বুধবার ১৩ নভেম্বর ২০২৪, ২৯ কার্তিক ১৪৩১, ১১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

সবার চোখ আগামী নির্বাচনের দিকে...

সিটি নির্বাচনোত্তর রংপুরের রাজনীতি

মহসিন রাজু , রংপুর থেকে ফিরে | প্রকাশের সময় : ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ১২:১৩ এএম

জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সাবেক প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ইন্তেকালের পর দলটির ভবিষ্যত এবং রংপুরে এর বিরাজমান জনপ্রিয়তার পারদ ওঠানামা নিয়ে পর্যবেক্ষদের মনে যে প্রশ্ন ছিল তার একটা জবাব অথবা মেসেজ সদ্যসমাপ্ত সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বোধকরি মিলেছে। গত বছরের ২৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত ওই নির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী হিসেবে বর্তমান মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা প্রতিদ্বন্দ্বীদের চেয়ে পরিষ্কার ব্যবধানে জয়লাভ করেছেন।
তার সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের প্রার্থী হোসনে আরা লুৎফা ডালিয়া ৪র্থ হয়ে নিজের জামানত হারিয়েছেন। বিএনপি জামায়াতের অবর্তমানে ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী আমিরুজ্জামান ২য় স্থান লাভ করে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন বলেও রংপুরের মানুষের ধারণা। সিটি কর্পোরেশনের ওই নির্বাচনে ৬৫.৮৮ শতাংশ ভোট কাস্টিং হওয়ায় ধারণা করা হয়, সীমিতভাবে হলেও বিএনপি/জামায়াত জোটের ভোটাররাও সিটি নির্বাচনে ভোট দিয়েছে।
রংপুর সিটি নির্বাচনের পরপরই ভেঙে দেয়া হয়েছে আওয়ামী লীগের রংপুর জেলা ও মহানগর কমিটি। গঠন করা হয়েছে নতুন আহ্বায়ক কমিটি। ১০১ সদস্যের এ নতুন জেলা আহ্বায়ক কমিটির এক নম্বর সদস্য করা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র্য ও প্রধানমন্ত্রী তনয় সজিব ওয়াজেদ জয়কে। আহ্বায়ক হয়েছেন ছায়াদাত হোসেন বকুল। এছাড়া যুগ্ম আহ্বায়ক হয়েছেন যথাক্রমে মাজেদ আলী বাবলু, জয়নাল আবেদীন ও আনোয়ারুল ইসলাম।
আওয়ামী লীগের নতুন জেলা আহ্বায়ক কমিটির অন্য প্রভাবশালী সদস্যরা হলেন, রংপুর-৩ আসনের সংসদ সদস্য এ এইচ এন আশিকুর রহমান, রংপুর-৪ আসনের সংসদ সদস্য ও বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, রংপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য এ, কে, এম, আহসানুল হক চৌধুরী এবং সাবেক মহিলা সংসদ সদস্য হোসনে আরা লুৎফা ডালিয়া।
সিটি নির্বাচনের পর দ্রুত রংপুর জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের কমিটি ভেঙে দিয়ে আহ্বায়ক কমিটি গঠনের পর এবার দ্রুততম সময়ের মধ্যেই সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন কমিটি গঠন করা হবে, নাকি আগামী জাতীয় নির্বাচন এ কমিটির মাধ্যমেই সম্পন্ন করা হবে তা নিয়ে চলছে দলের মধ্যে কানাঘুষা, আলোচনা পর্যালোচনা।
এছাড়া বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র্য সজিব ওয়াজেদ জয়ের এটা রাজনৈতিক অভিষেক বা তিনি আগামী নির্বাচনে দলের একজন প্রার্থী হয়ে নির্বাচনে লড়বেন কি না, সেটাও ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে সর্বসাধারণ্যে।
সজিব ওয়াজেদ জয়ের এ অন্তর্ভুক্তি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রংপুর মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক আবুল কাশেম বলেন, বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র্য, প্রধানমন্ত্রী তনয় বিশ্বখ্যাত হার্ভার্ড ইউনিভাসিটিতে পড়াশোনা করা উচ্চশিক্ষিত মেধাবী ব্যক্তিত্ব এবং সরকারের তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা সজিব ওয়াজেদ জয়ের অন্তর্ভুর্ক্তি আমাদের জন্য আনন্দদায়ক বৈকি। রংপুরবাসীর জন্যও এটা আনন্দের সংবাদ। তবে তিনি এবারই প্রথম জেলা আওয়ামী লীগের একনম্বর সদস্য হলেন, এমনটা নয়। তিনি আগে থেকেই দলের সাথে আছেন। আবুল কাশেমের মতে সজিব ওয়াজেদ জয় শুধু বৃহত্তর রংপুর মহানগর বা জেলা নয় বৃহত্তর রংপুরের আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের জন্য অনুপ্রেরণার কারণ।
তবে রংপুরের সিনিয়র সাংবাদিক সালেকুজ্জামান সালেকের মতে, সজিব ওয়াজেদ জয় যদি সরাসরি রংপুরের রাজনীতির হাল না ধরেন তাহলে কোন্দলে জর্জর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিকভাবে লাভের সম্ভাবনা তেমন দেখি না।
এর বিপরীতে জাতীয় পার্টির জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে বিভিন্ন শ্রেণীপেশার মানুষের সাথে কথা বলে মনে হয়েছে, এরশাদের অবর্তমানে পার্টির নেতৃত্ব নিয়ে জিএম কাদের ও রওশন এরশাদের চলমান দ্বন্দ্বের মধ্যেও রংপুরে জাতীয় পার্টির অবস্থানের খুব একটা হেরফের হয়নি। রংপুরের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ওমর ফারুকের
ধারণা, মানুষ আগামী নির্বাচনে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে ভোট দিতে পারলে রংপুরে জাতীয় পার্টির প্রাধান্য অক্ষুণ্ন থাকবে।
রংপুরের মাদরাসা শিক্ষকদের মধ্যে খুবই জনপ্রিয় নেতা ও শিক্ষাবিদ মাও. হাদিউজ্জামানের মতে রংপুরের সিটি মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফার পার্টির বাইরে যে ব্যক্তিগত ইমেজ ও জনপ্রিয়তা রয়েছে সেটারই প্রতিফলন ঘটেছে সদ্যসমাপ্ত সিটি নির্বাচনে।
তবে জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান ও রংপুর মহানগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক এস এম ইয়াসির এ প্রসঙ্গে বলেন, রংপুরের মানুষের মধ্যে সাবেক প্রেসিডেন্ট এরশাদের ইমেজ জীবন্ত ও অটুট রয়েছে। সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের ফলাফল তারই এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ। তিনি মনে করেন, আগামী নির্বাচন যদি অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু হয় তাহলে জাতীয় পার্টির জয় ঠেকিয়ে রাখা যাবে না। তার ধারণা, সরকার চাইলেও আগামীতে হয়তো ১৪ ও ১৮ সালের কায়দায় নির্বাচন করা সম্ভব নাও হতে পারে।
প্রায় একই অভিমত ব্যক্ত করেন রংপুরের জনপ্রিয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সিনিয়র জাপা নেতা, রংপুরের বদরগঞ্জ- তারাগঞ্জ এলাকার সাবেক সংসদ সদস্য আনিসুল হক মন্ডল। তিনি জোর দিয়ে ইনকিলাবকে বলেন, সবাই তাকিয়ে আছে আগামী নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হয় কি না। যদি নির্বাচন সুষ্ঠু হয়, ইন শা আল্লাহ বৃহত্তর রংপুরের ২২টি সংসদীয় আসনেই জাতীয় পার্টি বিজয়ী হবে।
এদিকে বিএনপির রাজনীতি সম্পর্কে বলতে গিয়ে কয়েকজন প্রবীন রাজনীতিক জানালেন, ১৯৭৯ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের বিপুল জনপ্রিয়তার কারণে সেসময় বিএনপি এ অঞ্চলে ভূমিধ্বস বিজয় লাভ করে। পরবর্তীকালে এরশাদের শাসনামলে অনুষ্ঠিত ’৮৬ ও ’৮৮ সালের দুটি নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি। এরপর এরশাদের পতন হলে এবং বিএনপি সরকার তাকে কারারুদ্ধ করলে রংপুরে এরশাদ ক্রেজ তৈরি হয়। ফলে পরবর্তীতে ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১, ২০০৮ সালের নির্বাচনগুলোতে সুবিধা করতে পারেনি বিএনপি। ২০১৪ সালে বিএনপি নির্বাচন বর্জন করে আর ২০১৮ সালের ভোট ট্রাজেডি পুরোটাই যায় বিএনপির প্রতিকুলে। জামায়াতের সাথে বিএনপিও চরম নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। চরম সরকারি নিপীড়নের কারণে অত্যন্ত শক্তিশালী সংগঠন থাকা সত্ত্বেও জামায়াত বর্তমানে অত্যন্ত কোণঠাসা অবস্থায় থেকে গোপনে তাদের কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে বলে জানা গেল। তবে সুযোগ পেলে জামায়াত ব্যাপক শোডাউনের মাধ্যমে শব্দ করে রাজনীতির মাঠে উদয় হবে বলে বললেন কেউ কেউ।
রংপুরে বিএনপির বর্তমান রাজনীতি এবং আগামী নির্বাচনের কৌশল নিয়ে জানতে চাইলে রংপুর মহানগর বিএনপির যুগ্মআহ্বায়ক মাহফুজ উন-নবী ডন জানালেন, গত বছরের শেষে রংপুরে বিএনপির সফল মহাসমাবেশের পর রংপুরের রাজনীতির হিসাব নিকাশই পাল্টে গেছে। বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলে শহীদ জিয়াউর রহমান, কারাবন্দী দেশমাতা খালেদা জিয়া এবং বিএনপির প্রতি সর্বসাধারণের ভালোবাসার চিত্র ফুটে উঠেছে ওই মহাসমাবেশে। তবে নির্বাচন নয়, এ মুহূর্তে বিএনপির টার্গেট বর্তমান সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করে বেগম খালেদা জিয়াকে কারামুক্ত করা। কারণ বর্তমান সরকারকে ক্ষমতাকে উৎখাত করা ছাড়া এদেশে অবাধ, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু নির্বাচন আশা করা যায় না।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন