করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় বছর ২০২১ সালে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের তাÐবে জনজীবনে এসেছে স্থবিরতা। দেশের দুর্নীতিবিরোধী একমাত্র রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান দুর্নীতি দমন কমিশনেও (দুদক)র স্থবিরতাও যেন করোনার সঙ্গে সম্পর্কিত। যদিও করোনা বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে দেশে বেড়েছিল দুর্নীতির সংক্রমণও। কিন্তু সেই হিসেবে দুর্নীতিবাজদের শরীরে দুর্নীতিবিরোধী কোনো ‘ভ্যাকসিন’ প্রয়োগ করতে পারেনি দুদক। তুলনামূলক হিসেবে ২০২০ সালের চেয়ে ২০২১ সালে দুর্নীতির অভিযোগ জমা পড়েছে কম। কিন্তু তুলনামূলক মামলা দায়ের এবং চার্জশিট দাখিল হয়েছে বেশি। কিন্তু এসব মামলায় আলোচিত কোনো দুর্নীতিবাজকে শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়নি।
চেয়ারম্যানের পদ থেকে বিতর্কিত আমলা ইকবাল মাহমুদের বিদায় ছিলো ২০২১ সালে দুদকের জন্য স্বস্তির ঘটনা। তবে নতুন চেয়ারম্যান ও একজন কমিশনারের যোগদান বিদায়ী বছর জন্ম দিয়েছে নতুন কিছু প্রত্যাশার। করোনা প্রাদুর্ভাবের দ্বিতীয় বছরে অনিয়ম ও দুর্নীতির নতুন মাত্রা পরিলক্ষিত হয়। ফলে প্রতিক‚ল পরিবেশের মধ্যেই কয়েকটি সাঁড়াশি অভিযান, অনুসন্ধান ও তদন্তে নামতে দেখা গেছে সংস্থাটিকে।
বিদায়ী বছর নভেম্বর পর্যন্ত দুদকে ১২ হাজারেরও বেশি অভিযোগ জমা পড়ে। আগের বছর ২০২০ সালে জমা পড়ে ১৮ হাজার ৪৮৯টি। এ হিসেবে গত বছরের তুলনায় এবার অভিযোগ জমা পড়েছে কম। ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ১১ মাসে প্রায় সাড়ে ১২ হাজার অভিযোগ জমা পড়ে। অক্টোবর শেষে এ সংখ্যা ছিল ১১ হাজার ৮২৮টি। গত বছরের তুলনায় বিদায়ী বছর অভিযোগ জমা হ্রাস পেয়েছে ৩৫ ভাগ।
পাঁচ বছর মেয়াদ পূর্ণ হওয়ায় বিদায়ী বছর ১০ মার্চ চেয়ারম্যানের পদ থেকে বিদায় নেন বিতর্কিত আমলা ইকবাল মাহমুদ ও কমিশনার এ এফ এম আমিনুল ইসলাম। চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পান মঈনউদ্দিন আবদুল্লাহ, কমিশনার (তদন্ত) হন জহুরুল হক। কমিশনের পঞ্চম চেয়ারম্যান হিসেবে ইকবাল মাহমুদ যতটা হতাশার জন্ম দিয়েছিলেন ততোটাই প্রত্যাশার জন্ম দিয়েছেন ৬ষ্ঠ চেয়ারম্যান হিসেবে সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আব্দুল্লাহ ও কমিশনার মো. জহুরুল হকের যোগদান।
২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ৩২৬টি অভিযোগের অনুসন্ধান করে দুদক। এ সময়ে ২৪৪টি অভিযোগের পরিসমাপ্তি বা ‘নথিভুক্তি’ (অভিযোগ থেকে অব্যাহতি) হয়। অবৈধ সম্পদের প্রমাণ পাওয়ায় দুদক সম্পদের নোটিশ জারি করে ১৯৩টি। অনুসন্ধান শেষে অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় ৩১১টি মামলা দায়ের করে। সেই সঙ্গে ২২২টি মামলার চার্জশিটও দাখিল করে। গত বছরের তুলনায় মামলা ও চার্জশিটের হার বেড়েছে যথাক্রমে ২০ ও ৩৪ ভাগ। চলতি বছর দুদক এফআরটি (মামলা থেকে অব্যাহতি) দেয়া হয়েছে ৮০টি। আগের বছর জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ৫২৩টি অভিযোগ অনুসন্ধান এবং ২৫৯টি মামলা করা হয়। চার্জশিট দাখিল করা হয় ১৬৬টি মামলার।
বিদায়ী বছর দায়ের করা হয় বেশ কয়েকটি আলোচিত মামলা। এর মধ্যে ক্যাসিনো অভিযানের ধারাবাহিকতায় এনআরবি গেøাবাল ব্যাংক ও রিলায়েন্স ফাইন্যান্স লিমিটেডের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রশান্ত কুমার হালদারের (পিকে হালদার) বিরুদ্ধে ৩ হাজার ৬শ’ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ৩ দফায় ২৩টি মামলা দায়ের করে দুদক।
পি কে হালদার ও তার ২৯ সহযোগীর বিরুদ্ধে ২শ’ ৩০ কোটি টাকা লুটপাটের অভিযোগে চলতি বছরের নভেম্বর মাসে ৭টি মামলা হয়। ৪২৬ কোটি টাকার জ্ঞাত আয়-বহিভর্‚ত সম্পদ অর্জন ও বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে অন্তত ৬ হাজার ৮০ কোটি টাকা লেনদেনের অভিযোগে পি কে হালদারসহ ১৪ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয় সংস্থাটি।
ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকে অন্তত ৮শ’ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাতের দায়ে ৩৭ জনের বিরুদ্ধে ১০টি মামলা এবং ৩৫০ কোটি ৯৯ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ৩৩ শীর্ষ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে পৃথক ৫টি মামলা করা হয়। এসব মামলায় ১১ জনকে গ্রেফতার করা হয়।
এমপি পদ হারানো লক্ষèীপুরের সাবেক এমপি কাজী শহিদ ইসলাম পাপুল, স্ত্রী সেলিনা ইসলাম এমপি, শ্যালিকা জেসমিন প্রধান এবং মেয়ে ওয়াফা ইসলামের বিরুদ্ধে ২০২০ সালে মামলা করে দুদক। কিন্তু এক বছরেও এ মামলার কোনো প্রতিবেদন দাখিল করতে পারেনি সংস্থাটি।
তাদের বিরুদ্ধে ২ কোটি ৩১ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং ১৪৮ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ আনা হয়। ওই বছরের ২৩ ডিসেম্বর তাদের নামে থাকা ৬১৩টি ব্যাংক হিসাব আদালতের অনুমতি নিয়ে ফ্রিজ বা অবরুদ্ধ করা হয়।
ক্যাসিনোসহ বিভিন্ন অবৈধ ব্যবসায় জড়িতদের বিরুদ্ধে দুদকের সাঁড়াশি অভিযান হিসেবে যুবলীগ দক্ষিণের বহিষ্কৃত সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী সম্রাটসহ বর্তমান জাতীয় সংসদের চার এমপি, গণপূর্তের শীর্ষ কর্মকর্তাসহ অন্তত ২শ’ জনের তালিকা নিয়ে সংস্থাটির অনুসন্ধান ও তদন্ত চালায়। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে শুরু হওয়া অনুসন্ধানে ভাটা পড়ে ২০২১ সালে।
দুই বছর অতিক্রান্ত হলেও তালিকার অন্তত ৯০ ভাগের বিরুদ্ধে এখনও মামলা কিংবা চার্জশিট দাখিল করতে পারেনি সংস্থাটি। অধিকাংশ আসামি রয়ে গেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।
গণপূর্ত অধিদফতরের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলীসহ শীর্ষ পদে থাকা ১৩ প্রকৌশলীকে অভিযোগে থেকে অব্যাহতি বা দায়মুক্তি দেয়ার অভিযোগ রয়েছে দুদকের বিরুদ্ধে।
ক্যাসিনোকাÐে গ্রেফতার হওয়া ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের বহিষ্কৃত সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট ও জি কে শামীমসহ ২৪ জনের বিরুদ্ধে ২৩টি মামলা করে দুদক। এর মধ্যে ১২ মামলার চার্জশিট দেয়া হয়েছে। অভিযোগ সংশ্লিষ্ট ২৪ আসামির ৫শ’ ৮২ কোটি টাকার সম্পদ জব্দ করেছে দুদক। তবে তালিকায় থাকা ৫ এমপি’র বিষয়ে এক বছরেও কোনো সিদ্ধান্ত দেয়নি প্রতিষ্ঠানটি।
সাড়ে ৩শ’ কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পর অনলাইনে পণ্য কেনাবেচার প্রতিষ্ঠান ইভ্যালির বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। চলতি বছরের ৯ জুলাই দুদকের অনুসন্ধান টিমের সুপারিশের ভিত্তিতে ইভ্যালির চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিন ও এমডি মো. রাসেলের দেশত্যাগের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়। কিন্তু অনুসন্ধান শুরুর ৪ মাস পর দুদক জানায়, ইভ্যালির অভিযোগ দুদকের তফসিলভুক্ত নয়। প্রতিষ্ঠানটির মানিলন্ডারিংসহ অন্যান্য অপরাধের বিষয়টি দেখবে পুলিশের সিআইডি।
মুজিববর্ষে প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্নের আশ্রয়ন প্রকল্পে নির্মিত ঘরের মান নিয়ে ওঠে দুর্নীতির অভিযোগ। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে গঠিত তদন্ত কমিটি এখন পর্যন্ত ২২ জেলার ৩৬ উপজেলায় ঘর তৈরিতে অনিয়মের অভিযোগের প্রমাণ পায়। এ দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের অধিকাংশই প্রশাসন ক্যাডারের। এ কারণে আলোচিত এ দুর্নীতির বিষয়ে দুদক কোনো অনুসন্ধান শুরু করেনি বলে অভিযোগ রয়েছে দুদকের বিরুদ্ধে।
তবে বিদায়ী বছরের শুরুর দিকে হেফাজতে ইসলামীর শীর্ষ ৫৪ নেতার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। এসব নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা সংগঠনের তহবিল, বিভিন্ন মাদরাসা, এতিমখানা ও ইসলামি প্রতিষ্ঠানের অর্থ এবং ধর্মীয় কাজে দেশে আসা বৈদেশিক সহায়তা আত্মসাৎ বা স্থানান্তর করেছেন। হেফাজতের তৎকালীন আমীর (মরহুম) জুনায়েদ বাবুনগরী, নূর হুসাইন কাসেমী, মামুনুল হকসহ ৫৪ নেতার বিরুদ্ধে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত এখন যাচাই করছে সংস্থাটি।
দুদকের অনেক কর্মকাÐের বিষয়ে ঊষ্মা প্রকাশ করে দেশের উচ্চ আদালত। অনুসন্ধান-তদন্তে বিলম্ব, অনুসন্ধান পর্যায়ে অভিযোগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির পাসপোর্ট জব্দ, আদালতের অনুমোদন ছাড়া নিষেধাজ্ঞা প্রদান, ভুল অনুসন্ধান-তদন্ত, দুদক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ওঠা ঘুষ দাবি ও দুর্নীতির ইস্যুতে আদালত কঠোর ভাষায় উষ্মা প্রকাশ করেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন