মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মানবজাতিকে তাঁর ইবাদাত করার জন্য সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহপাকের নির্দেশিত এবং তাঁরই প্রেরিত নবী রাসুল (আঃ) গণের আমলসমুহ নেক আমল হিসেবে পরিগণিত। পবিত্র কোরআন ও হাদীস নেক আমল কে ‘আমলে সালেহ’ বলে ঘোষনা করেছে। মুহাক্কিক ওলামায়ে কেরাম বলেন, যে সকল কাজ আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.) এর নির্দেশনা মোতাবেক করা হয়, উক্ত আমলের প্রতিদান হিসেবে আমলকারী ব্যক্তির আমলনামায় নেকি লেখা হয় ঐ সকল কাজকে নেক কাজ বা ‘আমলে সালেহ’ বলে। নেক কাজ তথা নেক আমলকারী ব্যক্তি আল্লাহপাকের প্রিয় বান্দাহ হিসেবে বিবেচিত হয়। আল্লাহপাক নেক আমলকারী ব্যক্তির উপর রাজিখুশি হয়ে যান। তাকে মহা প্রতিদানে পুরস্কৃত করেন।
‘আমলে সালেহ’ বা নেক আমল ব্যক্তিকে যথাযথভাবে ধর্মকর্ম পালনে উদ্বুদ্ধ করে। ব্যক্তিকে বাস্তবিক ও কল্যাণকর জীবন যাপনে উৎসাহিত করে। ব্যক্তিকে পরকালীন ভাবনায় উজ্জীবিত করে। নেক আমলের উসিলায় ব্যক্তি কেবল আল্লাহপাকের প্রিয় বান্দাহ হিসেবে পরিচিত হয় না বরং সমাজে ভালো মানুষ হিসেবেও বিবেচিত হয়। নেক আমলের প্রাত্যহিক অনুশীলনের কারনে আমলকারী ব্যক্তি আল্লাহর মাকবুল বান্দাহদের নিকটতম হবার সৌভাগ্য লাভ করে। এমন কি উক্ত নেক আমলকারী ব্যক্তি আল্লাহর পরমপ্রিয় হয়ে যায়। সমাজের সকল শ্রেনীর মানুষ তাকে পরম শ্রদ্ধা করে।
নেক আমলের প্রতিযোগীতা সম্পর্কে পবিত্র কোরআনের বর্ণনাঃ নেক আমলের প্রতিযোগীতা করণের বিষয়ে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পবিত্র কোরআন মাজীদে ইরশাদ করেন, ‘তোমরা নেক কাজে পরস্পর প্রতিযোগিতা কর।’ (সূরা মায়িদা : আয়াত: ৪৮)। যে সকল ব্যক্তি আল্লাহ বিধান অনুযায়ী ‘নেক আমল’ করে তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, দৃঢ় ইমান ও নেক আমলের প্রতিযোগীতা বিষয়ে আল্লাহপাক ইরশাদ করে বলেন,‘নিশ্চয় যারা তাদের পালনকর্তার ভয়ে সন্ত্রস্ত। যারা তাদের পালনকর্তার কথায় বিশ্বাস স্থাপন করে। যারা তাদের পালনকর্তার সাথে কাউকে শরীক করে না এবং যারা যা দান করবার, তা ভীত, কম্পিত হৃদয়ে এ কারণে দান করে যে, তারা তাদের পালনকর্তার কাছে প্রত্যাবর্তন করবে, তারাই কল্যাণ দ্রুত অর্জন করে এবং তারা তাতে অগ্রগামী। (সুরা আল মু‘মিনুন: আয়াত: ৫৭-৬১)। তিনি আরো বলেন, ‘তারা সবাই সমান নয়। আহলে কিতাবদের মধ্যে কিছু লোক এমনও আছে যারা অবিচলভাবে আল্লাহর আয়াতসমূহ পাঠ করে এবং রাতের গভীরে তারা সেজদা করে। তারা আল্লাহর প্রতি ও কিয়ামত দিবসের প্রতি ঈমান রাখে এবং কল্যাণকর বিষয়ের নির্দেশ দেয়; অকল্যাণ থেকে বারণ করে এবং সৎকাজের জন্য সাধ্যমত চেষ্টা করতে থাকে। আর এরাই হল সৎকর্মশীল। তারা যেসব সৎকাজ করবে, কোন অবস্থাতেই সেগুলোর প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করা হবে না। আর আল্লাহ পরহেযগারদের বিষয়ে অবগত। (সুরা আলে ইমরান: আয়াত: ১১৩-১১৫)।
তিনি আরো ইরশাদ করেন, ‘ঈমান গ্রহণ করার পর যে কোনো নারী-পুরুষ আমলে সালেহ করবে, আমি তাকে দান করবো উত্তম পবিত্র জীবন এবং তাদের সবচেয়ে ভালো কাজগুলোর ভিত্তিতে পুরস্কার দেবো।’ (সুরা আন-নাহল : আয়াত: ৯৭)।
তিনি আরো বলেন, ‘তবে যে কেউ ঈমান আনবে এবং আমলে সালেহ্ করবে, তার জন্যে থাকবে সর্বোত্তম পুরস্কার এবং তার প্রতি আমার বিষয়গুলো বলবো সহজভাবে।’ (সুরা কাহফ : আয়াত: ৮৮)।
নেক আমলের প্রতিযোগীতা বিষয়ে পবিত্র হাদীস শরীফের বর্ণনাঃ নেক আমলের প্রতিযোগীতার পূর্ব প্রস্তুতি ও নেক আমলের গুরুত্ব সম্পর্কে রাসুল (সা.) এর পবিত্র যবান নিঃসৃত হাদীস, হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, হযরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : সাতটি বিষয়ের পূর্বে তোমরা দ্রুত নেক আমল করো। তোমরা কি এমন দারিদ্র্যের অপেক্ষা করছ, যা তোমাদেরকে সবকিছু ভুলিয়ে দেবে? না ওই ঐশ্বর্যের, যা তোমাদেরকে দর্পিত বানিয়ে ছাড়বে? নাকি এমন রোগের, যার আঘাতে তোমরা জরাজীর্ণ হয়ে পড়বে? না সেই বার্ধক্যের, যা তোমাদেরকে অথর্ব করে ছাড়বে? নাকি মৃত্যুর, যা আকস্মিক এসে পড়বে? নাকি দাজ্জালের, অনুপস্থিত যা কিছুর জন্যে অপেক্ষা করা হচ্ছে, সে হচ্ছে সেসবের মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট? না কিয়ামতের অপেক্ষা করছ, যে কিয়ামত কিনা সর্বাপেক্ষা বিভীষিকাময় ও সর্বাপেক্ষা তিক্ত? ( জামে তিরমিযী: হাদীস নং: ২৩০৬)।
হযরত আমর ইবনে মায়মুন (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘তোমরা পাঁচটি জিনিসকে পাঁচটি জিনিসের পূর্বে গণিমত-সুবর্ণ সুযোগ মনে কর। তোমার যৌবনকে কাজে লাগাও বার্ধক্য আসার পূর্বে, তোমার সুস্থতাকে কাজে লাগাও তোমার অসুস্থতার পূর্বে, তোমার সচ্ছলতাকে কাজে লাগাও অসচ্ছলতার পূর্বে, তোমার অবসরতাকে কাজে লাগাও তোমার ব্যস্ততার পূর্বে, আর তোমার জীবনকে কাজে লাগাও তোমার মৃত্যু আসার পূর্বে।’ (মিশকাতুল মাসাবীহ, তাফসীরে বাগাবী: ৫৪৪/৩)।
আবূ হুরাইরা (রা.) হতে বর্ণিত যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আজ তোমাদের মাঝে কে সিয়াম পালনকারী? আবূ বকর (রাযিঃ) বললেন, আমি। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ আজ তোমাদের মাঝে কে একটা জানাযাকে অনুকরণ করেছো? আবূ বাকর (রা.) বললেন, আমি। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ তোমাদের মাঝে কে একজন মিসকীনকে আজ খাবার দিয়েছো? আবূ বাকর বললেন, আমি। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ তোমাদের মাঝে কে আজ একজন অসুস্থকে দেখতে গিয়েছো? আবূ বাকর (রা.) বললেন, আমি। তারপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ যার মধ্যে এ কাজগুলোর সংমিশ্রণ ঘটেছে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। (সহীহ মুসলিম: হাদিস নং: ৬০৭৬)।
ভালো কাজ বা নেক আমলের উপকারিতাঃ ভালো কাজ তথা নেক আমলের ইহ-পারলৌকিক অনেক উপকারিতা রয়েছে। ১. যে ব্যক্তি যে কোন ভালো বা কল্যাণমুলক কাজে অংশ নেয় অথবা ব্যক্তিগত কিংবা সামষ্টিকভাবে নেক আমলে শামিল হয় তাহলে ঐ ব্যক্তির উপর আল্লাহপাক সন্তুষ্ট হন। ২. নেক কাজে অংশকারী ব্যক্তিকে আল্লাহপাক সকল অবস্থায় ভালো কাজ করার তাওফিক দান করেন। ৩. নেক কাজের প্রতিদান হিসেবে আল্লাহপাক নেককার বান্দাহকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। ৪. কল্যাণমুলক কাজে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিকে জনগণ ভালোবাসে। ৫. ভালো কাজে অংশ নেয়া ব্যক্তির প্রতি মানুষ পরম শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের সাথে সাথে দোয়াও করে। ৬. নেককাজে রত ব্যক্তি সকলকে সাহায্য সহযোগীতা করার মানসিকতা তৈরী হয়, তারা মানুষের নিকট প্রিয় হয়ে উঠে। ৭. নেককাজে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তি আত্মিক প্রশান্তি লাভ করে। ৮. নেককাজে রত ব্যক্তি অন্যদের তুলনায় সুস্থ থাকে। ৯. নেককাজে লিপ্ত ব্যক্তি সকল প্রকার মন্দকাজ থেকে দুরে থেকে নিজের আত্মসংশোধন করতে পারে। ১০. নেক আমলকারী ব্যক্তি অগণিত সাওয়াব হাসিল করে।
নেক আমলের প্রতিদানঃ পবিত্র কুরআন সুন্নাহর এ প্রসঙ্গে অসংখ্য বর্ণনা রয়েছে, অতীব গুরুত্বপূর্ণ বর্ণনাগুলো উল্লেখ করা হলো। নেককার ব্যক্তির নেক আমলের প্রতিদান বিষয়ে আল্লাহপাক ইরশাদ করেন, ‘যারা আল্লাহর রাস্তায় স্বীয় ধন সম্পদ ব্যয় করে, তাদের উদাহরণ একটি বীজের মত, যা থেকে সাতটি শীষ জন্মায়। প্রত্যেকটি শীষে একশ করে দানা থাকে। আল্লাহ অতি দানশীল, সর্বজ্ঞ। যারা স্বীয় ধন সম্পদ আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করে, এরপর ব্যয় করার পর সে অনুগ্রহের কথা প্রকাশ করে না এবং কষ্টও দেয় না, তাদেরই জন্যে তাদের পালনকর্তার কাছে রয়েছে পুরস্কার এবং তাদের কোন আশংকা নেই, তারা চিন্তিতও হবে না। (সুরা বাকারাহ: আয়াত: ২৬১-৬২)। তিনি আরো বলেন, ‘যারা আল্লাহর রাস্তায় স্বীয় ধন-সম্পদ ব্যয় করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে এবং নিজের মনকে সুদৃঢ় করার জন্যে তাদের উদাহরণ টিলায় অবস্থিত বাগানের মত, যাতে প্রবল বৃষ্টিপাত হয়; অতঃপর দ্বিগুণ ফসল দান করে। যদি এমন প্রবল বৃষ্টিপাত নাও হয়, তবে হাল্কা বর্ষণই যথেষ্ট। আলাহ তোমাদের কাজকর্ম যথার্থই প্রত্যক্ষ করেন। (সুরা বাকারাহ: আয়াত: ২৬৫)। তিনি আরো বলেন, ‘আপনার পালনকর্তা জানেন, আপনি এবাদতের জন্যে দন্ডায়মান হন রাত্রির প্রায় দু’তৃতীয়াংশ, অর্ধাংশ ও তৃতীয়াংশ এবং আপনার সঙ্গীদের একটি দলও দন্ডায়মান হয়। আল্লাহ দিবা ও রাত্রি পরিমাপ করেন। তিনি জানেন, তোমরা এর পূর্ণ হিসাব রাখতে পার না। অতএব তিনি তোমাদের প্রতি ক্ষমা পরায়ন হয়েছেন। কাজেই কোরআনের যতটুকু তোমাদের জন্যে সহজ, ততটুকু আবৃত্তি কর। তিনি জানেন তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ অসুস্থ হবে, কেউ কেউ আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধানে দেশে-বিদেশে যাবে এবং কেউ কেউ আল্লাহর পথে জেহাদে লিপ্ত হবে। কাজেই কোরআনের যতটুকু তোমাদের জন্যে সহজ ততটুকু আবৃত্তি কর। তোমরা নামায কায়েম কর, যাকাত দাও এবং আল্লাহকে উত্তম ঋণ দাও। তোমরা নিজেদের জন্যে যা কিছু অগ্রে পাঠাবে, তা আল্লাহর কাছে উত্তম আকারে এবং পুরস্কার হিসেবে বর্ধিতরূপে পাবে। তোমরা আল্লাহর কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল, দয়ালু। (সুরা মুয্যাম্মিল: আয়াত: ২০)।
নেক আমলের প্রতিদান বিষয়ে হাদীস শরীফে বর্ণিত রয়েছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘নিশ্চয়ই মুমিন ব্যক্তি যদি কোন নেককাজ কিংবা ভালো কাজ করে তাহলে ঐ ব্যক্তির মৃত্যুর পর তার সাথে তার নেকআমল মিলিত হবে অর্থ্যাৎ আমলনামায় তার প্রতিদান লিপিবদ্ধ হবে। যদি মুমিন ব্যক্তি জীবদ্দশা ও সুস্থ অবস্থায় ইলম শিক্ষাদান করে কিংবা ইলম প্রচার প্রসার করে, নেক সন্তান রেখে যায়, কোন উপকারী কিতাব রচনা করে, মসজিদ তৈরি করে, মুসাফিরের জন্য লঙ্গরখানা বানায়, পুকুর কিংবা দিঘী খনন করে, নিজের সম্পদ থেকে সদকা জারিয়ার আমল চালু করে তাহলে এ সমস্ত নেক আমলের প্রতিদান তার মৃত্যুর পর তার সাথে মিলিত হবে। (সহীহ আলবানী: হাদিস নং: ২২৪)।
পরিশেষে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদেরকে নেক আমলে প্রতিযোগীতায় শামিল হয়ে উভয় জাহানের অশেষ কামিয়াবী লাভের তাওফিক দান করুন। আমীন।
লেখকঃ মোঃ আবদুল গনী শিব্বীর, মুহাদ্দিস, নোয়াখালী কারামাতিয়া কামিল মাদরাসা, সোনাপুর, সদর, নোয়াখালী।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন