড্রেড পার্সেন্ট, নাইনটি পার্সেন্ট, অনেক সময় একশ ভাগেরও বেশি ভোট পড়ার নজির আছে। এটা হয় একটা অটোক্রেটিক রুলের সময়। কিন্তু এখন তো আমাদের এখানে ডেমোক্রেসি বিদ্যমান। এখানে তো যে ভোট দিতে যাবে যাবে, ইচ্ছা হলে যাবে না। তাদের ওপরে তো কারো কোনো হাত নেই। সেখানে হান্ড্রেড পার্সেন্ট কীভাবে ভোট পড়লো এটা ইলেকশন কমিশনকেই খুঁজে বের করতে হবে।’ আবার, প্রধান নির্বাচন কমিশনার স্বীকারও করেছেন, ‘শতভাগ ভোট পড়া কোনো স্বাভাবিক ঘটনা নয়, তবে এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের করণীয় কিছু নেই। ভোটের পর পরই গেজেট আকারে ফল প্রকাশ হয়ে যায়। গেজেট প্রকাশের পর ইসির কিছু করার থাকে না। তাই খতিয়ে দেখার সুযোগ নেই। প্রিজাইডিং কর্মকর্তা, রিটার্নিং কর্মকর্তা যেহেতু এ বিষয়ে আগে কিছু জানাননি, তাই এখন ইসির কিছু করার নেই। তবে কেউ চাইলে আদালতে যেতে পারেন।’
নির্বাচন কমিশনের কি আসলেই কিছু করার নেই, নাকি তাদের কিছু করার ইচ্ছে নেই- সেটা তারাই ভালো বলতে পারবেন। তবে এটা সত্য যে, দেশের প্রায় সবকটি রাজনৈতিক দল অংশ নেয়ায় শুরুতে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ব্যাপক প্রত্যাশা তৈরি করেছিল জনগণের মধ্যে। ভোটররা বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলেন, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের গ্রানি মুছে আবার একটি অবাধ, নিরপেক্ষ, স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে তারা নতুন সরকার গঠন করার সুযোগ পেতে যাচ্ছেন। কিন্তু তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচনী ব্যবস্থার ওপর ক্ষমতাসীনদের একচেটিয়া প্রভাব বিস্তার এবং সেই প্রভাবকে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে দৃশ্যত সাপোর্ট করতে দেখে হতাশা বাড়তে থাকে জনসাধারণের মধ্যে। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তো দূরের কথা বিরোধী পক্ষ ব্যাপক হারে মামলা, হামলা, গ্রেফতারের শিকার হয়ে নির্বাচনী মাঠেই নামতে পারেননি। শেষ মুহূর্তে এসে প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর বিতর্কিত ভূমিকা, নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালটে সিল মেরে রাখা, বুথ দখল করে প্রকাশ্যে সিল মেরে জাল ভোট, বিরোধী পক্ষের পোলিং এজেন্টকে কেন্দ্রে যেতে বাধা দেওয়া ও কেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়া, বিরোধী মতের ভোটারদের কেন্দ্রে যেতে বাধা দেওয়া, ভোটারদের জোর করে নির্দিষ্ট মার্কায় ভোট দিতে বাধ্য করা, ব্যালট পেপার শেষ হয়ে যাওয়া, আগ্রহী ভোটারদের হুমকি দিয়ে তাড়ানো, ব্যালট বাক্স আগে থেকে ভরে রাখা এবং প্রতিপক্ষ দলের প্রার্থীর নেতা-কর্মীদের মারধর করার ব্যাপক অভিযোগের মধ্যে দিয়ে শেষ হয় ৩০ ডিসেম্বরের একাদশ সংসদ নির্বাচন। এসব অভিযোগের বিষয়ে দেশি-বিদেশি গণ্যমাধ্যমে স্থির চিত্র, ভিডিও চিত্রসহ অসংখ্য প্রতিবেদন প্রকাশিত এবং প্রচারিত হয়েছে। কিন্তু সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশনকে সেসব অভিযোগ আমলে নিয়ে তাদের বিশ^াসযোগ্যতা প্রমাণে তৎপর হতে দেখা যায়নি। প্রধান নির্বাচন কমিশনার এখন বলছেন, গেজেট প্রকাশ হয়ে যাওয়ার পর তাদের কিছু করণীয় নেই। কিন্তু নির্বাচনের পর ১ জানুয়ারি তারা যেদিন নির্বাচনী ফলাফলের গেজেট ছাপানোর জন্য বিজি প্রেসে দিয়েছেন সেদিনই দেশের উল্লেখযোগ্য একাধিক গণমাধ্যমে কোনো কোনো কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়ার অর্থাৎ মৃত ব্যক্তি, কারাগারে বন্দি থাকা ব্যক্তি এবং প্রবাসে থাকা ব্যক্তিরাও ভোট দিয়েছেন মর্মে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। নির্বাচন কমিশনের যদি সদিচ্ছা থাকত তাহলে তারা সেসব প্রতিবেদনে প্রকাশিত তথ্যাদি খতিয়ে দেখে সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন, কিন্তু তারা সেটা করেননি। এখন তারা প্রিজাইডিং কর্মকর্তা এবং রিটার্নিং কর্মকর্তারা কিছু জানাননি বলে কিছু করতে পারেননি বলছেন। অথচ, এই কর্মকর্তারা নির্বাচন কমিশনেরই অধীনে ছিলেন, তারা কেন সেটি জানাননি সে ব্যাপারে তো অন্তত কৈফিয়ত তলব করতে পারেন এবং দোষীদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনী ব্যবস্থা গ্রহণ করে নিজেদের দায়বদ্ধতার জায়গাটি পরিষ্কার রাখতে পারেন।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৮০ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছিল। সেটিও একটি অস্বাভাকিক চিত্র। যদিও নবম সংসদ নির্বাচনে তারচেয়েও বেশি ভোট পড়ার রেকর্ড রয়েছে। কিন্তু এটাও সত্য যে নবম এবং একাদশ সংসদ নির্বাচনের পরিবেশ এবং বাস্তবতা কোনোভাবেই একরকম ছিল না। ফলে একাদশ সংসদ নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে নানা মহল থেকে। টিআইবি দৈবচয়নের ভিত্তিতে ৩০০টি আসনের মধ্য থেকে ৫০টি আসন নির্বাচন করে প্রত্যেক আসনে স্থানীয় জনগণের মতামতের ভিত্তিতে গবেষণা করে ৪৭টি আসনেই কোনো না কোনো নির্বাচনী অনিয়মের অভিযোগ পেয়েছে। ৫০টি আসনের মধ্যে ৪৭টি আসনে টিআইবির গবেষণায় পাওয়া অনিয়মের অর্থ হচ্ছে শতকরা ৯৪ ভাগ আসনের নির্বাচনে অনিয়ম করা হয়েছে। দেশের জনগণ তো ৯৪ শতাংশ অনিয়মের নির্বাচন প্রত্যাশা করে না। অথচ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ এবং তার ভিত্তিতে নিজেদের পছন্দের সরকার নির্বাচন করা তাদের মৌলিক অধিকার। অধিকাংশ আসনে অনিয়মের মাধ্যমে নির্বাচনী ফলাফল নির্ধারণ করতে দিয়ে জনগণকে তাদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে জনগণের এই অধিকার নিশ্চিত করার দায়িত্ব ছিল নির্বাচন কমিশনের। কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়েছে নিজেদের শপথ রক্ষায়, ব্যর্থ হয়েছে ভোটারদের অধিকার রক্ষায়; ফলে আস্থা হারিয়েছে মানুষের। যার প্রতিফলন দেখা গেছে সংসদ নির্বাচনের অল্প কিছু দিন পর অনুুষ্ঠিত ঢাকা উত্তর সিটির উপনির্বাচনে। ভোটের দিন বেশিরভাগ কেন্দ্র ছিল ভোটারশূন্য, সারাদিন দায়িত্বরত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অলস সময় পার করে সন্ধ্যায় ফিরেছেন খালি বাক্স নিয়ে। দিন শেষে বলা হয়েছে ভোট পড়েছে মাত্র ৩১ শতাংশ। কদিন আগের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যেখানে ৮০ শতাংশের বেশি ভোট কাস্ট হয়েছে, সেখানে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে এই করুণ চিত্র কেন? এর অর্থ হতে পারে এই, একাদশ সংসদ নির্বাচনে ভোটাধিকার রক্ষায় নির্বাচন কমিশন তাদের যথাযথ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হওয়ায় এটা ছিল জনগণের নিরব প্রতিবাদ। অবস্থা বেগতিক দেখে প্রধান নির্বাচন কমিশনার তখন বলতে বাধ্য হয়েছিলেন, ‘ভোটারদের কেন্দ্রে নিয়ে আসার দায়িত্ব কমিশনের না।’ ভোটারদের কেন্দ্রে নিয়ে আসার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের না হলেও তারা যদি জনগণের ভোটের মর্যাদা যথাযথভাবে রক্ষা করতে পারতেন তাহলে ভোটকেন্দ্রে এই হাহাকার বিরাজ করত না। ভোটের প্রতি ভোটারদের এই অনাগ্রহের চিত্র দেখা গেছে উপজেলা নির্বাচনেও। পাঁচ ধাপের এই নির্বাচন শেষে দেখা গেছে ৪০ শতাংশেরও কম ভোট কাস্ট হয়েছে। বাস্তবতা হলো এই কাস্ট হওয়া ভোটের একটি অংশ আবার জাল ভোট। বিরোধী দল উপজেলা নির্বাচনে অংশ না নেয়ার কারণে সরকারি দলের প্রার্থীর প্রতিপক্ষ ছিল তাদেরই দলের বিদ্রোহীরা। বেশিরভাগ উপজেলাতে সরকার দলের মনোয়ন প্রাপ্তরাই নির্বাচিত হয়েছেন, তবে অনেক ক্ষেত্রে আবার বিদ্রোহীরাও জয় পেয়েছেন। সরকার দলীয় বা বিদ্রোহী প্রার্থী যেখানে যারাই পরাজিত হয়েছেন, সেখানে তারা অপর পক্ষের বিরুদ্ধে কেন্দ্র দখল করে বিপুল পরিমাণ জাল ভোট দেওয়ার অভিযোগ এনেছেন। কেউ কেউ আবার আগের রাতেই সিল মেরে বাক্স ভরে রাখার অভিযোগও করেছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অভিযোগ এতটাই বেশি ছিল যে, কমিশনকে বাধ্য হয়ে নির্বাচন স্থগিত পর্যন্ত করতে হয়েছে।
টিআইবির প্রতিবেদন প্রকাশের পর সরকারি জোটের একাধিক শরীক দলের পক্ষ থেকেও একাদশ সংসদ নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ করা হয়েছে। এসব অভিযোগের ব্যাপারে নির্বাচন কমিশন কোনো সদুত্তর দেয়নি বা দিতে পারেনি। উপরন্তু নির্বাচন কমিশন প্রকাশিত কেন্দ্রভিত্তিক ফলাফল নির্বাচন নিয়ে ওঠা পূর্বের অভিযোগগুলোকে সত্যায়িত করছে। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে এটা তাদের জন্য খুবই লজ্জাজনক। কিন্তু লজ্জা পাওয়ার পরিবর্তে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলছেন, এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের করণীয় কিছু নেই। তবে কেউ চাইলে আদালতে যেতে পারেন- বলা বাহুল্য এ ধরনের পরামর্শ দেয়ার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের না। এর মাধ্যমে কমিশনের ব্যর্থতাই প্রমাণিত হয়। বরং তাদের দায়িত্ব হচ্ছে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করে তাদের শপথ এবং পদমর্যাদা রক্ষা করা; সর্বোপরি প্রতিষ্ঠানের ভাবমর্যাদা রক্ষা করা। নির্বাচন কমিশন এ কাজটি করতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। ফলে জনগণ তাদের ভোটকে মূল্যহীন বা অর্থহীন ভাবতে শুরু করেছে। সে কারণেই তারা স্থানীয় নির্বাচনগুলোতেও কেন্দ্রে যাওয়ার প্রয়োজন অনুভব করছে না। এটি দেশ ও জাতির জন্য কোনোভাবেই কল্যাণকর নয়। বিশেষ করে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার জন্য এটা হুমকিস্বরূপ। গণতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখতে হলে নির্বাচন কমিশনকেই দায়িত্ব নিতে হবে একাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে ওঠা অনিয়ম ও অভিযোগগুলোর বিশ^াসযোগ্য সমাধানের পথ অনুসন্ধান করার। পুরো ব্যবস্থাটি খতিয়ে দেখে দোষীদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ শাস্তির ব্যবস্থা করাও কমিশনের দায়িত্ব। আর যদি তারা সে দায়িত্ব পালনে অপারগ হন তাহলে সেটা স্বীকার করে নিয়ে সরে দাঁড়ানোই হতে পারে তাদের জন্য উপযুক্ত বিকল্প।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন