শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ধর্ম দর্শন

মিথ্যা ও মিথ্যুকের পরিণাম

মুফতী পিয়ার মাহমুদ | প্রকাশের সময় : ১৪ অক্টোবর, ২০২১, ১২:০৩ এএম

পূর্ব প্রকাশিতের পর

৮.শিশুদের সাথে মিথ্যাচার
অনেক সময় শিশুদের সাথে কৌতুক করে বা তাদের কান্না থামানো কিংবা মন ভুলানোর জন্য তাদেরকে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি বা প্রলোভন দেওয়া হয়ে থাকে। এ জাতীয় প্রবনতা কেবল গোনাহই নয়, পাশাপাশি আরও অনেক ক্ষতিও ডেকে আনতে পারে। কারণ এতে করে শিশুর কোমলমতি অনুভূতিতে মিথ্যার মতো অপরাধকে হালকা করে দেওয়া হলো এবং তা তার স্বভাবে অনুপ্রবেশের রাস্তা খুলে দেওয়া হলো। প্রকারান্তরে তাকে এই অপরাধটির প্রতি উৎসাহিতও করা হলো। একটি হাদীসে এ বিষয়টি পরিষ্কারভাবে উল্লেখ আছে। সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে আমের রা. বলেন, একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের বাড়িতে এলেন। তখন আমি ছিলাম ছোট্ট শিশু। খেলতে বের হচ্ছিলাম। আমার মা আমাকে ডাক দিয়ে বললেন, এদিকে এসো। তোমাকে একটি জিনিস দিব। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার মাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি তাকে কি দেওয়ার ইচ্ছা করেছ? মা বললেন, আমি তাকে একটি খেজুর দেওয়ার ইচ্ছা করেছি। এ সময় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, মনে রেখো! তুমি যদি তাকে কিছু না দিতে, তাহলে তোমার আমলনামায় একটি মিথ্যার গোনাহ লিখে দেওয়া হতো। [সুনানে আবূ দাউদ, হাদীস:৪৯৯১] অন্য একটি হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি কোনো শিশুকে বললো, এসো, তোমাকে কিছু দিব। তারপর দিলো না। এটিও একটি মিথ্যা। [মুসনাদে আহমাদ, হাদীস:৯৮৩৬; আয্যুহদ, ইবনে মুবারক রহ. হাদীস:৩৭৫] তাই শিশুদের সাথে এ জাতীয় মিথ্যাশ্রিত কথা পরিহার করে সত্যের পথ অবলম্বন করা উচিত।

৯.বন্ধু-বান্ধবের আড্ডায় মিথ্যাচার
বন্ধু-বান্ধবের আড্ডা ও হাস্যরসের আসরগুলোও যেন মিথ্যা ছাড়া জমে উঠতে চায় না। রসিয়ে রসিয়ে এবং মিথ্যার মিশেলে যে যত সুন্দর উপস্থাপনায় মিথ্যা বলে বন্ধদের হাসাতে পারে, সে তত বাহবা পায়। অথচ লোক হাসানোর জন্য মিথ্যা বলার ব্যাপারে এসেছে কঠোর হুসিয়ারী। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ধ্বংস তার জন্য, যে মানুষকে হাসানোর জন্য কথা বলার সময় মিথ্যা কথা বলে। ধ্বংস তার জন্য, ধ্বংস তার জন্য। [মুসনাদে আহমাদ, হাদীস:২০০৪৫; জামে তিরমিযী, হাদীস:২৩১৫; সুনানে আবূ দাউদ, হাদীস:৪৯৯০] হাদীসটির মর্ম খুবই কঠোর ও ভয়ংকর। তাই আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে মানুষকে হাসানোর জন্য মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া থেকে বেঁচে থাকার তাওফীক দান করুন।

১০.কৌতুকের মোড়কে মিথ্যা
আমরা অনেক সময় নিছক কৌতুক, মশকারা ও মানুষকে হাসানোর জন্য মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে থাকি। অথচ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কৌতুকচ্ছলেও মিথ্যা বলতে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ধ্বংস তার জন্য, যে মানুষকে হাসানোর জন্য কথা বলার সময় মিথ্যা কথা বলে। ধ্বংস তার জন্য, ধ্বংস তার জন্য। [মুসনাদে আহমাদ, হাদীস:২০০৪৫; জামে তিরমিযী, হাদীস:২৩১৫; সুনানে আবূ দাউদ, হাদীস:৪৯৯০] হাদীসটির বর্ণনা শৈলী হাদীসের মর্মকথাকে জুরালো করেছে যারপর নাই। তাই কৌতুকচ্ছলেও মিথ্যা বলা থেকে আমাদের বিরত থাকতে হবে। এ কথার অর্থ এই নয় যে, ইসলামে কৌতুক ও রসিকতা নিষিদ্ধ। ইসলামে কৌতুক ও রসিকতার অনুমোদন আছে। তবে সেটা হতে হবে সত্যাশ্রয়ে ও বাস্তবতার নিরিখে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও মাঝে মাঝে কৌতুক ও রসিকতাপূর্ণ কথা বলেছেন। কিন্তু কখনই এমন কৌতুক করেন নি, যাতে মিথ্যা ও অবাস্তব কথা থাকতো। যেমন একদা এক সাহাবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরাবরে এসে বাহন হতে পারে এমন একটি উটনী চাইলেন। তাঁর আবেদনের প্রেক্ষিতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কৌতুক করে বললেন, আমি তোমাকে একটি উটনীর বাচ্চা দিবো। নবীজীর এ কথা শোনে সাহাবী অবাক হয়ে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমি উটনীর বাচ্চা দিয়ে কি করবো? আমার তো প্রয়োজন বাহন। তার এ কথার প্রেক্ষিতে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমাকে যে উটনীই দেওয়া হোক না কেন তা তো কোনো না কোনো উটনীর বাচ্চাই হবে। [জামে তিরমিযী, হাদীস:১৯৯১] রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ রসিকতায় কৌতুক আছে বটে, কিন্তু তাতে নেই কোনো মিথ্যার আশ্রয়। নেই কোনো অবাস্তব কিছু। কারণ সকল উটনীই কোনো না কোনো উটনীর বাচ্চা। আজ তো আমাদের মাঝে কত বানোয়াট মিথ্যা খোশগল্প ছড়িয়ে আছে। যেগুলো আমরা হরহামেশাই বলে থাকি। এ সবই মিথ্যার অন্তর্ভুক্ত।


শেষ কথা
বক্ষমান প্রবন্ধে মিথ্যার প্রচলিত কয়েকটি রুপ ও ক্ষেত্র তুলে ধরা হলো। এছাড়াও মিথ্যার আরও বহু ক্ষেত্র ও রুপ রয়েছে। যেমন ব্যবসা-বানিজ্যে মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া, মোবাইলে এক স্থানে থেকে অন্য স্থানের কথা বলা, জাল সার্টিফিকেট, ভূয়া দলিলপত্র, সনদপত্র, মামলা-মুকাদ্দমায় অসত্য তথ্য পরিবেশন, তালাকনামায় ভিত্তিহীন ও বানোয়াট কথা লিখা ইত্যাদি সবই এর আওতাভুক্ত। মূলত মিথ্যা একটি সার্বজনিন অপরাধ। যা কেবল ব্যক্তির পরকালকেই ধ্বংস করে না। বরবাদ করে তার ইহকালকেও। ডেকে আনে ক্ষতি আর ক্ষতি। মিথ্যুক থেকে মানুষের আস্থা, ভক্তি, ভালোবাসা, শ্রদ্ধাবোধ উঠে যায়। পক্ষান্তরে সত্য একটি মহৎ গুণ। এর লাভ সুদূর প্রসারী। সত্যবাদী হয়ে উঠে মানুষের আস্থা, ভক্তি, ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার পাত্র। ইহকালের মতো তার পরকালও হয় শান্তি ও সম্মানের। তাই আসুন, সত্য গ্রহণ করি। সত্যের সাথে থাকি। সত্যের পথে চলি। মিথ্যা বর্জন করি। মিথ্যার পথ পরিহার করি। আল্লাহ আমাদের তাওফীক দান করুন।

লেখক : প্রধান মুফতী ও সিনিয়র মুহাদ্দিস জামিয়া মিফতাহুল উলূম, নেত্রকোনা।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন