অর্থ, ক্ষমতা, প্রতিপত্তি- এর কোনোটাই চিরস্থায়ী নয়। মানুষের ভালো কাজগুলো তার মৃত্যুর পর সবাই স্মরণ করে। আর অপকর্মের জন্য মৃত্যুর পরও ধিক্কার দিতে থাকে। তেমনি একজন খুলনার কুখ্যাত এরশাদ শিকদার। ২০০৪ সালের ১০ মে মধ্যরাতে খুলনার জেলা কারাগারে ফাঁসির মঞ্চে গলায় রশি ঝুলিয়ে তার মৃত্যুদÐ কার্যকর করা হয়। এরশাদ শিকদার পৃথিবীতে নেই, কিন্তু তার কুকর্মের জন্য এখনো তাকে মানুষ ধিক্কার জানায়, ঘৃণা প্রকাশ করে।
পাপের সাক্ষ্য বিলাসবহুল ‘স্বর্ণকমল’
এরশাদ শিকদার ওরফে রাঙ্গা চোরা! শতাব্দীর ভয়ঙ্কর এক সিরিয়াল কিলারের নাম। এক সময় সদম্ভে বলত, পৃথিবীর কেউই তাকে তার আসন থেকে সরাতে পারবে না। ষাটের বেশী খুনের অভিযোগ ছিল তার বিরুদ্ধে। প্রতিটি হত্যাকান্ডের পর সহযোগিদের নিয়ে দুধ দিয়ে গোসল করত। অসংখ্য নারী ধর্ষণ, একাধিক বিয়েসহ এমন কোনো অপকর্ম নেই যা এরশাদ শিকদার তার জীবদ্দশায় করেনি।
এরশাদ শিকদারের জন্ম ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলার মাদারঘোনা গ্রামে। তার বাবার নাম বন্দে আলী শিকদার। আট ভাই বোনের মধ্যে এরশাদ শিকদার দ্বিতীয়। ১৯৬৭ সালে জন্মস্থান নলছিটি থেকে খুলনায় আসে এরশাদ শিকদার। কিছুদিন পর রেলওয়ে স্টেশনে কুলির সহযোগী হিসেবে কাজ করে। এরপর রেললাইনের পাত চুরি করে বিক্রি করত এমন একটি দলে যোগ দেয়।
পরে তাদের নিয়ে নিজেই একটি দল গঠন করেন এবং এলাকায় ‘রাঙ্গা চোরা’ নামে পরিচিতি পায় এরশাদ শিকদার। মাত্র ১০ বছরের মধ্যেই ১৯৭৬ সালে এরশাদ শিকদার রামদা বাহিনী নামে একটি দল গঠন করে। যারা খুলনা রেলওয়ে স্টেশন ও ৪ নম্বর ঘাট এলাকায় চুরি-ডাকাতি এবং বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ে। এই রামদা বাহিনী নিয়েই এরশাদ শিকদার ১৯৮২ সালে ৪ ও ৫ নম্বর ঘাট এলাকা দখলে নিয়ে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
কাউকে প্রতিপক্ষ মনে করলে তাকে প্রথমে নির্যাতন করা হত। হাত পা বেঁধে মাটিতে শুইয়ে এরশাদ শিকদার তার উপরে উঠে উল্লাস করত। এভাবে নির্যাতনে বুকের পাজরসহ শরীরের হাড় ভেঙ্গে যেত। এরপর তাকে এরশাদ শিকদারের নিজস্ব আফ্রিকান রাক্ষুসী মাগুরের হাউজে ছেড়ে দেয়া হত। মাগুরগুলো ছিন্ন বিছিন্ন করে খেয়ে ফেলত শিকারের দেহ।
ওই সময় মদের বোতল হাতে নিয়ে গান গাইতে গাইতে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যার প্রমানও মেলে। স্ত্রী খোদেজার সাথে পরকীয়া সন্দেহে গৃহশিক্ষক ফটিককে গলায় ফাঁস দিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল এরশাদ শিকদার। পরে জমাট সিমেন্টের সঙ্গে ফটিকের লাশ বেঁধে ভৈরব নদে ডুবিয়ে দেয়া হয়। এভাবে একের পর এক হত্যাকান্ড ঘটিয়ে এরশাদ শিকদার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মাটি কাঁপিয়েছে।
জাতীয় পার্টি ও বিএনপি হয়ে ১৯৯৬ সালের ২৬ ডিসেম্বর দল পরিবর্তন করে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যোগ দেয় এরশাদ শিকদার। কিন্তু সমালোচনার মুখে কিছুদিন পরই তাকে আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়। ১৯৯৯ সালে গ্রেফতার হওয়ার সময় ছিলেন খুলনা সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ড কমিশনার। রাজনীতিতে প্রবেশ করার পর আরও ক্ষমতাধর হয়ে ওঠে।
১৯৮৪ থেকে ১৯৮৬ পর্যন্ত খুলনার রেলওয়ের সম্পত্তি এবং জোরপূর্বক ব্যক্তিগত সম্পত্তি দখল, মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি ও অন্যান্য অপরাধমূলক কর্মকান্ডে লিপ্ত হয়। সেই সময় কমপক্ষে ৫০০ কোটি টাকার মালিক হয়। ২৪টি হত্যাকান্ডের বর্ণনা দিয়ে আদালতে জবানবন্দি দেয় তার বডিগার্ড নুর আলম। নিম্ন আদালতের বিচারে সাতটি হত্যা মামলায় তার ফাঁসি ও চারটি মামলায় যাবজ্জীবন কারাদÐ সাজা হয়। সে সময় তার বিরুদ্ধে ৪৩টি মামলা চলমান ছিল।
খুলনা মহানগরের সোনাডাঙ্গার মজিদ স্মরণিতে দাঁড়িয়ে আছে সেই বিলাসবহুল বাড়ি ‘স্বর্ণকমল।’ এরশাদ শিকদারের বহু অপকর্মের সাক্ষী এই ‘স্বর্ণকমল।’ বাড়িতে গোপন কক্ষ এবং অস্ত্র ভান্ডারের কথাও শোনা যায়। ওই বাড়ির বিভিন্ন গোপন স্থানে নগদ কয়েক কোটি টাকা লুকানো ছিল। প্রায়ই জলসা বসত বাড়িতে। শহরের নামীদামী ব্যক্তিরা যেতেন সেখানে। এক সময় সাধারণ মানুষের খুব আগ্রহের একটি জায়গা ছিল ‘স্বর্ণকমল’। অনেকে বাড়িটি দেখতে আসত। আলোচনা-সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল ওই বাড়িটি। এখন আর কউ ফিরেও তাকায় না। বাড়ির সামনে নামফলকটিও নেই। বাড়িটি গত ১৫ বছরে আগের সেই জৌলুশও হারিয়েছে।
পরিবারের সদস্যরা কোথায়?
ফাঁসির রায় কার্যকরের পর এরশাদ শিকদারের সহযোগী জাহাজী মতিকে বিয়ে করে ঢাকায় পাড়ি জমান তার প্রথম স্ত্রী খোদেজা। প্রথম দিকে এ ধরনের খবর শোনা গেলেও বর্তমানে খোদেজা ‘স্বর্ণকমলে’ বসবাস করছেন। তার তিন ছেলে মো. মনিরুজ্জামান শিকদার জামাল, মো. কামাল শিকদার ও মো. হেলাল শিকদার বর্তমানে খুলনায় ছোট-খাটো ব্যবসা করেন। এছাড়া বিয়ের পর মেয়ে স্বর্ণা শিকদার শ্বশুর বাড়িতেই আছে। তারা বাবার পরিচয় দিতে বিব্রতবোধ করেন। এরশাদ শিকদারের ছোট স্ত্রী সানজিদা নাহার শোভা ‘স্বর্ণকমল’ ছেড়ে বিউটি পার্লারের ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন। শোভা বর্তমানে একমাত্র মেয়ে এশাকে নিয়ে ঢাকায় বসবাস করছেন।
এরশাদ শিকদার গ্রেফতার হওয়ার পর প্রশাসন ঘাট এলাকায় তার বরফ কল গুঁড়িয়ে দেয়। তবে আলোচিত ‘স্বর্ণকমল’ ইতিহাসের নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এখনও মজিদ স্মরণি দিয়ে চলাচলের সময় উৎসুক জনতার চোখ একবারের জন্য হলেও ‘স্বর্ণকমল’ এড়িয়ে যেতে পারে না।
এরশাদ শিকদারের জীবদ্দশায় বড় ছেলে মো. মনিরুজ্জামান শিকদার জামালের বিয়ে হয়। কথিত আছে- ছেলের বিয়ের উৎসবেই তিনি ‘আমি তো মরেই যাবো, চলে যাবো, রেখে যাবো সবি’ গান গেয়ে সবাইকে আনন্দ দেয়। পরবর্তীতে গানটি সবার মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে। তার ফাঁসির পর মেঝ ও ছোট ছেলে প্রেম করে বিয়ে করেছে।
এরশাদ শিকদারের ফাঁসির পর তার ছেলেদের জীবন-যাপনে ছন্দপতন ঘটে। ‘স্বর্ণকমল’ যখন উৎসুক জনতার কৌতুহলে পরিণত হয়, তখন তারা ‘স্বর্ণকমল’ ছেড়ে দূরে থাকার চেষ্টা করেন। এরশাদ শিকদার নিয়ন্ত্রিত ঘাট এলাকাগুলোতে এখন আর তার কোনো কিছুর চিহ্ন নেই। নিজ নামে প্রাইমারী স্কুলটি রয়েছে। বরফ কলের মালিকানা বদলেছে। দখলকৃত অনেক জায়গা উদ্ধার করেছে রেলওয়ে। বেশ কিছু জায়গা চলে গেছে নতুন গজিয়ে ওঠা প্রভাবশালীদের দখলে। জীবিত অবস্থার ত্রাস এরশাদ শিকদার ঠাঁই হয়েছে খুলনার টুটপাড়া কবরস্থানে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন