পূর্ব প্রকাশিতের পর
মজুদদারি সমাজে লোভ, হিংসা ও বিদ্বেষ ছড়িয়ে পড়ার কারণ হয়। ফলে সামাজিক মূল্যবোধ হ্রাস পায়। মানুষের মাঝে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। এক সময় সমাজের কাঠামো ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হয়।
সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়। মুদ্রাস্ফীতি ও বেকারত্ব বেড়ে যায়। ফলে আইন শৃংখলার মারাত্মক অবনতি ঘটে। আর অর্থনীতিতে চরম মন্দা ও অস্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করে।
আল্লামা ইউসুফ কারযাভী বলেন, মজুদদারি দু’টি শর্তে হারাম। এমন এক স্থানে ও এমন সময় পণ্য মজুদ করা হবে যার কারণে জনগণের তীব্র অসুবিধার সম্মুখীন হতে হবে। মজুদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হবে অধিক মূল্য হরণ। যার ফলে মুনাফার পরিমাণ অবেক বেড়ে যাবে।
আল-মুগনী ওয়াশ মারহুল কাবীর আলা মাতানিল মুকনি ফি ফিকহিল ইমাম আহমাদ গ্রন্থকারের মতে তিনটি শর্তে মজুদদারি হারাম। পণ্য ক্রয়কৃত হতে হবে। যদি পণ্য আমদানীকৃত হয় বা নিজস্ব উৎপাদিত হয়, আর তা মজুদ করে রাখে তাহলে ইহতিকার হিসেবে গণ্য হবে না। পণ্য একান্ত প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য হতে হবে। সুতরাং মসলা, হালুয়া, মধু, যায়তুন, গবাদি পশুর শুকনো খাদ্য ইত্যাদি মজুদ করে রাখলে তা হারাম হবে না। পণ্য ক্রয়ে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগে নিপতিত হওয়া। এর আবার দু’টি পর্যায় রয়েছে- ক. ছোট শহর যেখানে পণ্য মজুদ করলে মানুষের কষ্ট হবে এবং মূল্য বেড়ে যাওয়ার আশংকা রয়েছে। এমতাবস্থায় ইহতিকার হারাম। খ. পণ্য সামগ্রীর সংকট বা অভাবের সময় যদি কোন বণিকদল দ্রব্য সামগ্রী নিয়ে শহরে প্রবেশ করে আর ধনী লোকেরা দ্রæত তাদের কাছ থেকে তা কিনে নেয়, ফলে মানুষের মাঝে পণ্যের সংকট দেখা দেয়, তাহলে ইহতিকার হারাম হবে। আর যদি খাদ্য সামগ্রী বাজারে পর্যাপ্ত পরিমাণে মজুদ থাকে এবং কম মূল্যে ক্রয় করা যায়। আর এতে মানুষের কষ্ট না হয় তাহলে ইহতিকার হারাম হবে না। আল-হিদায়া গ্রন্থকারের মতে, পণ্য মানুষ ও চতুষ্পদ জন্তুর খাদ্য হতে হবে এবং মজুদদারির কারণে মানুষ ও জীবজন্তুর কষ্ট হওয়ার সম্ভবনা থাকতে হবে। আর যদি কষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা না থাকে তাহলে ইহতিকার করা নিষিদ্ধ নয়।
মালিকী, শাফেয়ী ও হাম্বলী মাযহাবের অধিকাংশ আলেমের মতে মজুদদারি সম্পূর্ণ হারাম। কিন্তু হানাফী আলিমগণের মতে মজুদদারি মাকরূহ। রাদ্দুল মুহতার গ্রন্থকার বলেছেন, মানুষ ও পশুর খাদ্যদ্রব্য মজুদ করার কারণে যদি সেখানকার অধিবাসীদের কষ্ট বা ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে তাহলে মজুদ করা মাকরূহ। আর যদি ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা না থাকে তাহলে মাকরূহ হবে না।
ইমাম গাযালী র. এর মতে, মজুদদারি হারাম। তিনি এর কারণ উল্লেখ করে বলেন, এতে আল্লাহর বান্দাগণের কষ্ট ও অনিষ্ট সাধিত হয়ে থাকে। কোন ব্যক্তি সমস্ত শস্য ক্রয়পূর্বক আটক করে রাখলে অবশিষ্ট সকলেই এ থেকে বঞ্চিত থাকবে। এ উদ্দেশ্যে খাদ্যশস্য খরিদ ও মজুদ করে রাখা পাপ।
ইহতিকার এর উদ্দেশ্য যদি হয় মাল আটক রেখে মূল্য প্রচুর বৃদ্ধি পেলে তা বিক্রি করা এবং অন্যান্য প্রাণির কষ্ট দুর্ভোগ বিবেচনা না করে সম্পদ আটক রাখা তবে তা শরীয়তে জায়েয নয়। কিন্তু যে ব্যক্তি নিজের উৎপাদিত প্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রী জমা করে বা দূরবর্তী এলাকা যেখান থেকে সাধারণত সংশ্লিষ্ট এলাকায় খাদ্য সামগ্রী ও জরুরী জিনিসপত্র আসে না, সেখান থেকে ক্রয় করে এনে জমা করে রাখে বা নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রী ও জিনিসপত্র ছাড়া অন্য জিনিসপত্র যা মৌলিক প্রয়োজনে পড়ে না এমন জিনিস জমা রাখে, তাহলে সে ব্যক্তি শরীয়তের দৃষ্টিতে মজুদদার গণ্য হবে না।
তবে উল্লেখিত অবস্থায় যদি মানুষ কিংবা প্রাণির বিশেষ প্রয়োজন দেখা দেয়, তাহলে সম্পদ আটক না রেখে ন্যায্য মূল্যে বিক্রয় করা ইসলাম ও মনুষত্বের দাবি।
ইসলাম মানব জাতির কল্যাণ নিশ্চিত করার লক্ষে জীবনের সর্বক্ষেত্রে ইসলাম যুগোপযোগী বিধান দিয়েছে। ব্যবসায়-বাণিজ্যের মত অতীব গুরুত্বপূর্ণ কর্মকাÐেও কল্যাণকর নীতি-আদর্শ উপহার দিয়েছে। এ নীতির অন্যতম দিক হলো- মজুদদারি, মুনাফাখোরী, কালোবাজারী ও যে কোন প্রতারণামূলক ব্যবসায়-বাণিজ্যের নিষিদ্ধকরণ। ইসলাম অতি মুনাফার লোভে প্রতারণা করে ও অপকৌশল অবলম্বন করে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রী আটক রাখাকে অবৈধ ঘোষণা করেছে। আধুনিক কালেও যেখানে পৃথিবীর নানা স্থানে মজুদদারির প্রভাবে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিতে জনসাধারণ বিপর্যপ্ত, সেখানে ইসলাম বহুকাল পূর্বেই এর আইনগত বিধান বর্ণনা ৃকরে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের অধিকার নিশ্চিত করেছে। পরিশেষে আমরা বলতে পারি, ইসলাম নির্দেশিত পন্থায় যদি ব্যবস্থায়-বাণিজ্য সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা হয় তাহলে শুধু মজুদদারির অপতৎপরতাই নয় ব্যবসায়-বাণিজ্যে কোন ধরণের নৈরাজ্য থাকবে না।
লেখক : ইসলামী চিন্তাবিদ, গবেষক।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন