পূর্ব প্রকাশিতের পর
১০. ইস্তেগফারে আমল সংশোধন: ইস্তেগফার বান্দার আমল সংশোধন করে দেয়। ইস্তেগফারের আমল শুধু গুনাহ সমূহ ই মাফ করে না, বান্দার খারাপ অভ্যাস, খারাপ আমল, অসৎ স্বভাব দূর করে একজন শান্তি প্রিয়, মজবুত ইমানদার, আল্লাহ ওয়ালা মানুষ হিসেবে গড়ে তুলে। হযরত হুযায়ফা রাঃ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আমার পরিবার পরিজনের সাথে অশালীন ভাষায় কথা বলতাম। আমি একদিন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আরজ করলাম হে আল্লাহর রাসুল, আমার ভয় হয়, আমার জবান আমাকে জাহান্নামে প্রবেশ করে দেয়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, তুমি ইস্তেগফার হইতে কেন দূরে থাক? আমিতো প্রত্যেক দিন আল্লাহ তায়ালার নিকট একশত বার ইস্তেগফার করে থাকি। মোস্তাদরাকে হাকেম।
১১. ইস্তেগফারে ইবাদাতের পূর্ণতা: আমরা সারা দিন বিভিন্ন ইবাদাত করে থাকি। আমরা অযু করি, নামাজ পড়ি, হ্জ্জ আদায় করি। এই প্রত্যেকটি কাজ করতে গিয়ে আমাদের কোন কোন ক্রুটি হয়ে থাকে। মহান রবের শান মান অনুযায়ী আমাদের ইবাদাতগুলো হয় না। কোন না কোন ঘাটতি থাকে। তাই প্রত্যেক ভাল কাজের পূর্ণতার জন্য ইস্তেগফার পড়া চাই। ইস্তেগফার আমাদের ইবাদাতের ঘাটতি পূরণ করে ইবাদাতে পরিপূর্ণতা দান করে। হযরত সাওবান রাঃ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন নামাজ হতে অবসর হতেন অর্থাৎ সালাম ফিরাতেন তখন তিন বার ইস্তেগফার করতেন তারপর বলতেন, ইয়া আল্লাহ, তুমি শান্তি ময়। তোমার থেকেই শান্তি লাভ হয়। তুমি বরকতময় হে পরাক্রম ও মহাসম্মানের অধিপতি। মুসলিম।
আবু সাইদ খুদরী রাঃ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যদি কেহ অযু করার পর বলে, আয় আল্লাহ তুমি পবিত্র, সকল প্রশংসা তোমার, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি তুমি ছাড়া কোন প্রভু নেই। তোমার নিকট ইস্তেগফার করছি (ক্ষমা প্রার্থনা করছি)। আর তোমার দিকেই আমি ফিরে এলাম। তা হলে এই শব্দগুলো একটি সীল মোহরকৃত পাত্রে সংরক্ষণ করে আরশের নিচে রেখে দেওয়া হবে। অতপর কেয়ামত পর্যন্ত এই সীল মোহর ভাঙ্গা হবে না। নাসায়ী।
১২. ইস্তেগফার জীবন থেকে পাপ কাজ সরিয়ে দেয়: ইস্তেগফার এমন এক নিরাময়, ইস্তেগফারকারী ইস্তেগফারের বদৌলতে কোন গুনাহের কাজের উপর হঠকারী হতে পারে না। হয়তো বা বেখেয়ালে, নফসের তাড়নায় গুনাহ করে ফেলে। এই গুনাহের উপর সে অবিচল থাকতে পারে না। ইস্তেগফার তাকে ধাক্কা দিয়ে গুনাহের কাছ থেকে সরিয়ে নিয়ে আসে। আবু বাকার সিদ্দিক রাঃ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি ইস্তেগফার করতে থাকে, সে সেসব লোকদের অন্তর্ভূক্ত নয় যারা গুনাহের উপর হঠকারিতা করে থাকে। চাই সে একদিনে সত্তর বার পর্যন্ত গুনাহ করে থাকুক না কেন। তিরমিজি, আবু দাউদ।
১৩. ইস্তেগফার মনের কালিমা দূর করে দেয়: বান্দা যখন পাপ করে তার অন্তরে কাল দাগ পড়তে থাকে। সাদা কাপড়ে ময়লা লাগার মতো। ইস্তেগফার সেই ময়লা পরিস্কার করার অর্থাৎ কাপড় ধোয়ার সাবান। বান্দা যখন ইস্তেগফার পড়ে, তখন তার অন্তরের কালো দাগ আর থাকতে পারে না। ধবধবে সাদা হয়ে যায়। আবু হুরায়রা রাঃ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, নিশ্চয় মুমিন বান্দা যখন কোন পাপ করে, তার অন্তরে তখন একটি কালো দাগ পড়ে। এমতাবস্থায় সে যদি তাওবা ইস্তেগফার করে তাহলে তার অন্তর পরিস্কার হয়ে যায়। আর যদি তওবা ইস্তেগফার না করে, আরো গুনাহ বেড়ে চলে, তাহলে তার কালো দাগ আরো বাড়তে থাকে। এমন কি তা অন্তরকে ঘ্রাস করে ফেলে। আহমাদ, তিরমিজি।
১৪. ইস্তেগফার সকল কঠিন কাজ সহজ করে দেয়: জীবন চলার পথে আমাদের অনেক কিছুর মুখোমুখি হতে হয়। অনেক কাজ আমাদের জন্য খুব কঠিন। তখন অনেক পেরেশানী এসে মাথায় ভর করে। সকল কঠিন কাজ সহজ করার জন্যও চাই ইস্তেগফার। ইবনে আব্বাস রাঃ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি ইস্তেগফারে মগ্ন থাকবে আল্লাহ তায়ালা তার জন্য সকল কঠিন বাধা অতিক্রম করার পথ তৈরী করে দেবেন এবং প্রত্যেক দুশ্চিন্তার অবসান ঘটিয়ে প্রশস্ততা দান করবেন। আর তাকে এমন জায়গা থেকে রিজিকের ব্যবস্থা করে দেবেন যেখান থেকে রিজিক লাভের চিন্তাও সে করবে না। আহমাদ, আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ।
১৫. মুসলামানদের জন্য ইস্তেগফার পড়াও নিজের জন্য উপকারী: অন্যের জন্য ইস্তেগফার পড়লে নিজের অনেক লাভ হয়। হযরত উবাদা ইবনে সামিত রাঃ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে বলতে শুনেছি যে ব্যক্তি মুমিন নর নারীর জন্য ইস্তেগফার পড়বে আল্লাহ তায়ালা তার জন্য প্রত্যেক মুমিন নর নারীর ইস্তেগফারের বিনিময়ে একটি করে নেকী লিখে দিবেন। তাবরানী।
১৬. যার উপর পরোক্ষ নিন্দা করা হয়েছে তার জন্য ইস্তেগফার: গীবত একটি মারাত্মক ব্যধি। গীবতে করতে এবং শোনতে শয়তান খুব মজাদার হিসেবে উপস্থাপন করে। গীবত করার পর যার উপর গীবত করা হয়েছে তার নিকট মাফ চেয়ে নেওয়া জরুরী। তারপরও যদি কোন শরয়ী কারনে সম্ভব না হয় অন্তত তার জন্য এবং নিজের জন্য ইস্তেগফার করা জরুরী। হযরত আনাস রাঃ হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, পরোক্ষ নিন্দার একটি কাফফারা এই যে, তুমি যার উপর পরোক্ষ নিন্দা করেছ, তার জন্য ইস্তেগফার করবে। এই ভাবে বলবে হে আল্লাহ আমাদেরকে ক্ষমা করুন এবং তাকে ক্ষমা করুন। বায়হাকী।
১৭. মৃত্যু পিতা মাতার সাথে বেয়াদবীর কাফফারা ইস্তেগফার: পিতা মাতাকে কোন ভাবেই কষ্ট দেওয়া উচিত নয়। তারপরও বেখেয়ালে অনেক সময় আমরা পিতা মাতাকে কষ্ট দিয়ে ফেলতে পারি। কষ্ট দিলে সাথে সাথে মাফ চেয়ে নেওয়া উচিত। কিন্তু কষ্ট দেওয়ার পর যদি মাফ চাওয়া না হয় বা সুযোগ না পাওয়া যায়। এমতাবস্থায় যদি পিতা মাতা মারা যান বা দুজনের একজন মারা যান। তখন মৃত্যু পিতার মাতার নিকট থেকে ক্ষমা পেতেও ইস্তেগফার জরুরী। আনাস রাঃ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন নিশ্চয় এমন হয়ে থাকে যে, কোন লোকের পিতা মাতা মারা যান অথবা দু জনের একজন গত হন। আর অবস্থা এমন যে সে তাদের জীবদ্দশায় তাদের নাফরমানী করত এবং তাদেরকে কষ্ট প্রদান করত। এখন তাদের মৃত্যুর পর তাদের জন্য দোয়া ও ইস্তেগফার করতে থাকে। এমন কি আল্লাহ তায়ালা তাকে পিতা মাতার সাথে উত্তম আচরণকারীদের মধ্যে লিখে ফেলেন। বায়হাকী।
১৮. ইস্তেগফার মর্যাদা বৃদ্ধি করে: আব্দুল্লাহ ইবনে বুশর রাঃ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, সেই ব্যক্তির অবস্থা অতি উত্তম, যে কিয়ামতের দিন তার আমলনামায় প্রচুর সংখ্যক ইস্তেগফার পাবে। ইবনে মাজাহ।
১৯. প্রতিদিনের প্রথম কাজ ইস্তেগফার এবং শেষ কাজ ইস্তেগফার: আনাস রাঃ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, পাহারাদার দুইজন ফেরেস্তাগন, যখন কোনদিন আল্লাহ তায়ালার সম্মুখে কোন বান্দার আমলনামা পেশ করেন এবং তার আমলের শুরুতে ইস্তেগফার ও শেষে ইস্তেগফার লেখা থাকে তখন আল্লাহ তায়ালা বলেন, আমি আমার বান্দার সেই সবকিছু ক্ষমা করে দিলাম যা এই আমলনামার দুই প্রান্তের মাঝখানে রয়েছে। বাযযার।
২০. ইস্তেগফারে জান্নাতে পৌছিয়ে দেয়: ইস্তেগফার এমন এক আশ্চর্য বন্ধু যার ফল দুনিয়াতেই শেষ হয় না। বান্দাকে পরকালে জান্নাতে পৌছানো পর্যন্ত তার ফললাভ চলতে থাকে। বান্দাকে জান্নাতে পৌছা পর্যন্ত সে ক্ষান্ত হয় না। মহান রব সুরা আল ইমরানের ১৩৫-১৩৬ আয়াতে বলেন, “আর যারা, যখন কোনো গর্হিত কাজ করে বা নিজেদের প্রতি অন্যায় করে, তখন আল্লাহ্কে স্মরণ করে ও তাদের অপরধের জন্য পরিত্রাণ চায় (ইস্তেগফার পড়ে), প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ্ ছাড়া আর কে অপরাধ ক্ষমা করে? আর তারা যা করেছিল তাতে জেনেশুনে আঁকড়ে ধরে থাকে না। এদের পুরস্কার হচ্ছে এদের প্রভুর কাছ থেকে পরিত্রাণ ও জান্নাত যাদের নিচে দিয়ে বয়ে চলে ঝরনারাজি, সেখানে তারা থাকবে স্থায়ীভাবে, আর কর্মীবৃন্দের পুরস্কার কী চমৎকার!”
উপরের আলোচনায় এই বিষয়টি পরিস্কার আমাদের সকল প্রয়োজনে চাই ইস্তেগফার। ইস্তেগফার আমার জীবন কে সহজ সাবলীল ও সুন্দরের হাতিয়ার। এই করোনা ভয়াল থাবায় আমাদের প্রয়োজন ইস্তেগফার। জীবনে প্রতি বাঁকে বাঁকে প্রয়োজন ইস্তেগফার। মাওলার রহমত, দয়া, ক্ষমা, সাহায্য পেতে চাই ইস্তেগফার। কঠিন বিপদে, যুদ্ধ বিগ্রহে, বাতিলের সাথে সংগ্রামে আমার শক্তিশালী অস্ত্র এই ইস্তেগফার। পরকালীন মুক্তির গ্যারান্টি এই ইস্তেগফার। আজাব গজবে নিরাপত্তার গ্যারান্টি এই ইস্তেগফার। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যার কোন পাপ ছিল না। তিনি প্রতিদিন কমপক্ষে ১০০ বার ইস্তেগফার করতেন। আর আমার কী অবস্থা? আমার হালত পরিবর্তনে আজ প্রয়োজন ইস্তেগফার। আসুন ইস্তেগফার পড়ি, ইস্তেগফার করি। নিজের জীবনকে বদলে দেই। ইস্তেগফারের মাধ্যমে বদলে যাই। মহান রব তৌফিক দিন। আমীন।
লেখক : ইসলামী চিন্তাবিদ, গবেষক।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন