পূর্ব প্রকাশিতের পর
তারা মুসলমানদের চির প্রতিপক্ষ ও চরম শত্রু। তারা সর্বদা মুসলিমবিদ্বেষী ও প্রকাশ্য ইসলামবিরোধী। ইমামুল আম্বিয়া সায়্যিদুল মুরসালীন হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আবির্ভাবকাল থেকে নুবুওয়াত প্রকাশের পূর্বে তাঁর সততা, ন্যায়নিষ্ঠা, নৈতিক ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে মুগ্ধ হয়ে অনেক কাফির-মুশরিক তাঁর আনুগত্য প্রকাশ করেন। তাঁর আহবানে সামাজিক সংস্থা ‘হিল্ফুল ফুযূল’-এ তারা যুক্ত হয়ে আদর্শ সমাজ গড়ে তোলতে ভূমিকা রাখেন।
আল্লাহ্ রাব্বুল ‘আলামীন পৃথিবীতে তাঁর একমাত্র দীন ‘ইসলাম’কে পরিপূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠার জন্য তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ নবী ও রাসূল হযরত মুহাম্মদ (দ.)-কে আনুষ্ঠানিকভাবে নুবুওয়াত দান করার পূর্বে তার চরিত্রমাধুর্য্য, সততা ও ন্যায়পরায়ণতার মাধ্যমে কাফির-মুশরিকদেরকে তাঁর অনুগত করান। পরিবেশ তৈরীর এক পর্যায়ে চল্লিশ বছর বয়সে কুরআন মাজীদের প্রথম আয়াত ‘পড়ুন আপনার প্রভূর নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন’ অবতীর্ণের মাধ্যমে। এরপর থেকে মানুষ ও সমাজের অবস্থা-পরিস্থিতি ও প্রেক্ষাপট অনুযায়ী মানুষের স্বভাবজাত কল্যাণকর ধর্ম ‘ইসলাম’-এর বিধিবিধান এবং মুসলমানদের পথনির্দেশনা রূপে কুরআন মাজীদের আয়াত ও সূরাহ্ নাযিল হতে থাকে।
তখন তাঁর আহবানে সমাজবাসী পৌত্তলিক ধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম গ্রহণ করতে থাকে। তবে কাফির-মুশরিকদের অনেকে তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করা শুরু করে। তিনি অত্যন্ত ধৈর্য্য ও দূরদর্শিতার সাথে আল্লাহ্র একত্ববাদ, ইসলামী শিক্ষা, দর্শন ও আল্লাহ্র সৃষ্টিরহস্য সম্পর্কে সমাজবাসীকে অবহিত করতে থাকেন। মানুষকে ইসলামের দা‘ওয়াত দেয়া শুরু করেন। তবে তিনি কাউকে জোর করে ইসলামে দীক্ষিত করেন নি।
পৃথিবী পরিচালনায় আল্লাহ্ তা‘আলার একটি নিয়ম-নীতি রয়েছে। যার কোন পরিবর্তন হয় না। ইরশাদ হয়েছে, ‘বলুন, নিশ্চয় আল্লাহ্ আসমানসমূহ ও যমীনের অদৃশ্য বিষয়ে জ্ঞাত। অন্তরসমূহে যা রয়েছে সে বিষয়েও তিনি সবিশেষ অবগত। তিনি তোমাদেরকে পৃথিবীতে প্রতিনিধি করেছেন। সুতরাং কেউ কুফরী করলে তার কুফরীর জন্য সে নিজেই দায়ী। কাফিরদের কুফরী শুধু তাদের রবের ক্রোধই বৃদ্ধি করে এবং কাফিরদের কুফরী তাদের ক্ষতিই বৃদ্ধি করে। বলুন তোমরা আল্লাহ্র পরিবর্তে যাদেরকে ডাক, (সেসব দেবদেবীর কথা ভেবে দেখেছ কি?) তারা পৃথিবীতে কিছু সৃষ্টি করে থাক্লে আমাকে দেখাও। অথবা আকাশসমূহ সৃষ্টিতে তাদের কোন অংশ আছে কি? নাকি আমি তাদেরকে এমন কোন কিতাব দিয়েছি যার প্রমাণের উপর এরা নির্ভর করে? বস্তুতঃ যালিমরা একে অপরকে মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকে। নিশ্চয় আল্লাহ্ আকাশসমূহ এবং পৃথিবীকে সংরক্ষণ করেন, যাতে এগুলো স্থানচ্যুত না হয়। আর যদি এগুলো স্থানচ্যুত হয়, তাহলে তিনি ব্যতীত আর কে আছে, এগুলোকে ধরে রাখবে? নিশ্চয় তিনি পরম সহনশীল, অতিশয় ক্ষমাপরায়ণ। আর তারা দৃঢতার সাথে আল্লাহ্র শপথ করে বলত, তাদের নিকট কোন সর্তককারী এলে তারা অন্যসব সম্প্রদায় অপেক্ষা সৎপথের অধিকতর অনুসারী হবে। কিন্তু তাদের নিকট যখন সতর্ককারী এলেন তখন তারা শুধু তাদের বিমুখতাই বৃদ্ধি করল। পৃথিবীতে ঔদ্ধত্য প্রকাশ এবং কূটচক্রান্তের কারণে। কিন্তু ষড়যন্ত্র কেবল তার উদ্যোক্তাদেরকেই পরিবেষ্টন করে। তবে কি তারা পূর্ববর্তীদের প্রতি (আল্লাহ্র পক্ষ হতে) যে বিধান প্রয়োগ করা হয়েছে তারই অপেক্ষা করছে? কিন্তু আপনি আল্লাহ্র বিধানে কখনো পরিবর্তন পাবেন না। আর আল্লাহ্র বিধানের কখনো কোন ব্যতিক্রমও পাবেন না’। সূরাহ্ আল্ ‘আলাক্ব, আয়াত ১
ইসলামের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হল, আল্লাহ্র ‘ইবাদত-বন্দেগীর পাশাপাশি তার যমীনে দীন প্রতিষ্ঠা করা। এর বিধিবিধান অনুযায়ী জীবন অতিবাহিত করা। মরণের পর তার মহাপুরস্কার লাভ করা। তাই নবী-রাসূল (আ.)-এর প্রতিষ্ঠিত ইসলামকে স্ব স্ব সময়কালে অব্যাহত রাখতে সকল মুসলমানকে স্ব স্ব অবস্থান থেকে ভূমিকা রাখতে হয়। তাই যুগে যুগে আল্লাহ্ভীরু মানুষ তাদের মেধা, মনন, অর্থ ও সময় ব্যয় করে স্বার্থবাদী মানবরচিত মতবাদের মোকাবেলায় ইসলামী আদর্শ প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখেন। কুরআন মাজীদের ভাষায় একে ‘ইক্বামাতুদ্দীন’ বা ‘ইযহারুদ্দীন’ বলা হয়। ইরশাদ হয়েছে, ‘তিনি তোমাদের জন্য দীনের ক্ষেত্রে সে পথই নির্ধারিত করেছেন, যার আদেশ দিয়েছিলেন নূহ্কে, যা আমি প্রত্যাদেশ করেছি আপনার প্রতি এবং যার আদেশ দিয়েছিলাম ইবরাহীম, মূসা ও ঈসাকে এ মর্মে যে, তোমরা দীন প্রতিষ্ঠা কর এবং তাতে অনৈক্য সৃষ্টি কর না। আপনি মুশরিকদের যে বিষয়ে প্রতি দা‘ওয়াত দেন, তা তাদের কাছে দুঃসাধ্য মনে হয়। আল্লাহ্ যাকে ইচ্ছে মনোনীত করেন এবং যে তার অভিমুখী হয় তাকে পথ প্রদর্শন করেন’। সূরাহ্ আশ্ শুরা, আয়াত ১৩
আয়াতে পাকে ‘আক্বীমুদ্দীন’ দ্বারা প্রত্যেক মুসলমানকে স্ব স্ব অবস্থান থেকে দীন প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখার স্পষ্ট নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। ‘লা তাতাফাররাকূ ফীহি’ দ্বারা ইসলাম প্রতিষ্ঠার ভূমিকায় মতপার্থক্য সৃষ্টি করতে নিষেধ করা হয়েছে। তাই ইসলাম প্রতিষ্ঠার প্রয়াসে সফলতার জন্য মতানৈক্য না করা অনিবার্য শর্ত। যারা সত্যিকারের মুসলমান, ইসলাম প্রতিষ্ঠার দা‘ওয়াত তাদের নিকট গ্রহণযোগ্য হওয়ার কথা। পক্ষান্তরে ইসলামের দা‘ওয়াত মুশরিকদের নিকট কেবল অপছন্দনীয় নয়, বরং তাদের নিকট তা দুর্বিষহ এবং কষ্টকরও। এ থেকেই প্রতীয়মান হয়, মুসলমান হয়েও যারা সর্বক্ষেত্রে ইসলাম প্রতিষ্ঠার আহবানকে দুর্বিষহ, দুঃসাধ্য, অসহ্য, অবাস্তব ও অসঙ্গত মনে করে, তাদের ও কাফির-মুশরিকদের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। তারা নিজেদের ঈমানদার মনে করলেও কুরআনের ভাষায় তাদের তা মনে করার সুযোগ নেই। হযরত রাসূলুল্লাহ্ (দ.)-কে প্রেরণের অন্যতম উদ্দেশ্য হল আল্লাহ্র যমীনে তার দীন ক্বায়িম করা।
ইরশাদ হয়েছে, ‘তিনিই তার রাসূলকে হিদায়াত ও সত্য দীনসহ প্রেরণ করেছেন। যাতে তিনি সকল দীনের উপর তা বিজয়ী করে দেন। যদিও মুশরিকরা তা অপছন্দ করে’। সূরাহ্ আত্ তাওবাহ্, আয়াত ৩৩, সূরাহ্ আস্ সাফ, আয়াত ৯
ইরশাদ হয়েছে, ‘তিনি তার রাসূলকে পথনির্দেশ ও সত্য দীনসহ প্রেরণ করেছেন, অপর সকল দীনের উপর একে বিজয়ী করার জন্য। আর স্বাক্ষীর জন্য আল্লাহ্ই যথেষ্ট’। সূরাহ্ আল্ ফাত্হ্, আয়াত ২৮
আয়াত তিনটিতে ‘ইযহারুদ্দীন’ বা দীনের বিজয়ের জন্যই আল্লাহ্ তার রাসূল (দ.)-কে প্রেরণের উদ্দেশ্য স্পষ্ট করেছেন। এ থেকে প্রতীয়মান হয়, আল্লাহ্র বান্দাহ্ ও রাসূলুল্লাহ্ (দ.)-এর উম্মতদেরকে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের সবক্ষেত্রে ইসলাম প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখতেই হবে।
রাসূলুল্লাহ্ (দ.)-এর তেইশ বছর নুবুওয়াতের জীবনে যে আত্মগঠন, ব্যক্তিগঠন ও সমাজ পরিবর্তনের মাধ্যমে ইসলামী কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন, তা ছিল ইসলাম প্রতিষ্ঠারই কর্মসূচি। সমম্বিত ও পরিপূর্ণ কর্মসূচির সবগুলোই ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
সুতরাং ইসলাম প্রতিষ্ঠায় সকল মুসলমানকে এ দায়িত্ব পরিপূর্ণভাবে পালন করতে হবে। (চলবে)
লেখক : ইসলামী সাহিত্যিক ও মানবাধিকার গবেষক
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন