মালেক মল্লিক
চারদিকে রঙিন আলোকচ্ছটা। উৎসবমুখর পুরো ক্যাম্পাস। রঙিন বৈদ্যুতিক আলোয় রাতের আবহ হয়ে উঠেছে অন্যরকম। পুরো ক্যাম্পাসে সাজসাজ রব। এ যেন অন্যরকম উৎসব। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষেই এমন আয়োজন চলছে ক্যাম্পাসজুড়ে। আগামী ২০ অক্টোবর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় দিবস। জগবাবুর পাঠশাল থেকে আজকের জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় দিবস। প্রতিষ্ঠালগ্নে মাত্র ৪৮ জন শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও আজ প্রায় ২৮ হাজার শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছে দেড়শ’ বছরের পুরনো এ বিদ্যাপীঠটিতে। বর্তমানে শিক্ষার্থীদের প্রাণের প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। এমন প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাদিবস তো পালিত হবে একটু জঁাঁকজমকভাবেই!। বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে যাত্রার পর হাঁটি হাঁঁট পা পা করে ১২ বছরে পদার্পণ করতে যাচ্ছে। ২০০৫ সালের আজকের এই দিনের উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন কলেজটিকে বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে যাত্রা শুরু করে। প্রতিষ্ঠানটি ’৫২’র ভাষা আন্দোলন, ’৬২-তে সামরিক সরকারের শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, ’৬৬’র ছয়দফা দাবি, ’৬৮’র এগারো দফা, ’৬৯’র গণঅভ্যুত্থান, ’৭১’র মুক্তিযুদ্ধসহ বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। বর্তমানে জ্ঞান বিতরণের এক মহীরুহ হিসেবে সকল সমাজে এ বিদ্যাপীঠটির ব্যাপক সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে।
ইতিহাস ঐহিত্য : জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন নাম জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, তবে এটি জগন্নাথ কলেজ নামেই বিংশ শতাব্দীর অধিকাংশ সময়জুড়ে পরিচিত ছিল। এটি ঢাকার একটি ঐতিহ্যবাহী কলেজ। ১৮৫৮ সালে ঢাকা ব্রাহ্ম স্কুল নামে এর প্রতিষ্ঠা হয়। ১৮৭২ সালে এর নাম বদলে জগন্নাথ স্কুল করা হয়। বালিয়াটির জমিদার কিশোরীলাল রায় চৌধুরী তাঁর বাবার নামে জগন্নাথ স্কুল নামকরণ করেন। ১৮৮৪ সালে এটি একটি দ্বিতীয় শ্রেণীর কলেজে ও ১৯০৮ সালে প্রথম শ্রেণীর কলেজে পরিণত হয়। এসময় এটিই ছিল ঢাকার উচ্চশিক্ষার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা শুরু হলে জগন্নাথ কলেজের স্নাতক কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হয়। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রির শিক্ষার্থী, শিক্ষক, গ্রন্থাগারের বই-পুস্তক, জার্নাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থানান্তর হয়। তৎকালীন জগন্নাথ কলেজে আই,এ, আই,এসসি, বি,এ (পাস) শ্রেণী ছাড়াও ইংরেজি, দর্শন ও সংস্কৃতি অনার্স এবং ইংরেজিতে মাস্টার্স চালু করা হলেও ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর তা বন্ধ করে দেয়া হয় এবং ইন্টারমিডিয়েট কলেজে অবনমিত করা হয় জগন্নাথকে। পুরানো ঢাকার নারী শিক্ষায় বাধা দূর করতে ১৯৪২ সালে সহশিক্ষা চালু করা হয়। ১৯৪৮ সালে তা বন্ধ করে দেয়া হয়। পরে ১৯৪৯ সালে আবার এ কলেজে স্নাতক পাঠ্যক্রম শুরু হয়। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আত্মত্যাগ করেন। ১৯৬৩ সালে অধ্যক্ষ সাইদুর রহমান পুনরায় কো-এডুকেশন চালু করেন। ১৯৬৮ সালে এটিকে সরকারিকরণ করা হয়, কিন্তু পরের বছরেই আবার এটি বেসরকারি মর্যাদা লাভ করে। ২০০৫ সালে বিএনপি-জামায়াত চারদলীয় জোট সরকারের সময়ে জাতীয় সংসদে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০০৫ পাসের মাধ্যমে এটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়। ভাষা আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ৬ দফা ও ১১ দফার আন্দোলন এবং উনসত্তরের গণঅভ্যুথান ও মুক্তিযুদ্ধ প্রতিটি আন্দোলনের ইতিহাসে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান কখনো অস্বীকার করার মতো নয়। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী মোহাম্মাদ রফিকউদ্দিন (ভাষা শহীদ রফিক) আত্মত্যাগ করেন। ৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ৬৬ টির ৬ দফা ও উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে মিছিল-মিটিং এ প্রকম্পিত ছিল এই জগন্নাথের ক্যাম্পাস। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় গ্রেফতার করা হলে এই প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থীরা হরতাল পালন করে পুরান ঢাকায় গড়ে তোলে প্রতিবাদ। মহান মুক্তিযুদ্ধে এ প্রতিষ্ঠানের বহু শিক্ষক ও ছাত্র অংগ্রহণ করেন যাদের মধ্যে অন্যতম হলেন বিখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, ঢাকার সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকা, গণসঙ্গীত শিল্পী ফকির আলমগীর ও বর্তমান মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া। এছাড়াও বিএনপি নেতা গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, কাজী ফিরোজ রশিদ, নূরে আলম সিদ্দিকী, সৈয়দ শামসুল আলম হাসু, আল মুজাহিদি, রাজিউদ্দিন আহমদ রাজু, কেএম সাইফুদ্দিন আহমদ, এমএ রেজা, মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন এমপি, সাইফুর রহমান, আখতারুজ্জামান, আমিনুল ইসলাম জিন্নাহ, ফজলে এলাহি মোহন, হুমায়ুন কবির শেলী, মুরাদ আলী, শরীফ ও আবুল হাসনাত সারু। পুরান ঢাকার শত শত মা-বোনের ইজ্জত হারানোর সাক্ষী জগন্নাথের ১৫০ বছর আগের প্রশাসনিক ভবন। যুদ্ধের পর ক্যাম্পাসে কয়েকটি গণকবরের সন্ধান পাওয়া গেলে মুক্তিযুদ্ধের স্মরণে সবচেয়ে বড় গণকবরটির উপর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও ৭১-এর গণহত্যা নামে বাংলাদেশের একমাত্র গুচ্ছ ভাস্কর্যটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। ২০১০ সালে রাজপথে নেমে এসেছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। তুমুল আন্দোলনের মুখে সরকার ৩টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকারি অনুদান বহাল রাখতে মহান জাতীয় সংসদে বিল পাস করতে বাধ্য হয়।
নানা কর্মসূচি : জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় দিবস ২০১৬ উপলক্ষে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ভবনগুলো বিভিন্ন রঙ-বেরঙের বাতি দিয়ে আলোকসজ্জা করাসহ নানা কর্মসূচি আয়োজন করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে সকাল ৯টা ১০ মিনিটে জাতীয় পতাকা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পতাকা উত্তোলনের পর বেলুন এবং পায়রা উড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের শুভ উদ্বোধন করবেন বিশ্ববিদ্যালয় ভিসি প্রফেসর ড. মীজানুর রহমান। সকাল সাড়ে ৯টায় প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে একটি র্যালি শহীদ মিনার চত্বর হতে শুরু হয়ে পুরো ক্যাম্পাস ঘুরে রায় সাহেব বাজার এবং ভিক্টোরিয়া পার্ক প্রদক্ষিণ শেষে পুনরায় বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে শেষ হবে। এতে ঘোড়ার গাড়িসহ ব্যান্ডদল অংশগ্রহণ করবে। এরপর বিজ্ঞান ভবন চত্বরে সকাল ১১টায় আলোচনা সভা এবং একই স্থানে বেলা ১২টায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।
সংগঠনসমূহ : জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি, বাঁধন, বিএনসিসি, রোভার স্কাউট, রেঞ্জার, উদীচি শিল্পীগোষ্ঠী, বিশ্ববিদ্যালয় থিয়েটার, আবৃত্তি সংসদ, জবি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, ডিবেটিং সোসাইটি, চলচিত্র সংসদ, আর্কাইব ৭১, ফটোগ্রাফিক সোসাইটি, এছাড়াও প্রতিটি বিভাগের নিজস্ব কিছু সংগঠন রয়েছে।
বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয় : মহানগর দায়রা জজকোর্টের পাশে মাত্র ১১ একর জমির ওপর দাঁড়িয়ে আছে দেড়শ’ বছরের পুরনো এ বিদ্যাপীঠটি। এছাড়াও ঢাকার কেরাণীগঞ্জ থানার দক্ষিণ কেরাণীগঞ্জের বাঘৈর গ্রামে (নবনির্মিত ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের বিপরীতে) জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় ক্যাম্পাস নির্মাণের জন্য জমি ক্রয় করা হয়েছে। অতি শিগগিরই এ ক্যাম্পাসের শুরু হবে বলে জানানো হয়েছে। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬টি অনুষদের অধীনে ৩২টি বিভাগে ২৮ হাজারের অধিক শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছে। বর্তমানে শিক্ষক সংখ্যা ৫০০-ওপরে। ২০০৫-২০০৬ শিক্ষাবর্ষ থেকে সকল বিভাগে সেমিস্টার পদ্ধতিতে পাঠদান কার্যক্রম চালু করা হয়েছে। প্রতি বছর ছয়টি অনুষদে ২ হাজার ৭৬০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হতে পারবে। বিদ্যাপীঠটির শুরুতে ১২টি আবাসিক হল থাকলেও বর্তমানে দুটি হল ছাড়া বাকি হলগুলো বেদখলে রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় পর থেকে বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রাম করলেও কোনো নতুন আবাসিক হল নির্মাণ করতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। বর্তমানে শিক্ষার্থীদের প্রাণের দাবি সমাবর্তন অনুষ্ঠান। সকলের আশা অতি দ্রুত শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে একটি সমাবর্তন আয়োজন করবে প্রশাসন। ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠটির বর্তমানে শিক্ষার্থীদের কাছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পর পছন্দের দ্বিতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়েছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন