মুহাম্মদ আলতাফ হোসেন হৃদয়
হিজরী নববর্ষ মুসলিম জাতির এক অনন্যোজ্জ্বল গৌরবগাঁথা ও ইতিহাসের দিন। নিজেদের অস্তিত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বিশ্ব মুসলিমকে নব চেতনায় উদ্দীপ্ত করতে হিজরী নববর্ষ অতীব গুরুত্বপূর্ণ। মুসলমানদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় সকল আচার অনুষ্ঠান ও ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ বিধি-বিধান বা ইবাদত এই হিজরী তারিখের উপর নির্ভরশীল। ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভের গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ যেমন- রোজা, ঈদ, হজ, ঈদে মিলাদুন্নবী (দ.), লাইলাতুল কদর, লাইলাতুল বরাত, লাইলাতুল মিরাজ, আশুরাসহ সকল ধর্মীয় উৎসব পালন করতে হয় হিজরী তারিখ তথা চাঁদের হিসেবের উপর। তাই ইসলামে এ দিনটি সমগ্র মুসলিম জাতির জন্য এক বিশেষ স্মারক। চাঁদের হিসেবে সমস্ত ইবাদত বন্দেগীর প্রচলন হযরত আদম আলাইহিসসালামের সময় থেকে প্রচলিত ছিল। কিন্তু হিজরী বর্ষ বা সন গণনার প্রবর্তন হয় ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর ফারুক (রা.) এর খেলাফতের চতুর্থ বছর (৬৩৮ খিৃষ্টাব্দ) থেকে। তখন তিনি অর্ধ পৃথিবীর শাসনকর্তা ছিলেন। হিজরি সন এমন একটি সন, যার সঙ্গে মুসলিম উম্মাহর তাহজিব-তামাদ্দুনিক ঐতিহ্যের ভিত্তি সম্পৃক্ত। এটি এমন একটি স্মারক, যার সঙ্গে জড়িত আছে বিশ্বমানবতার মুক্তির দূত সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রিয় ও পুণ্যময় জন্মভূমি মক্কানগরী ত্যাগ করে বিরহ বেদনা নিয়ে মদিনা শরিফ গমনের ঐতিহাসিক ঘটনা।
৬১০ খ্রিস্টাব্দে মহানবী (সা.) মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে নবুওয়াতপ্রাপ্তির পর আল্লাহ অস্বীকারকারীদের এক আল্লাহর দিকে আহ্বান করেছিলেন, তখন তার সবচেয়ে প্রিয় মানুষেরা তার বিরোধিতা শুরু করে দিয়েছিল। গোপনে গোপনে তিনি তিন বছর দাওয়াত দিয়েছিলেন। এরপর আল্লাহর নির্দেশে সাফা পাহাড়ে প্রকাশ্যে এক আল্লাহর ওপর ঈমান আনয়নের ঘোষণা করেছিলেন, তখন থেকেই শুরু হয়েছিল নির্যাতনের ধারা। পথে প্রান্তরে তাকে আহত, অপমানিত, লাঞ্ছিত করা হতো। অত্যন্ত ধৈর্য ও পরম সাহসিকতার সঙ্গে মহানবী (সা.) তাঁর মিশন সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকেন। মক্কার কাফেররা একদিন সর্ব শেষ নীতি নির্ধারণের উদ্দেশ্যে তাদের ‘নদওয়া’ মন্ত্রণা গৃহে সব গোত্রপতির একটি বৈঠক আহ্বান করল। সেখানে তারা সিদ্ধান্ত নিল, আমরা নানা কৌশল করে মুহাম্মদ (সা.)-কে ঠেকাতে চেয়েছি। কিন্তু কিছুই হলো না, বরং তার চেয়ে আমরা মুহাম্মদকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিই। সবাই এই সিদ্ধান্তের ওপর তাদের সমর্থন ব্যক্ত করল এবং এই মহাঘৃণ্যতম কাজ আঞ্জাম দেয়ার জন্য সব গোত্র থেকে শক্তিশালী যুবকদের বাছাই করা হলো। ঘোষণা করা হলো, যে মুহাম্মদ (সা.)-কে জীবিত অথবা মৃত এই ‘নদওয়া’ গৃহে হাজির করতে পারবে, তাকে ১০০ উট পুরস্কার দেয়া হবে। মক্কার সব গোত্র থেকে শক্তিশালী যুবকরা একত্রিত হয়ে শপথ নিল আজ রাতেই মুহাম্মদ (সা.)-এর বাড়ি ঘেরাও করে তার জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটানো হবে।
হিজরী সন আমাদের মনে করিয়ে দেয় কিভাবে অবিশ্বাসীরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে পৃথিবী হতে সরিয়ে দিতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল। কিন্তু তিনি আজো জাগরূক হয়ে আছেন মুসলিম বিশ্বে। মহররম মাস শুধুমাত্র কারবালার ঘটনা স্মরণ করার মাসই নয় এমাস গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার, ত্যাগের, ভালো কাজ করার, খারাপ কাজ হতে বেঁচে থাকার এবং মুসলিম বিশ্বকে নতুন করে গড়ার প্রতিজ্ঞা করার মাস। হিজরী নববর্ষ আমাদেরকে ইসলামের ত্যাগের আদর্শের দিকেই আহ্বান করে। যেভাবে এল হিজরি সন : হিজরি সনের শুরু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মক্কা থেকে মদিনা হিজরতের সময় থেকে। হিজরি সন কবে চালু হয় তা নিয়ে অবশ্য মতভিন্নতা আছে। একটি মত হলো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কা থেকে মদিনা মুনাওয়ারায় আগমন করেন রবিউল আউয়াল মাসে। ওই সময় থেকে তারিখ গণনা শুরু হয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামই তারিখ গণনার নির্দেশ দেন। ইমাম জুহরির এমন একটি বর্ণনা মুহাদ্দিস হাকিম তার ইকলিল নামের কিতাবে উল্লেখ করেছেন।
এ সম্পর্কে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ভাষ্য হলো দ্বিতীয় খলিফা হজরত উমর (রা.)-এর খেলাফত আমলে হিজরি সনের তারিখ গণনা শুরু হয়। একদা হজরত আবু মুসা আশআরি (রা.) খলিফা হজরত উমর (রা.)-কে পত্র লিখে বলেন, আপনার নির্দেশগুলো আমাদের কাছে এসে পৌঁছলেও এতে তারিখ উল্লেখ নেই। হজরত উমর (রা.) ১৭ হিজরিতে তারিখ নির্ধারণের বিষয়ে পরামর্শ করার জন্য বিশিষ্ট সাহাবায়ে কিরামদের সহযোগিতা চান। এ সম্পর্কে আয়োজিত সভায় সাহাবায়ে কিরামদের কেউ নবুওয়াতের সূচনা থেকে তারিখ গণনার প্রস্তাব দেন। কেউ প্রস্তাব দেন হিজরত থেকে আবার কেউ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওফাতের দিন থেকে তারিখ গণনার। সাহাবায়ে কিরামদের এসব প্রস্তাব শোনার পর হজরত উমর (রা.) হিজরতের দিন থেকে ইসলামী তারিখ গণনার পক্ষে বলেন। তিনি যুক্তি দেখান হিজরতের মাধ্যমে সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য সূচিত হয়। সাহাবা কিরামরা এ প্রস্তাবকে সাদরে গ্রহণ করেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন