শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ধর্ম দর্শন

মুসলিহে উম্মাহ হযরত মাওলানা ইদরীস স›দ্বীপী (রহ.)

মুহাম্মদ জিয়াউল হক | প্রকাশের সময় : ৩০ ডিসেম্বর, ২০২১, ১২:০৪ এএম

আল্লাহ পৃথীবিতে নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন। বিভ্রান্তির অতল গহ্বরে নিমজ্জমান মানবকুলকে তাঁরা তুলে আনেন মুক্তির সরলপথে। পঙ্কিলতার নর্দমা থেকে শান্তি ও পবিত্রতার সরোবরে। আমাদের নবী হযরত মুহাম্মদ সা. এর পর আর কোনো নবী-রাসূল এ ধরাপৃষ্ঠে আসবেন না। কিন্তু নবীওয়ালা কাজ আঞ্জাম দেয়ার জন্য তাঁর ওয়ারিসগণ আছেন।

যুগে যুগে যে সমস্ত আল্লাহপ্রেমিক মনীষীগণ, সীমাহীন ত্যাগ, অনুপম সাধনা ও জ্ঞানের গভীরতা দিয়ে ‘ইলমে ইলাহী’ ও ‘ইলমে নববী’র বিস্তৃত ময়দান আবাদ রেখেছেন, যারা উম্মাহর আত্মশুদ্ধির রাহবার হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছেন। ইতিহাসে যাদের নাম স্বর্ণাক্ষরে খচিত, মরেও যারা অমর হয়ে আছেন মানুষের হৃদয়যপটে। যাদের নাম শুনলে মানুষ ভক্তিভরে শ্রদ্ধার সাথে স্বরণ করে। যারা আকাশের উজ্জল নক্ষত্রের মতো দীপ্তিমান আলোকবর্তিকা, বিগত শতাব্দীতে আমাদের দেশে যে ক’জন মহামনীষীদের আবির্ভাব হয়েছে হযরত ইদরীস স›দ্বীপী রহ. ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম। তিনি ছিলেন কর্মদক্ষ ও কর্মতৎপর এক মহান পুরুষ। তিনি ছাত্রজীবন ও কর্মজীবনে অক্লান্ত পরিশ্রম, ত্যাগ তিতিক্ষা ও অবিরাম প্রচেষ্টায় নিজেকে প্রকৃত নায়েব রাসূল সা. রূপে গড়ে তুলেন। তার কথা-বার্তা ও স্বভাব-চরিত্র দেখলে আল্লাহ, রাসূল সা. ও সাহাবায়ে কেরামের রা. এর কথা মনে পড়ত। তার মাঝে সিদ্দীকী উদারতা, ফারুকী সাহসিকতা, উসমানী লাজুকতা ও হায়দারী বিচক্ষণতার ভাব চমৎকারভাবে ফুটে ওঠে। তিনি নববী ও সাহাবী জীবনাদর্শকে জীবন পথের পাথেয় করে নিয়েছিলেন। ফলে তার ন¤্রতা, ভদ্রতা ও শিষ্টাচার দেখে মানুষ বিমুগ্ধ হতো। তিনি পার্থিব আরাম-আয়েশ ত্যাগ করে দীনের খেদমতে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল মানুষের জীবনের প্রতিটি কাজকর্ম ‘সুন্নাত’ অনুযায়ী হোক, পত্যেক মানুষের জীবনে নবী করীম সা. ও সাহাবাদের জীবনাদর্শ ফুটে উঠুক। জীবনের অন্তিম মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি ছিলেন ইসলামের তরে নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তিত্ব। যার ফলে সুদূর আমেরিকার নিউইয়ার্কসহ দেশ-বিদেশে প্রতিষ্ঠা করেছন, শতাধিক দীনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। অজপাড়া গায়ে শিক্ষাবঞ্চিত শিশু-কিশোরদের মাঝে ইসলামী শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিয়েছেন। সমাজ সংস্কার ও শিক্ষার প্রচার-প্রসারে তিনি ছিলেন বদ্ধপরিকর।

জন্ম: প্রকৃতির কোলে কালের সূর্যোদয়: কালজয়ী এই আধ্যাত্মিক রাহবার ১৯৩১ সালে বর্তমান চট্রগ্রাম জেলাধীন বঙ্গোপসাগর বেষ্টিত স›দ্বীপ থানার এক নিবিড় পল্লী সন্তোষপুরে জন্মগ্রহণ করেন। সাত ভাই এক বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছোট। তার পিতার নাম মুহাম্মাদ আব্দুল গনী। মাতার নাম সায়্যিদাতুন নিসা। স›দ্বীপের অপরূপ নৈসর্গিক মায়াময় পরিবেশে শৈশবের সোনাঝরা দিনগুলো তিনি অতিক্রম করেন। মুক্ত আবহাওয়ায় বেড়ে উঠেন। বাল্যকাল থেকেই তাঁর চিন্তা-চেতনা ছিল সুদূরপ্রসারী। পাড়ার ছেলেরা মাঠে খেলাধুলা করতো। তিনি এককোণে বসে ভাবুক মননে মাটিতে কী যেন আঁকিবুঁকি করতেন! পিতা-মাতার ¯েœহছায়ায় থেকে সত্য ও সততা, ন্যায় ও ইনসাফের আদর্শিক পাঠগুলো সহজেই আত্মস্থ করে নেন। শৈশবকাল থেকেই তাঁর মনে সুপ্ত ছিল ‘ইলমে’ইলাহী’র তীব্র বাসনা।

শিক্ষা: সফলতার হাতছানি: হযরত স›দ্বীপী রহ. এর শিক্ষার হাতেখড়ি হয় স›দ্বীপের মুন্সিরহাট প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এর পাশাপাশি তিনি তাঁর বাল্যকালের উস্তাদ মাওলানা নূরুল ইসলাম সাহেবের কাছে কায়েদা থেকে কুরআনুল কারীম পর্যন্ত শিক্ষা লাভ করেন। এছাড়াও এ সময় তিনি মিফতাহুল জান্নাত, রুকনুদ্দীন, কারীমা, পান্দেনামা, গুলিস্তাঁ, সিকান্দারনামা ইত্যাদি কিতাবের পাঠ গ্রহণ করেন। শৈশবের শেখা উপদেশমূলক কিতাব কারীমা ও গুলি¯ঁঁঁঁঁঁঁÍার প্রভাব তাঁর পুরো জীবন ধারায় প্রতিফলিত হয়েছিল। সমসাময়িক আলেমগণের মতে হযরতের জীবন ছিল কারীমা ও গুলিস্তাঁর প্রতিচ্ছবি। প্রাথমিক শিক্ষা অর্জনের জন্য তিনি ভর্তি হন পাশর্^বর্তী গ্রাম মাইটভাঙ্গায় অবস্থিত করিমবাড়ী মাদরাসায়। সেখানে আরবি ব্যাকরণ নাহু-সরফের অভিজ্ঞ উস্তাদ মাওলানা সাইয়িদ আহমাদ সাহেবের কাছে শিক্ষা অর্জন করেন। পরবর্তীতে বশিরিয়া সিনিয়র ইসলামিয়া মাদরাসায় ভর্তি হন এবং কৃতিত্বের সাথে পড়াশোনা করেন। সেখানে পড়াশোনা করা অবস্থায় তার শ্রদ্ধেয় পিতা-মাতা উভয়ে ইন্তিকাল করেন। আমল-আখলাক ও সুন্নাতী লেবাসের কারণে উস্তাদগণ তাকে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য দেওবন্দ যাওয়ার পরামর্শ দেন। অনেক প্রতিকূলতার মাঝেও অবশেষে তিনি পাড়ি জমান বিশ^বিখ্যাত ইসলামী বিদ্যাপীঠ ভারতের দারুল উলূম দেওবন্দ। সেখানে তিনি দীর্ঘ চার বছর উচ্চশিক্ষা অর্জন করেন।

খেলাফত প্রাপ্তি: সূর্যের আলো থেকেই পূর্ণিমা: দারুল উলূম দেওবন্দে দাওরায়ে হাদীস সমাপনান্তে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের বীরসেনানী, আওলাদে রাসূল সাইয়িদ হুসাইন আহমদ মাদানী রহ. তাকে বললেন, যাও! দেশে, গিয়ে দীনের খেদমত করো, চাই তা ‘কায়েদায়ে বোগদাদী’ পড়ানোর মাধ্যমেই হোক না কেন। তিনি বললেন, হযরত! আপনার হাতে ‘বাইয়াত’ হতে চাই। মাদানী রহ. বাইয়াত করে নিলেন। শুরু হল সুলূকের পথে কঠিন মেহনত। শাইখের সাথে গড়ে উঠল অন্তরের গভীর সম্পর্ক। শাইখকে না দেখলে তিনি অস্থির-অশান্ত হয়ে পড়তেন। শাইখকে দেখলেই তার সব দুঃখ-কষ্ট ভুলে যেতেন। আধ্যাত্মিক জগতের অন্যতম রাহবার হযরত মাওলানা সাইয়িদ হুসাইন আহমাদ মাদানী রহ. এর সংস্পর্শে থেকে তিনি টানা দেড় বছরর সুলূক ও আধ্যাত্মিকতার পথে মেহনত করেন। দুই বছর পর মাদানী রহ. এর খেলাফত প্রাপ্ত হয়ে দীর্ঘ ছয় বছর পর স্বদেশে প্রত্যাবর্র্র্তন করেন। চার বছরের শিক্ষার্জন ও দুু’বছরের আধ্যাত্মিক সাধনার মধ্যে তিনি একবারও দেশে আসেননি। দেশে ফেরার পর তিনি শরিয়তের হুকুম-আহকামের প্রতি মানুষেকে উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন। সমাজ থেকে বিদআত ও কুসংস্কার দূরীকরণে জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যান।

শিক্ষকতা: আলো ছড়ায় সবার তরে: হযরত মাওলানা ইদরীস রহ. এর কর্মজীবন ছিল বর্ণাঢ্য ও দীপ্তিময়। ভারতের ঐতিহ্যবাহি দারুল উলূম দেওবন্দ থেকে স›দ্বীপ আসার পর প্রথমে স›দ্বীপ কাঠগড় ইসলামিয়া সিনিয়র মাদরাসার প্রিন্সিপাল নিযুক্ত হন। কয়েক বছর পর প্রতিষ্ঠান থেকে অব্যহতি নিয়ে কিছুকাল দারুল উলূম দক্ষিণ স›দ্বীপের মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। অধ্যাপনার সময়ে তিনি ছাত্রদের আমল-আখলাকের প্রতি খুব গুরুত্ব দিতেন। তিনি বাংলাদেশের পথহারা-পথভোলা জনগেুাষ্ঠির চারিত্রিক সংশোধন ও উন্নতি সাধনের লক্ষ্যে ‘তাহরিকে ইসলাহুল উম্মাহ’ নামে দাওয়াত ও তাজকিয়ার মেহনত চালু করেছেন । বর্তমানে তার সুযোগ্য উত্তরসূরী, বড় সাহেবযাদা হযরত মাওলানা ফয়জুল্লাহ স›দ্বীপী দা. বা. এই মেহনত সারাদেশে ব্যাপক পরিসরে চালিয়ে যাচ্ছেন। বিভিন্ন স্থানে নিয়মিত মাসিক ইসলাহী জোড় করছেন। প্রতি বছরের ন্যায় এ বছরও মাদানীনগর মাদরাসায় বার্ষিক ‘ইসলাহী জোড়’ জানুয়ারি ১৪, ১৫ তারিখ ২০২২ অনুষ্ঠিত হবে। (চলবে)

লেখক : ভাইস প্রিন্সিপাল. মদিনা মাদরাসা শ্রীরামপুর বাজার, রায়পুরা, নরসিংদী।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন