সোমবার ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইংরেজি নববর্ষ সংখ্যা

রায়-রিট-আদেশে বছরজুড়ে আলোচনায় বিচার বিভাগ

সাঈদ আহমেদ | প্রকাশের সময় : ১ জানুয়ারি, ২০২২, ১২:১০ এএম

করোনা সংক্রমণ সত্তে¡ও ২০২১ সালে রায়-রিট-আদেশে বছরজুড়ে আলোচনায় ছিল দেশের বিচার বিভাগ। বিচারপতি, বিচারক, আইনজীবী এবং সহায়ক কর্মচারীদের করোনাজনিত মৃত্যুর মধ্যে ভার্চুয়ালি ১১ মাস কার্যক্রম চলেছে। বছরের শেষ মাসে উচ্চ আদালতে কার্যক্রম শুরু হয় শারীরিক উপস্থিতিতে। বিচারিক আদালতের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি রায়, উচ্চ আদালতের জামিন, রিটের আদেশ, রুল এবং সুপ্রিমকোর্টের রায় বছরজুড়ে আলোচনায় রেখেছে বিচার বিভাগকে। আলোচিত রায়ের মধ্যে বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার হত্যা মামলা, সাভারে ৬ শিক্ষার্থী হত্যা মামলা এবং নোয়াখালীতে গৃহবধূকে বিবস্ত্র করে নির্যাতন মামলার রায়। দÐিত আসামি কুলসুমীর পরিবর্তে নিরীহ মিনু আরার কারাভোগের ঘটনায় নির্দেশনা, দুই কন্যা সন্তানের জিম্মাদারী চেয়ে জাপানি জননী এরিকো-ইমরান শরীফের আইনি লড়াই, সন্তানের জিম্মাদারী চেয়ে ভারতীয় মায়ের আইনি লড়াই, ২০ সচিবের বিরুদ্ধে রিট, আলোচিত ফোনালাপ ফাঁসের রিটসহ বেশ কয়েকটি ঘটনা হাইকোর্টকে আলোচনায় রেখেছে। বছরের শেষদিকে আপিল নিষ্পত্তির আগেই মো: আব্দুল মোকিম ও গোলাম রসূল ঝড়–র মৃত্যুদÐ কার্যকর হওয়ার অভিযোগ আলোচনায় রাখে সুপ্রিম কোর্টকে। এছাড়া সুপ্রিম কোর্ট বারের সভাপতি অ্যাডভোকেট আব্দুল মতিন খসরুসহ কয়েকজন সিনিয়র আইনজীবীর করোনাজনিত ইন্তেকালে বেশ ক’জন কৃতি আইনজীবীকে হারায় সুপ্রিম কোর্ট বার। হাইকোর্ট হারায় একজন বিচারপতিকে। বিচারিক আদালতও এক বছরে হারায় একাধিক বিচারককে। সভাপতির শূন্যপদ পূরণ নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট বারে সরকারপন্থি এবং সরকার বিরোধী আইনজীবীরা মুখোমুখি অবস্থান উত্তাপ ছড়ায়।

বুয়েটের মেধাবী শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যার মামলায় ২০ বুয়েট শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগ নেতার মৃত্যুদÐ দেন বিচারিক আদালত। গত ৮ ডিসেম্বর দেয়া এই রায়ে একসঙ্গে এতোগুলো মেধাবী শিক্ষার্থীর মৃত্যুদÐ প্রদানের ঘটনা প্রথম। ঢাকার দ্রæত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক আবু জাফর মো. কামরুজ্জামানের আদালত এ রায় দেন। আবরার হত্যাকাÐের মতো যাতে আর কোনো ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধকল্পে দৃষ্টান্তমূলক এ রায় দেয়া হয়েছেÑ মর্মে উল্লেখ করা হয় এ রায়ে।
২০১১ সালের ১৭ জুলাই শবে বরাতের রাতে ডাকাত আখ্যা দিয়ে ৬ শিক্ষার্থীকে পিটিয়ে হত্যার মামলার রায় হয় ২ নভেম্বর। ঘটনার এক দশক পর ঘোষিত আলোচিত এ মামলায় ১৩ জনকে মৃত্যুদÐ দেয়া হয়। ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক ইসমত জাহান এ রায় দেন।

নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে গৃহবধূকে বিবস্ত্র করে নির্যাতন মামলার রায় ঘোষিত হয় বছরের শেষদিকে ১৪ ডিসেম্বর। এ মামলায় চার্জশিটভুক্ত ১৩ আসামির ১০ বছর করে কারাদÐ হয়। নোয়াখালীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১-এর বিচারক জয়নাল আবেদীন এ রায় দেন। তবে এ রায়ে ভুক্তভোগী এবং আসামিপক্ষ উভয়েই অসন্তোষ প্রকাশ করে। ২০২০ সালের ২ সেপ্টেম্বর রাতে গৃহবধূকে বিবস্ত্র করে নির্যাতন এবং ভিডিউ করে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেয়ার ঘটনা ঘটে। মামলা দায়েরের ১৫ মাসের মাথায় এ রায় ঘোষিত হয়।

হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত কুলসুম আক্তার কুলসুমীর পরিবর্তে ৩ বছর ধরে কারাভোগ করছিলেন দরিদ্র মিনু আরা। কারাগারের রেকর্ডপত্র ঘাটতে গিয়ে বিষয়টি কারারক্ষীদের দৃষ্টিগোচর হয়। বিষয়টি উচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়ালে মামলার রেকর্ডপত্র তলব করেন। ঘটনার সত্যতা মেলায় হাইকোর্ট ১৬ জুন চট্টগ্রামের মিনু আরাকে কারামুক্তির নির্দেশ দেন। কিন্তু কারামুক্তির ১২ দিনের মাথায় মিনু আরা চট্টগ্রামের বায়েজিদ বোস্তামি এলাকায় এক ‘রহস্যজনক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন। পরবর্তীতে গত ১৬ আগস্ট মিনু আরার ময়না তদন্ত প্রতিবেদন এবং সুরতহাল রিপোর্ট তলব করেন হাইকোর্ট।

হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামির পরিবর্তে সাজা ভোগ করেন নিরপরাধ মিনু। কারামুক্তির পর ‘সড়ক দুর্ঘটনায়’ নিহত হন তিনি। সেই মিনুর ময়না তদন্ত প্রতিবেদন ও সুরতহাল রিপোর্ট তলব করেছেন হাইকোর্ট।

২০১৩ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত আলোচিত ১৬টি ফোনালাপ ফাঁসের ঘটনা উল্লেখ করে টেলিফোনে আড়িপাতা বন্ধে একটি রিট হয়। সুপ্রিম কোর্ট বারের ১০ আইনজীবীর পক্ষে অ্যাডভোকেট মুহাম্মদ শিশির মনির রিটটি করেন। শুনানি শেষে বিচারপতি এম.ইনায়েতুর রহিম এবং বিচারপতি মো: মোস্তাফিজুর রহমানের ডিভিশন বেঞ্চ রিটটি খারিজ করে দেন।

ঢাকার শান্তিবাগের বাসিন্দা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী একরামুল আহসান কাঞ্চনের বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন জেলায় নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, চুরি, ডাকাতি, মানব পাচারসহ বিভিন্ন অভিযোগে ৪৯টি মামলা হয়। ঘটনার প্রতিকার চেয়ে হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন কাঞ্চন। আদালত ঘটনা তদন্তে পুলিশের সিআইডিকে দায়িত্ব দেন। মামলাগুলোর নেপথে রাজারবাগ দরবার শরীফের অনুসারী ব্যক্তিরা জড়িত-মর্মে প্রতিবেদন দেয় সিআইডি। পরবর্তীতে মিথ্যা মামলা দায়েরে জড়িত ব্যক্তি এবং রাজারবাগ দরবারের পীরের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)সহ কয়েকটি সংস্থাকে তদন্তের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট।

মামলা রুজুর ক্ষেত্রে আসামির বয়স নিশ্চিত হতে জন্মসনদ যাচাই করে এজাহার নিতে পুলিশকে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। ২০২১ সালের ১৭ জুন বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেন এবং বিচারপতি খিজির হায়াতের ডিভিশন বেঞ্চ এ নির্দেশনা দেন। ভুয়া মামলা দায়ের এবং আসামি শনাক্তে হাইকোর্টের এ নির্দেশনাকে ‘গুরুত্বপূর্ণ’ বলে মন্তব্য করেন।

বছরের শুরুতে ১ ফেব্রæয়ারি কাতারভিত্তিক টিভি চ্যানেল ‘আল-জাজিরা’য় ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টার্স মেন’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রচারিত হয়। প্রতিবেদনটি দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করে। এ প্রতিবেদন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম থেকে প্রত্যাহারের নির্দেশনা চেয়ে রিট করা হয় ফেব্রæয়ারিতে। শুনানি শেষে বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া এবং বিচারপতি মো. কামরুল হোসেন মোল্লার ডিভিশন বেঞ্চ ১৭ ফেব্রæয়ারি ইউটিউবসহ সকল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে প্রতিবেদনটি সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দেন।

দুই কন্যা সন্তানের জিম্মাদারী চেয়ে জাপানি জননী ডা: এরিকো নাকানো বাংলাদেশের উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হন। সন্তান দু’টি পিতা বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত মার্কিন নাগরিক শরীফ ইমরান। ২০০৮ সালে জাপানি চিকিৎসক নাকানো এরিকো ও বাংলাদেশি-আমেরিকান নাগরিক শরীফ ইমরান (৫৮) জাপানি আইন অনুযায়ী বিয়ে করে টোকিওতে বসবাস করছিলেন। তাদের ১২ বছরের সংসারে তিন কন্যাসন্তান জন্ম নেয়। তারা তিনজনই টোকিওর চফো সিটিতে অবস্থিত আমেরিকান স্কুল ইন জাপানের শিক্ষার্থী। ২০২১ সালের ১৮ জানুয়ারি শরীফ ইমরান-এরিকোর বিবাহবিচ্ছেদ হয়। ২১ জানুয়ারি ইমরান আমেরিকান স্কুল ইন জাপান কর্তৃপক্ষের কাছে তার মেয়ে জেসমিন মালিকাকে নিয়ে যাওয়ার আবেদন করেন। কিন্তু এতে এরিকোর সম্মতি না থাকায় স্কুল কর্তৃপক্ষ ইমরানের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। শরীফ ইমরান দুই সন্তানকে নিয়ে বাংলাদেশে চলে এলে মা এরিকো নাকানো বাংলাদেশে উচ্চ আদালতে আইনগত প্রতিকার চান। ২০২১ সালের ফেব্রæয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত হাইকোর্টের একটি ডিভিশন বেঞ্চকে ব্যস্ত থাকতে হয় দুই সন্তানের জিম্মাদারী নিয়ে।

আপিল নিষ্পত্তির আগেই চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গার আব্দুল মোকিম এবং গোলাম রসূল ঝড়–কে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদÐ কার্যকরের অভিযোগ ওঠে নভেম্বর মাসে। মোকিম ও ঝড়–র আইনজীবী হুমায়ুন কবির এ অভিযোগ তোলেন। তিনি জানান, যশোর কারাগারে ২০১৭ সালের ১৬ নভেম্বর মোকিম ও ঝড়–র ফাঁসি কার্যকর করা হয়। কিন্তু হাইকোর্ট ফাঁসির আদেশ দিলে এর বিরুদ্ধে ২০১৩ সালে আপিল করা হয়েছিল। সেই আপিল শুনানির জন্য আপিল বিভাগের কার্যতালিকায় উঠলে আসামিপক্ষের কৌঁসুলি মৃত্যুদÐ কার্যকরের তথ্য দেন। তবে রেকর্ডপত্র পর্যালোচনা করে আদালত জানান, ওই আপিলের শুনানি হয়েছে। আসামিরা প্রেসিডেন্টের কাছে জীবনভিক্ষাও চেয়েছেন। সেই আবেদন নাকচ করে হওয়ার পরই তাদের দÐাদেশ কার্যকর করা হয়। পরে আদালত কার্যতালিকায় ওঠা আপিলটি ‘অকার্যকর’ ঘোষণা করেন।

শিক্ষাঙ্গন এবং কর্মক্ষেত্রে নারী-শিশুদের যৌনহয়রানি প্রতিরোধে হাইকোর্টের নির্দেশনা বাস্তবায়ন না করায় জনপ্রশাসন সচিবসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ৪০ সচিবের বরুদ্ধে রিট করা হয় ২ নভেম্বর। একসঙ্গে নির্বাহী বিভাগের এতোজন শীর্ষ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এ রিট আলোচনার জন্ম দেয়। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পক্ষে ২ নভেম্বর এ রিট করা হয়।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন