সোমবার থেকে শুরু হওয়া রেড সি ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে অতীতের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার জন্য ব্যবহৃত একটি মাঠে হিলারি সোয়াঙ্ক এবং নাওমি ক্যাম্পবেলের মতো তারকারা গাউন পরে লাল গালিচায় হেঁটেছেন এবং সউদী প্রভাবশালীরা ডিজে পার্টিতে নেচেছেন। এ সবই ঘটেছে এমন একটি দেশে, যেখানে কয়েক বছর আগে পর্যন্ত মহিলাদের গাড়ি চালানোর অনুমতি ছিল না, সিনেমা নিষিদ্ধ ছিল এবং উচ্চাকাক্সক্ষী চলচ্চিত্র নির্মাতাদের জনসমক্ষে মৃত্যুদন্ড থেকে বাঁচার জন্য প্রায়ই পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিতে হতো।
সউদী আরবের এই সাস্কৃতিক পরিবর্তনটি প্রকৃতপক্ষে সউদী আরবের ছায়া শাসক ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান-এর হাত ধরে সঙ্ঘটিত হতে শুরু করেছে, যিনি দেশটির অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য একটি বিশ^জনীন বিনোদন শিল্প তৈরি করে সউদী আরবের নেতিবাচক ভাবমর্যাদাকে ঝেড়ে ফেলতে বদ্ধপরিকর। যদিও বিভিন্ন সঙ্ঘাত ও সঙ্কট আরব সংস্কৃতির রাজধানীগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করে চলেছে, এর মধ্যেও সউদী আরব চলচ্চিত্র উৎসবের আয়োজন করছে এবং নতুন সিনেমার তৈরির জন্য ব্যাঙ্ক ঋণ দিতে শুরু করেছে।
অতি রক্ষণশীল চিরাচরিত প্রথা ভেঙে সউদী আরবের এই সাংস্কৃতিক উদ্যোগ সমগ্র আরব বিশ্বের সৃজনশীল শিল্পে চলমান গভীর পরিবর্তনকে প্রতিফলিত করছে। বিগত শতাব্দীগুলোতে দেশটি তেল, মরুভ‚মি এবং রক্ষণশীল ইসলামের জন্য পরিচিত হলেও কায়রো, বৈরুত, দামেশক এবং বাগদাদ আরব সাংস্কৃতিক প্রতিনিধিত্ব করেছে এবং বহু বøকবাস্টার সিনেমা, হিট গান এবং বহুল বিক্রিত সাহিত্য উপহার দিয়েছে।
এই মাসে জেদ্দায় একটি ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে প্রিমিয়ার হওয়া ২৭টি সউদী-নির্মিত চলচ্চিত্রের মধ্যে এমন কয়েকটি ছিল, যা মধ্যপ্রাচ্যে একটি সাংস্কৃতিক রক্ষণশীলতা থেকে বেরিয়ে এসে নিজেকে একটি সিনেমাটিক পাওয়ার হাউসে রূপান্তর করার জন্য সউদী আরবের বিশাল প্রচেষ্টার অংশ। চলচ্চিত্রগুলোর একটিতে দেখা যায় যে, একজন গর্ভবতী সউদী মহিলা বাড়ি থেকে অনেক দূরে নিজেকে ভিতরের এবং বাইরের ইবলিসের দ্বারা পরিবেষ্টিত দেখতে পান। অন্যটিতে, একজন সউদী ব্লগার ও তার বন্ধুরা ইন্টারনেট আসক্তির ফলে সৃষ্ট আরো রহস্যময় বিপদের আশঙ্কায় অন্ধকার জঙ্গলে পালানোর চেষ্টা করে। আরেকটিতে, একটি বিয়েতে আতঙ্কগ্রস্ত কনের মাকে দেখা যায়, যার মেয়ে নিচের তলায় অপেক্ষা করা সমস্ত অতিথিদের সাথে অদৃশ্য হয়ে যায়।
গত এক দশকে আঞ্চলিক দ্ব›দ্ব, আর্থিক মন্দা এবং রাষ্ট্রগুলোর ব্যর্থতার কারণে আরব সংস্কৃতি ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। বছরের পর বছর ধরে চলা যুদ্ধ সিরিয়ার টেলিভিশন স্টুডিও এবং বাগদাদের প্রকাশকদের ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। অর্থনৈতিক পতন লেবাননের সিনেমাগুলোকে অস্তিত্ব সঙ্কটে ফেলেছে। মিসরের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি, যা দেশটির উপভাষাকে সবচেয়ে বেশি বোধগম্য আরবিতে পরিণত করেছে, বহু বছর ধরে সেটি পতনের মধ্যে রয়েছে এবং এর টিভি শো-গুলোকে সরকার-সমর্থিত থিম প্রচারের জন্য দেশের গোয়েন্দা পরিষেবাগুলো হাইজ্যাক করেছে।
বিভিন্ন পরিস্থিতিতে এই অঞ্চলের স্থবির সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলটিতে আধিপত্যের আবহ হয়েছে এবং সউদী আরব সুযোগটি কাজে লাগাতে প্রচুর ব্যয় করছে। নতুন চলচ্চিত্র শিল্প গড়ে তোলার জন্য সউদীরা তাদের দেশের তেল সম্পদ ব্যবহার করে দেশীয় প্রযোজনার জন্য অর্থায়ন করছে, সউদী চলচ্চিত্র নির্মাতাদের বিদেশে পড়াশোনা করার জন্য স্পন্সর করছে এবং দেশীয়ভাবে প্রশিক্ষণের জন্য স্কুল, সাউন্ড, স্টেজ এবং স্টুডিওগুলো স্থাপন করছে। দেশটি সউদী ভিজ্যুয়াল শিল্পী, সঙ্গীতশিল্পী এবং শেফদের পৃষ্ঠপোষকতার জন্য অনুরূপ উদ্যোগে অর্থায়ন করছে।
একজন সরকারি কর্মকর্তা ঘোষণা করেছেন যে, সউদী সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে ১শ’ চলচ্চিত্র নির্মাণের অনুমতি এবং অর্থায়নসহ নতুন প্রকল্পগুলোতে অন্যান্য সহায়তা প্রদান করবে। সউদী চলচ্চিত্র নির্মাতাদের জন্য অনুষ্ঠিত হওয়া একটি ট্যালেন্ট হান্টে সউদী আরবের চলচ্চিত্র ও থিয়েটার প্রযোজক মোনা খাশোগি এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘এখানে সউদী আরবে আলোকিত হওয়ার সময় এসেছে।’
এরই মধ্যে সউদী সরকার তিনটি বড়-বাজেটের হলিউড প্রযোজনাকে অর্থায়ন এবং সরকারিভাবে সরবরাহকৃত হেলিকপ্টার এবং ফাইটার জেট দিয়ে সউদী ফিল্মের জন্য তাদের উৎসাহিত করেছে, যেগুলোর দর্শনীয় মরুভ‚মির ল্যান্ডস্কেপ গন্তব্য হিসেবে জর্ডান এবং মরক্কোকে ছাড়িয়ে যেতে পারে। উৎসবে একটি প্যানেল আলোচনা চলাকালে সউদী বিনিয়োগ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা বাহা আব্দুল মাজিদ বলেন, ‘সরকারের লক্ষ্য হ’ল, সউদী আরবকে এই অঞ্চলে চলচ্চিত্র নির্মাণের একটি নতুন কেন্দ্র হিসাবে গড়ে তোলা।’
সউদী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও চলচ্চিত্রগুলো এই অঞ্চলের দেখার অভ্যাসের রূপান্তর ঘটাচ্ছে এবং সুযোগ তৈরি করছে। এটি আরবি ভাষার অনুষ্ঠাগুলোর জন্য একটি বড় বাজার তৈরি করেছে। দেশটি ইতোমধ্যেই আরবও স্ট্রিমিং পরিষেবার ক্ষুধা মেটাতে শুরু করেছে। নেটফ্লিক্স গত বছর সউদী ক্রিয়েটিভ স্টুডিও টেলফাজ১১-এর সাথে আটটি ছবির চুক্তি স্বাক্ষর করেছে।
সউদী আরবের এই পরিবর্তন সম্পর্কে উত্তর ক্যারোলাইনার ডেভিডসন কলেজের আরব স্টাডিজ-এর অধ্যাপক রেবেকা জুবিন বলেন, ‘সউদী প্রযোজনাগুলোও লেবানন, সিরিয়া এবং মিসরের থেকে অভিনয়, লেখা এবং পরিচালনায় প্রতিভার পরিচয় দিতে পারে এবং অ-সউদী দর্শকদের কাছে পৌঁছানোর জন্য সম্ভবত এটি করতে হবে।’
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন