পৃথিবতে এক সময় কেয়ামত ঘটবে। এ কেয়ামতের পূর্বে বহু ছোট-বড় নিদর্শন প্রকাশ পাবে। নিদর্শনগুলোর মধ্যে বড় একটি নিদর্শন হলো ইমাম মাহদির আবির্ভাব। তিনি একজন একনিষ্ঠ ও ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তি যিনি মুসলমানদের খলিফা হবেন। মহানবী (সা.) থেকে প্রমাণিত ভবিষ্যদ্বাণীর আলোকে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আকিদা-বিশ্বাস হলো শেষ জমানায় প্রতিশ্রুত ইমাম মাহদির আবির্ভাব সত্য। সাহাবী-তাবেয়ি থেকে নিয়ে এখন পর্যন্ত সব স্তরের সংখ্যাগরিষ্ঠ আলেম, ফকিহ ও হাদিসবিশারদগণ ইমাম মাহদির আবির্ভাব নিয়ে আলোচনা করেছেন।
মাহদি অর্থ সুপথপ্রাপ্ত। এটি কোনো নাম নয়; বরং এটি হলো ইমামের উপাধি। কেননা আল্লাহ তায়ালা হকের প্রতি তাকে পথপ্রদর্শন করবেন। তাঁর অপর আরেকটি উপাধি হবে ‘জাবের’। কারণ, তিনি উম্মতে মুহাম্মদির আহত অন্তরে মলম লাগানোর কাজ করবেন কিংবা তিনি জালেমদের ওপর বিজয়ী হয়ে তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তিকে খতম করবেন। (আল-ইশাআ, পৃষ্ঠা : ১৯৩)।
বিশ্বস্ত বর্ণনা দ্বারা প্রমাণিত হয়, ইমাম মাহদির নাম মহানবী (সা.)-এর নামের মতো হবে। তাঁর বাবার নাম হবে মহানবী (সা.)-এর বাবার নামে। ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত একটি হাদিসে এসেছে, নবী (সা.) বলেন, ‘যদি কেয়ামত সংঘটিত হওয়ার মাত্র একদিনও অবশিষ্ট থাকে তবুও আল্লাহ তায়ালা ওই দিনকে দীর্ঘ করবেন এবং আমার বংশের এক ব্যক্তিকে প্রেরণ করবেন। তাঁর নাম আমার নামের সঙ্গে এবং তাঁর পিতার নাম আমার পিতার নামের সঙ্গে মিলে যাবে।’ (আবু দাউদ : ৪২৮২)।
বংশগতভাবে তিনি নবী বংশের হবেন। পিতার দিক থেকে তিনি হবেন হাসানি তথা হাসান (রা.)-এর বংশধর। মায়ের দিক থেকে হোসাইনি তথা হোসাইন (রা.)-এর বংশধর। (মিরকাতুল মাফাতিহ : ১০/১৭৪)। আলী (রা.) একবার হাসানকে দেখে বললেন, আমার এ ছেলে সাইয়েদ। রাসুল (সা.) তাকে সাইয়েদ বলে অভিহিত করেছেন। ওর বংশধর থেকে এক ব্যক্তি আসবেন, যার নাম নবীজির নামে হবে। তিনি স্বভাবগত দিক দিয়ে হাসানের মতো হবেন। তবে আকৃতিতে তার মতো হবেন না।’ (আবু দাউদ : ৪২৯০)।
তাঁর ব্যাপারে আব্বাস (রা.)-এর বংশধর হওয়ার কথাও রয়েছে। হাদিসে আছে, একবার রাসুল (সা.) ফাতেমা (রা.)-কে লক্ষ্য করে বললেন, কসম ওই সত্তার, যিনি আমাকে সত্য সহকারে পাঠিয়েছেন, মাহদি হবে এরা দুজন অর্থাৎ হাসান-হোসাইনের পরিবার থেকে এবং আমার চাচা আব্বাস (রা.)-এর বংশ থেকে।’ (আত-তালিকুস সবিহ : ৬/১৯৬)। তাঁর জন্ম হবে মদিনায়। (কিতাবুল ফিতান, পৃষ্ঠা : ২৫২)।
ইমাম মাহদির গঠন-প্রকৃতি : তাঁর গঠন-প্রকৃতি হবে খুবই সুন্দর। হোজাইফা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে আছে, তার চেহারা হবে উজ্জ্বল তারকার ন্যায়।’ (কানজুল উম্মাল : ৩৮৬৬৬)। আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, ইমাম মাহদি প্রশস্ত ললাট এবং লম্বা ও সরু নাকের অধিকারী হবে।’ (আবু দাউদ : ৪২৮৫)।
সে সময়কার পরিস্তিতি : ইমাম মাহদি আগমনের সময়কার পরিস্থিতি হবে খুবই ভয়ংকর। আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেছেন, ওই মহান সত্তার কসম, যার হাতে আমার প্রাণ, অবশ্যই মানুষের ওপর এমন একটি জমানা আসবে যখন হত্যাকারী বুঝতে পারবে না কী কারণে হত্যা করেছে এবং নিহত ব্যক্তিও বুঝতে পারবে না কী কারণে তাকে হত্যা করা হয়েছে।’ (মুসলিম: ২৯০৮)।
যে ধন-সম্পদ নিয়ে মানুষের মাঝে মারামারি-কাটাকাটি সে সময় জমিন তার ভেতরের খনিজ সম্পদ ভূপৃষ্ঠে নিক্ষেপ করে দেবে। আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেন, জমিন তার ভূগর্ভস্ত স্বর্ণের টুকরা (খনিজ সম্পদ) স্তম্ভের মতো নিক্ষেপ করে দেবে।’ (তিরমিজি : ২২০৮)।
অতি মূল্যবান সময় দ্রুতগতিতে শেষ হয়ে যাবে। সময়ের বরকত বলতে কিছু থাকবে না। আপতিত বিপদ-মুসিবত এবং ভয়ংকর পরিস্থিতির কারণে তাদের সময় কিভাবে বয়ে যাবে তারা টেরও পাবে না। আনাস ইবনে মালেক (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে এসেছে, ‘কেয়ামত ওই সময় পর্যন্ত সংঘটিত হবে না যতদিন না জমানা নিকটবর্তী না হবে (এত দ্রুতগতিতে অতিক্রম না হবে) যে, বছর মাসের সমান, মাস সপ্তাহ সমান, সপ্তাহ ঘণ্টা সমান এবং এক ঘণ্টা আগুনের আঙ্গরা জ্বলে ওঠার সমান না হবে।’ (আগুনে লাকড়ী যেমন দ্রুত শেষ হয়ে যায়, তেমনি একটি ঘণ্টাও শেষ হয়ে যাবে)। (তিরমিজি : ২৩৩২)। হাদিসটির ব্যাখ্যায় হাদিসের অমর ভাষ্যকার মোল্লা আলি কারি (রহ.) বলেন, এটা মাহদি, ঈসা (আ.) কিংবা উভয়ের সময়কালে হবে। তিনি আরও বলেন, এ ব্যাখ্যাটিই স্পষ্ট। কেননা এ বিষয়টি দাজ্জালের বের হওয়ার সময় ঘটবে। আর দাজ্জালের আবির্ভাব এ দুনোজনের সময়কালেই হবে। (মিরকাতুল মাফাতিহ : ১০/১৬৯)।
মর্যাদা : ইমাম মাহদি হবেন এ উম্মতের একজন খোদাভীরু শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি। আবু উমামা বাহেলি (রা.) থেকে বর্ণিত এক হাদিসে রাসুল (সা.) তাকে নেককার লোক বলে অভিহিত করেছেন। (ইবনে মাজাহ : ৪০৭৭)। (চলবে)
লেখক : মুহাদ্দিস, জামিয়া আরাবিয়া দারুল উলুম বাগে জান্নাত, চাষাঢ়া, নারায়ণগঞ্জ
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন