শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

বাড়ছে আত্মহত্যার প্রবণতা

আট মাসে দুই শতাধিক শিক্ষার্থীর অপমৃত্যু ধর্মীয় শিক্ষাতেই আত্মহত্যা প্রবণতা কমানো সম্ভব

সাখাওয়াত হোসেন : | প্রকাশের সময় : ৩০ নভেম্বর, ২০২১, ১২:০৪ এএম

দুই মেয়েকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল ক্যান্সার আক্রান্ত রুনিয়া বেগমের। বেশ কয়েক বছর আগে স্বামী মারা যাওয়ার পর থেকে মেয়েদের মাঝেই বেঁেচ থাকতে চেয়েছিলেন তিনি। মেয়েরা বাবার অভাব যেন বুঝতে না পারে সে জন্যও চেষ্টার কোন ত্রুটি ছিল না রুনিয়া বেগমের। কিন্তু তার মেয়ে রাজধানীর একটি স্কুলের দশম শ্রেনীর ছাত্রী অহনা রহমান (১৬) সামান্য বকাঝকাতেই অভিমানে আত্মহত্যা করেছে। গত শুক্রবার রাতে বনশ্রীর বাসায় গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে সে। পরিচিত চার যুবক মোবাইল ফোন কেড়ে নেয়ায় বাড়ি ফিরে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করেছে রাজশাহীর পুঠিয়ার বানেশ্বর কলেজের সমাজকর্ম বিভাগে দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র মারুফ। গত ২৫ নভেম্বর রাতে চার যুবক মারুফের মোবাইল ফোন কেড়ে নেয়ার ঘটনায় গত শুক্রবার সকালে মোবাইল ফেরত চাইতে গেলে তাকে মারধরও করা হয়। এর থেকে অভিমানে আত্মহত্যা করে সে।

এভাবেই শিক্ষার্থীদের মধ্যে বাড়ছে আত্মহত্যার প্রবণতা। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে স্কুল-কলেজ এমনকি মেডিক্যালের শিক্ষার্থীরাও আত্মহত্যা করছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মানসিকভাবে ভেঙেপড়া, ধর্মীয় শিক্ষার অভাব, মাদকাসক্ত, আর্থিক সঙ্কট, হতাশা, পারিবারিক জটিলতা, সম্পর্কের অবনতি, চাকরি নিয়ে হতাশাসহ নানা প্রভাব থেকেই শিক্ষার্থীরা আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে। গত বছরের মার্চ মাস থেকে চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত আট মাসে অন্তত দুই শতাধিক শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আত্মহত্যা হচ্ছে একজন মানুষের জন্য চরমপন্থা। কেউ যখন তার সামনে কোনো আশা বা বেঁচে থাকার সার্থকতা দেখতে না পান, তখন এ পথ অবলম্বন করেন। যদিও আত্মহত্যা কোনো সমাধান নয়। একজন তরুণ শত বাধা অতিক্রম করে এসে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এখানে এসে যখন দেখেন বেকারত্ব, হতাশা এবং বৈষম্য তাকে ঘিরে ধরেছে, তখন তার বেঁচে থাকার ইচ্ছে থাকে না। আত্মহত্যার আগে কিন্তু তিনি অনেক ভেবে থাকেন। কিন্তু সমাধান পান না। এ চিত্র সমাজের সর্বত্রই। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা সমাজের ভয়ঙ্কর ব্যাধির প্রকাশ। এজন্য কাউন্সিলিংয়ের পাশাপাশি ধর্মীয় শিক্ষা শিশু, কিশোর ও যুবকদের মধ্যে সুন্দর জীবনের পথ দেখাতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ইমাম হোসাইন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। বরিশালের উজিরপুরে ইমাম গত বছরের ১৭ আগস্ট নিজ বাড়িতে আত্মহত্যা করেন। প্রেম-সংক্রান্ত জটিলতায় তিনি আত্মহত্যা করেন। আত্মহননের আগে তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন। গত ২৭ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী মাসুদ আল মাহদী অপু আত্মহত্যা করেন। রাজধানীর চানখাঁরপুলের একটি মেস থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়। তীব্র বিষন্নতা ও মানসিক চাপ থেকে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী শুভজ্যোতি মণ্ডল। গত বছরের ১৪ অক্টোবর বিকালে আদাবর মোহাম্মদিয়া হাউজিং সোসাইটির ৪ নম্বর রোডের বাড়ি থেকে তার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। তিনি চারুকলা অনুষদের গ্রাফিক ডিজাইন বিভাগের শিক্ষার্থী। শুভজ্যোতির পরিবার বলেছে, বিষন্নতার জন্য তিনি চিকিৎসা নিয়েছিলেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, কর্মমুখী শিক্ষায় জোর দিতে হবে। যে শিক্ষা বেকার তৈরি করে, তা মুক্তি দিতে পারে না। কিন্তু আত্মহত্যা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। নিরাশা-দুঃখবোধ থাকতেই পারে। তাই বলে আত্মহত্যা মেনে নেয়ার নয়। বর্তমানে প্রযুক্তি ব্যবহারের কারনেও আত্মহত্যা বাড়ছে শিক্ষার্থীদের মধ্যে। এ জন্য মা-বাবাকে খোঁজ রাখতে হবে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার সন্তান কিভাবে করছে।

শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার ঘটনাগুলো অবশ্যই আলাদাভাবে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনায় নেয়ার কথা উল্লেখ করে আরেফিন সিদ্দিক আরো বলেন, খুঁজে বের করতে হবে কেন এ পথে হাঁটছেন শিক্ষার্থীরা? আমি বারবার বলি, শ্রেণিকক্ষে পূর্ণাঙ্গ শিক্ষা দেয়া যায় না। মানবিক, কর্মমুখী ও নৈতিক শিক্ষার জন্য আরও অনেক কিছুর দরকার পড়ে। এদিকে আমাদের অবশ্যই নজর দিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জায়গায় এসে শিক্ষার্থীরা আত্মহত্যা করছে কেন, এটি জরুরি ভিত্তিতে অনুসন্ধান করতে হবে। নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের কোনো গাফিলতি আছে কি না, পরিবার থেকে কোনো সমস্যা আছে কি না? কেন তারা হতাশায় ডুবছেন? এসবের উত্তর জানা জরুরি। সব আত্মহত্যার কারণ সাধারণীকরণ করলে আবার সঠিক উত্তর আসবে না। যেভাবেই হোক আত্মহত্যার এ পথ বন্ধ করতেই হবে।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) হাফিজ আক্তার দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনেকেই এত বেশি সাইভার ওয়ার্ল্ডে সম্পৃক্ত থাকে যে তাদের মধ্যে অস্থিরতা তৈরি হয়। এর ফলে তাদের মধ্যে বাস্তবতা কাজ করে কম। এছাড়া পারিবারিক বন্ধন কমে যাওয়া এবং ধর্মীয় শিক্ষার অভাবের প্রভাবও পড়ছে শিক্ষার্থীদের মধ্যে। ফলে তাদের মধ্যে আবেগ বেড়ে যায় এবং বিষন্নতা দেখা দেয়। এক পর্যায়ে সামান্য বিষয়েও শিক্ষার্থীরা নিজেদের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে এবং আত্মহত্যার পথ বেচে নেয়।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও পরিবার থেকে কাউন্সিলিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। শিশুকাল থেকেই ধর্মীয় শিক্ষা চালুর মাধ্যমেও আত্মহত্যা প্রবণতা কমানো সম্ভব বলে তিনি মন্তব্য করেন।
মানসিক স্বাস্থ্য বিভাগের চিকিৎসক ডা. মো. রাজিবুর রহমান বলেন, পরিবারের সদস্যদের শিক্ষার্থীদের প্রতি অনেক বেশি দায়িত্বশীল এবং যত্নবান হতে হবে। অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেও মানসিক বিষণ্ন রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। এ ছাড়া প্রত্যেকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রশিক্ষিত করে গড়ে তুলতে হবে। শিক্ষার্থীদের মাসে এক থেকে দু’বার কাউন্সিলিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। পরিবারের সদস্যদের তাদের সন্তান কোথায় যাচ্ছে, কি করছে- সব বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে।

জানা গেছে, গত ২৪ নভেম্বর রাজধানীর দক্ষিণখানের চালাবন এলাকার বাসায় মায়ের সঙ্গে অভিমান করে আত্মহত্যা করেন মাইলস্টোন স্কুলের এসএসসি পরীক্ষার্থী রুবায়েত অন্তনু (১৬)। তার চাচা জকিরুল ইসলাম জানান, অন্তনু তার মায়ের কাছে আবদার করেছিল, পরীক্ষা শেষে কক্সবাজার বেড়াতে যাবে। কিন্তু মা এবার না গিয়ে পরে যাওয়ার কথা বলেছিলেন। এ নিয়ে মায়ের সঙ্গে অভিমান করে ঘরের দরজা লাগিয়ে সে আত্মহত্যা করে। তিনি আরও জানান, তাদের গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা উপজেলার বাইতলা গ্রামে। এক ভাই ও এক বোনের মধ্যে সে ছিল সবার ছোট। তার বাবা হংকং প্রবাসী।

গত রোববার রাজধানীর মগবাজারের বাসায় সিলিং ফ্যানের সঙ্গে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে সরকারি বিজ্ঞান স্কুলের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী সোহার্দ্য রহমান মুহূর্ত (১৬) আত্মহত্যা করে। তার বাবা জিল্লুর রহমান বলেন, রোববার সকালে ছেলেকে বাসায় একা রেখে মেয়ের স্কুলে যায় তার মা মুন্নি বেগম। পরে স্কুল থেকে এসে ঘরের দরজা বন্ধ দেখে। অনেক ডাকাডাকির পর দরজা না খুললে আশেপাশের লোকজন এসে দরজা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে। এসময় দেখা যায়, সিলিং ফ্যানের সঙ্গে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে ঝুলন্ত রয়েছে সোহার্দ্য। পরে আমি খবর পেয়ে বাসায় আসি। জিল্লুর রহমান আরো বলেন, আমার ছেলে করোনার কারণে স্কুল বন্ধ থাকায় দীর্ঘদিন ধরে মানসিক বিপর্যয় ছিল। আমি তাকে ডাক্তার দেখিয়েছি। বাসায় একা থাকায় সে গলায় ফাঁস দেয়।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (2)
মো: ইমরান আলী ৩০ নভেম্বর, ২০২১, ১২:৪৪ এএম says : 0
জি ভাই গত একমাস থেকে পারিবারিক ভাবে এমন সমস্যার মুখোমুখি আমি,,,সবসময় কাঁদছি,,বাবা মা বোন তাদের ভরসায় বেঁচে আছি,,না হলে হয়তো অনেক আগে চলে যেতাম এই পৃথিবী ছেড়ে!
Total Reply(0)
Arjina Akhter Amy ৩০ নভেম্বর, ২০২১, ৬:২৫ এএম says : 0
যদি আত্মহত্যা হয় এই ক্ষেত্রে একটি জিনিস লক্ষ্য করতে হয়,হয় তো তার মানসিক যন্ত্রণা আছে।এই ক্ষেত্রে,মা বাবা কে সবথেকে supportive হওয়া উচিত।কিন্তু,দুঃখজনক হলেও সত্যি মধ্যবিত্ত সমাজে এই অভাব টাই সবথেকে বেশি প্রকট।
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন