বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ধর্ম দর্শন

অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম (রহ) স্মরণে

মো. বশির হোসেন মিয়া | প্রকাশের সময় : ৭ অক্টোবর, ২০২১, ১২:০৩ এএম

অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম একটি নাম, একজন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী হাক্কানী আলেম। তিনি ১৯৪৪ সালের ৩০ এপ্রিল বর্তমান মাগুরা জেলার শ্রীপুর উপজেলার দ্বারিয়াপুর গ্রামে সম্ভ্রান্ত পীর পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।

পিতা উপমহাদেশের প্রখ্যাত ওলিয়ে কামেল ফুরফুরা শরীফের পীর মুজাদ্দীদে যামান হযরত মওলানা শাহ সূফী আলহাজ্ব আবু বকর সিদ্দিকী রহমাতুল্লাহি আলাইহির অন্যতম খলিফা, নায়েবে মুজাদ্দীদে যামান হযরত মওলানা শাহ সূফী আলহাজ্ব তোয়াজউদ্দীন আহমদ (রহ) এবং মাতা মোছা. জোহরা খাতুন (রহ)।

বিরল প্রতিভার অধিকারী শিশুটি ছিলেন মা-বাবার দ্বিতীয় সন্তান। তাঁর বড় ভাই হুজুর কিবলার প্রথম সন্তান আবুল বাশার মুহম্মদ আবদুল হাই (রহ)। যিনি শৈশবেই দুনিয়া থেকে চিরবিদায় নেন। সেহেতু শিশু আবুল হাসান একটু বেশিই স্নেহাশীর্বাদ ও আদর যত্ন পেয়েছেন। ছোটবেলায় তাঁর শিক্ষার হাতেখড়ি মা মোছাঃ জোহরা খাতুনের কাছে। বিদূষী স্নেহময়ী মা তাঁকে আরবি-বাংলায় শিক্ষা দিতেন এবং নানারকম ইসলামিক গল্প ও কাসিদা শুনিয়ে ঘুম পাড়াতেন। তিনি শৈশবেই মাতার কাছে কুরআন শিক্ষা গ্রহণ করেন। আর আব্বা আলেমে হাক্কানীর কাছে বাল্যকাল থেকেই আধ্যাত্মিকতা শিক্ষার মাধ্যমে শৈশবের পাঠ শেষ করেন।

তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় গ্রামের দ্বারিয়াপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে। এরপর খুলনা বিকে ইনস্টিটিউট ও মাগুরা হাই মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেন। ১৯৬২ সালে তিনি ঢাকা সরকারি ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজের মাদ্রাসা শাখা থেকে মাদ্রাসা শিক্ষায় চূড়ান্ত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর জেনারেল শিক্ষা লাভের জন্য তিনি কুষ্টিয়া সরকারি কলেজে ভর্তি হন। ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের অধীনে জগন্নাথ কলেজ থেকে ইসলামের ইতিহাস, সমাজ কল্যাণ, রাষ্ট্র বিজ্ঞান, বাংলা ও ইংরেজি বিষয় নিয়ে কৃতিত্বের সঙ্গে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ে ভর্তি হন। পরে ১৯৭০ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঐ বিষয়ে কৃতিত্বের সঙ্গে স্নাতোকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ছাত্রজীবনে তিনি প্রগতিশীল ছাত্র আন্দোলন, ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান এবং ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।

১৯৬৬ সালে পিতা শাহ সূফী তোয়াজউদ্দীন আহমেদ (রহ) তাঁকে উচ্চস্তরের আধ্যাত্মিক শিক্ষা ইলমে লাদুনীর ছবক দেন। আর যারা এ ছবক লাভ করেন তারা আল্লাহ প্রদত্ত নিগুঢ় জ্ঞানের অধিকারী হন। তাইতো তাঁর লেখনী ও জ্ঞানগর্ভ আলোচনা ও বক্তৃতায় বিজ্ঞজনেরা এসব অনুধাবন করতেন। জ্ঞানবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা প্রশাখায় তাঁর বিশেষ অবদান স্পষ্ট প্রতিয়মান হয়। তিনি ছিলেন সমকালীন বাংলাদেশের পীরদের ও আলেম সমাজের অহংকার। আলেম ওলামাগণের অনেকে তাঁর কাছে আধ্যাত্মিক জ্ঞান আহরণ করতেন এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা করতেন।

হাসান আব্দুল কাইয়ূম এর পেশাগত জীবন শুরু হয় কলেজে অধ্যাপনার মাধ্যমে। তিনি মাগুরার শ্রীপুর ডিগ্রী কলেজ, মাগুরার হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, ঢাকার হাবীবুল্লাহ বাহার কলেজসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ে শিক্ষকতা করেন। ১৯৮০ সালে জানুয়ারি মাসে ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ-এর সহকারী পরিচালক হিসেবে যোগদান করে খুব অল্প দিনেই পরিচালক পদে উন্নীত হন এবং ২০০২ সালে সফলতার সাথে কর্মজীবন শেষ করে অবসর নেন। ইসলামিক ফাউন্ডেশনে কর্মরত অবস্থায় তাঁর মাধ্যমে ইসলামের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ যেমন-তাফসিরে তাবারি, বুখারি শরিফ, ইসলামী বিশ্বকোষ প্রভৃতি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। ইসলামি বিশ্বকোষে তাঁর অনেকগুলো মৌলিক ও অনূদিত প্রবন্ধ-নিবন্ধ রয়েছে। তিনি ছোট বড় বিভিন্ন বয়সী পাঠকদের জন্য লিখেছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থসমূহ হলো: অনুপম আদর্শ, ফুরফুরার চাঁদ, প্রসঙ্গ ইসলাম, ইসলাম ও জীবন, মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী, তাফসিরে তারাবী, খোকা-খুকুর ছড়া, জিহাদ, কাদেরিয়া তরিকা, তা’লীমে তাসাউফ, সাবির কাব্যে ইসলামী ভাবধারা ইত্যাদি। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘অগ্রপথিক’, শিশু পত্রিকা ‘সপ্তডিংগা’ ও সাহিত্য সাময়িকী ‘ঐতিহ্য’-এর সম্পাদক ছিলেন তিনি।

তিনি তাঁর পিতার স্মরণে আঞ্জুমানে তোয়াজিয়া নামে একটি জনকল্যাণ মূলক সংস্থা গড়ে তোলেন। দারিয়াপুর দরবার শরিফে তিনি গড়ে তোলেন আঞ্জুমানে তোয়াজিয়া নামে একটি এতিমখানা। তিনি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ফুরফুরা সিলসিলার দ্বারিয়াপুর দরবার শরীফের গদিনশিন পীর ছিলেন।

অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম (রহ) গতবছর ৬ অক্টোবর মহামারী করোনায় আক্রান্ত হয়ে ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রফিকুল আ’লার ডাকে সাড়া দিয়ে অগণিত মুরিদ ভক্ত ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের চোখ পানিতে ভাসিয়ে এ নশ্বর পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন। ইসলামের সৌন্দর্য্যকে তিনি সবসময় সমুন্নত রাখতে সচেষ্ট ছিলেন। কেউ এসব বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করলে তিনি কোরআন হাদিসের আলোকে দাঁতভাঙ্গা জবাব দিতেন। বিশেষ করে মীলাদ কিয়াম ও ঈদে মীলাদুন্নবীর ব্যাপারে তিনি ছিলেন সোচ্চার এবং রসূল (সা.) এর শান মান মর্যাদাকে সমুন্নত রাখতে ছিলেন অবিচল। তিনি ছিলেন এককথায় সত্যিকার অর্থে ফানাপিস শায়েখ ও ফানাফির রসূল। দেশের খ্যাতনামা আলেমদের মধ্যে প্রয়াত তাফসিরে নূরুল কুরআনের লেখক মওলানা আমিনুল ইসলাম, অধ্যাপক আবদুল গফুর, অধ্যাপক ড. সালাহুদ্দীন আহমেদ প্রমুখ তাঁর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন।

লেখক: সাংবাদিক

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন