করোনা মহামারীর আগে দেশে বিনিয়োগ পরিস্থিতি তেমন ভালো ছিল না। গত অর্থবছরে বিনিয়োগের হার দাঁড়িয়েছে জিডিপির ২১ দশমিক ২৫ শতাংশ। ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের হার গত পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। তবে আশার কথা হলো, করোনা মহামারীর মধ্যেও যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক ঋণমান সংস্থা স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড পুওরস (এসঅ্যান্ডপি) বাংলাদেশের ঋণমান দীর্ঘমেয়াদি ‘বিবি-’ও স্বল্পমেয়াদে ‘বি’ বহাল রেখেছে। সংস্থাটির কাছ থেকে ২০১০ সাল থেকে দেশ একই রেটিং পেয়ে আসছে। একযুগ ধরেই বাংলাদেশে রেকর্ডসংখ্যক আর্থসামাজিক উন্নয়ন হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর দৃঢ় নেতৃত্ব ও দূরদর্শিতায় দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। এ জন্য তিনি আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বারবার প্রশংসিত হয়েছেন। স্বল্পোন্নত একটি দেশকে কীভাবে সঠিক নেতৃত্বে স্বল্পসময়ে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উপনীত করা যায়, তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। অতিসম্প্রতি জাতিসংঘের সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট সলিউশনস নেটওয়ার্ক (এসডিএসএন) শেখ হাসিনাকে ‘এসডিজি অগ্রগতি পুরস্কার’-এ ভূষিত করেছে। এর আগেও বাংলাদেশ বিভিন্ন সামাজিক অগ্রগতিতে জাতিসংঘের সহস্রাব্দ লক্ষ্যমাত্রা পূরণের জন্য পুরষ্কৃত হয়েছে। জাতিসংঘের মহাসচিব থেকে শুরু করে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় নেতা ও বিভিন্ন সংস্থার প্রধান আজ শেখ হাসিনার ভূয়সী প্রশংসা করেন। কিন্তু আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দুর্নীতির শাখা-প্রশাখার ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে। তদুপরি এই করোনাকালীন অর্থনীতিতে দেখা যাচ্ছে বেশকিছু চ্যালেঞ্জ। বিশেষ করে প্রবৃদ্ধির ধারা বজায় রেখে অর্থনীতি গতিশীল তথা কর্মসংস্থান বাড়াতে হলে বিনিয়োগের বিকল্প নেই। কোন দেশ বিনিয়োগের জন্য কতটুকু উপযুক্ত, এ বিষয়ে ধারণা দিতে ২০০৪ সাল থেকে ১৯০টি দেশ নিয়ে বিশ্বব্যাংক প্রতিবছর ‘ডুয়িং বিজনেস’ সূচকের ভিত্তিতে প্রতিবেদন তৈরি করে আসছিল। মোট ১০টি নির্দেশকের ওপর ভিত্তি করে তালিকা তৈরি করা হতো। সর্বশেষ ২০১৯ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৯০টি দেশের মধ্যে ১৬৮তম অবস্থানে বাংলাদেশ। এই অবস্থান থেকে বিদেশি বিনিয়োগ খুব বেশি আশা করা কতটা যৌক্তিক। উপরন্তু বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগে গত ১৬ সেপ্টেম্বর এ প্রতিবেদন আর প্রকাশ করবে না বলে ঘোষণা দেয় বিশ্বব্যাংক। তবে দেশের উন্নয়নের স্বার্থে বিনিয়োগের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করতে যেসব নির্দেশককে বিবেচনা করা হয়, নিজেদের উদ্যোগে সেগুলো উন্নতি করতে হবে। ইতোমধ্যে দেশে প্রথমবারের মতো ‘বিজনেস ক্লাইমেট ইনডেক্স’ নামে একটি জরিপ পরিচালনা করেছে। সেখানে বাংলাদেশ ১০০ পয়েন্টের মধ্যে গড়ে ৬১ পেয়ে ব্যবসার পরিবেশ উন্নতির দিকে যাচ্ছে-এমন বলা হয়েছে। এখন দেখার বিষয় হলো, এই জরিপ বৈশ্বিকভাবে কতটুকু গ্রহণযোগ্য হয়। অন্যথায় বিদেশি বিনিয়োগ মুখ থুবড়ে পড়বে। বিদেশি বিনিয়োগ তো দূরের কথা, দেশি ক্ষুদ্র বিনিয়োগেও হয়রানির শেষ নেই। এমনকি সাধারণ জনগণের কষ্টার্জিত টাকায় নিজেদের মৌলিক অধিকারের জায়গা-একটি স্বপ্নের বাড়ি নির্মাণে, ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্মে বাড়ির প্ল্যান করা থেকে শুরু করে পৌরসভা বা সিটিকর্পোরেশনে প্ল্যান পাস করা পর্যন্ত দ্বারে দ্বারে ঘুরে ওই স্বপ্ন অনেকটাই ফিকে হয়ে যায়। ইঞ্জিনিয়ার আবার ডাক্তারের চেম্বারে টেষ্টবাণিজ্যে আতঙ্কিত। তারাই আবার আইনি মারপ্যাঁচে উকিলের কাছে অসহায়, নিরুপায়। এসব ঘুষ-বাণিজ্যের কুশীলবের ভয়ডর, রাখডাক, লজ্জা-শরমের বালাই নেই। যে যার জায়গায় দুর্নীতিতে অটল। বঙ্গবন্ধু এদের বলেছিলেন ‘চাটার দল’। এভাবে দেশের মন্ত্রী, এমপি, আমলা থেকে শুরু করে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ এমনকি ‘অচেনা জায়গা’য় রিকশাচালকও কিন্তু ভাড়া কম নেন না। এ যেন দুর্নীতির এক দুষ্টচক্র। কোথাও নেই সুনীতি। ঘুষ-বাণিজ্য ও দুর্নীতি-এটিই এখন মূলনীতি, বলা হয় সামাজিক রীতি। প্রধানমন্ত্রীর ভাষায় সামাজিক ব্যাধি। জায়গাভেদে বলা চলে ‘মৌলিক অধিকারে’ পরিণত হয়েছে। আবার বহু কাঙ্খিতও বটে। চাকরির পদ বা আত্মসম্মানের চেয়ে ঘুষ-বাণিজ্যের সুযোগ বেশি গুরত্ব পায়। দুর্নীতিবাজ চাকরিজীবী আজ পরিবার ও সমাজের গর্ব। পুরো জাতি দুর্নীতিতে আচ্ছন্ন। এই দূরাচার দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে মানুষের অহরহ প্রায়োগিকতা ও অভ্যাসের মাধ্যমে। ঘুষ দেওয়া-নেওয়ায় এখন আর কারও মনে অপরাধবোধ কাজ করে না। সচ্ছল মানুষেরা ঘুষ দিয়ে কাজ উসুল করাতে এক রকম আনন্দ পায়। নিজেদের সফল মনে করে। বিপদে পড়ে সাধারণ গরিব খেটে খাওয়া জনগণ। এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনা মনে পড়ছে, ছয় বছরের একটি ছেলে নাম মাহির। তার তিন বছরের চাচাতো বোন মেহেরকে খেলার ছলে হঠাৎ একটি থাপ্পড় দেয়। মেহের বলে, ‘এই মাহির থাপ্পড় দেবে না, তা হলে কিন্তু খবর আছে।’ মাহির আবার একটি থাপ্পড় দেয়। মেহের এবার হুঙ্কার দিয়ে বলে, ‘মাহির, তুমি আমাকে আবার একটি থাপ্পড় দিলে। আমি তোমাকে দশটা থাপ্পড় দেবো।’ সঙ্গে সঙ্গে মাহির মেহেরকে আরেকটি থাপ্পড় দেয়। মেহের এবার অসহায় ও নিরুপায় হয়ে বলে, ‘মাহির ভাইয়া, এর পর যদি আমাকে আবার থাপ্পড় দাও, তাহলে আস্তে দিবা, হ্যাঁ।’ আমাদের দেশের জনগণ ও বেচারি শিশুকন্যা মেহেরের একই হাল। থাপ্পড় অবধারিত জেনে সয়ে নেওয়াই শ্রেয় মনে করে। জনগণ দুর্নীতির যাঁতাকলে অতিষ্ঠ। প্রতিবাদের শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। আগেরকার সময়ে মানুষ ছিনতাইকারী বা ডাকাতের কবলে পড়লে শুধু পকেটে যা থাকত, তা দিয়েই রেহাই পেত। আর এখন ঘুষ দিয়ে পকেট খালি হয়ে গেলেও রেহাই নেই। বিকাশ, নগদের মতো অপশন তো রয়েছেই। দুর্নীতির ধারণা সূচকে ২০২০ সালে ১৮০টি দেশের মধ্যে তালিকার নিচের দিক থেকে ১২তম অবস্থানে আছে বাংলাদেশ। কারণ হিসেবে ক্ষমতার অপব্যবহার, বিচারহীনতা, মতপ্রকাশ ও জবাবদিহিতার অভাবকে উল্লেখ করা হয়েছে। পাশাপাশি স্বাস্থ্য খাতে ব্যাপক দুর্নীতির বিষয়টি অন্যতম কারণ হিসেবে জোরালোভাবে দেখানো হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ঘুষবিরোধী ব্যবসায়িক সংগঠন ট্রেস ২০২০ সালের ঘুষ লেনদেনের ঝুঁকি নিয়ে একটি তালিকা প্রকাশ করে। সেখানে বিশ্বের ১৯৪টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬৬ নম্বরে। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ঝুঁকির শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ। এ ক্ষেত্রে সুযোগ, প্রতিবন্ধকতা, স্বচ্ছতা ও তদারকি বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। দুর্নীতি, মানবিক মূল্যবোধ সব খেয়ে শেষ করে দিচ্ছে। ন্যায়নীতি ও সুবিচারের সলতে আজ নিভু নিভু। ঘুষ-দুর্নীতি-দুরাচারের যে ভয়াবহ প্রসারতা তা চলতে থাকলে ভবিষ্যতে অর্থনৈতিক বৈষম্য বেড়ে সামাজিক অস্থিরতা প্রকট হবে। করোনা ভাইরাস হয়তো একসময় নির্মূল হবে। দুর্নীতি নামক ভাইরাসে আক্রান্ত জাতির মুক্তির জন্য আমাদের নিজস্ব দায়িত্ববোধ থেকে ঘুরে দাঁড়াতে হবে। এর জন্য দরকার জাতিগত শুদ্ধাচার। প্রতিটি মানুষের নিজের জায়গা থেকে শুদ্ধাচার চর্চার মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নিতে হবে। এটি সরকারের একার কাজ নয়, সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
লেখক: পুঁজিবাজার বিশ্লেষক
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন