সবকিছুর মালিক আল্লাহ। তাঁর ইচ্ছা, হুকুম ও নিয়ন্ত্রণের বাইরে কোনো কিছুই হয় না। সৃষ্টি ও প্রকৃতিতে তাঁরই হুকুম চলে। ‘আলা লাহুল খালকু ওয়াল আমর’। এ হলো সৃষ্টিগত বা প্রাকৃতিক বিধান। যার ব্যতিক্রম করার এখতিয়ার বা সুযোগ কারো নেই। যেমন চন্দ্র, সূর্য, বৃক্ষ, লতা, পাহাড়, পর্বত, নদী-নালা, জীবজগতের জীবন-মরণ, ক্ষুধা, তৃষ্ণা, প্রকৃতির শীত, গ্রীষ্ম ইত্যাদি। এসব আল্লাহ পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করেন। মুদাব্বিরুল আমর ও মুদরিকুহু। যেমন কুরআনে বলেছেন, (ভাবানুবাদ) ‘পাখিরা আকাশে ওড়ে, বল তো কে তাদের শূন্যে ভাসিয়ে রাখে? অন্যত্র বলেছেন, যে খাদ্য, ফল ও ফসল জমিনে উৎপন্ন হয় তা কি তোমরা সৃষ্টি করো না আমি করি? (তোমরা হয়তো বীজ বপন করো, আর বাকি সব কাজই তো আমার)’ এসব তিনি করেন মিকাইল নামক ফেরেশতার ব্যবস্থাপনায়। জলবায়ু, বৃষ্টিবর্ষণ, ভূভাগের বিবর্তন ও রিজিকের এ জগতে তাঁর বহু সৈনিক, বহু কর্মী। আল্লাহ কুরআনে বলেছেন, (ভাবানুবাদ) আমার যে কত সৈনিক তা আমি ছাড়া আর কেউই জানে না। এ জগতে কেউই তাঁর অবাধ্য হতে পারে না। চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র, পৃথিবী ও প্রকৃতি কেউই নয়।
তবে নীতিগত ও ব্যবহারিক যে বিধান মানুষকে তিনি দিয়েছেন, তার নাম দ্বীন ও শরিয়ত। তা মানা না মানার এখতিয়ার বা সুযোগ মানুষকে তিনি দিয়েছেন। দিয়েছেন জরুরি হেদায়েত ও বুদ্ধি-বিবেক। এ জন্যই মানুষের বিচার হবে। মানুষের জীবনেও দেখা যায় ন্যায়ের পক্ষ হেরে গেছে, অন্যায় জয়ী হয়েছে। ভালোর ক্ষতি হলো, মন্দের জয় হলো। এ বিষয়টি আপেক্ষিক। কারণ, কে ভালো, কে মন্দ তা মানুষ নির্ভুলভাবে সিদ্ধান্ত দিতে সক্ষম নয়। কোনটা ন্যায় কোনটা অন্যায় এ সিদ্ধান্তও মানুষের কাছে সর্বাংশে নিখুঁত নয়। (কেবল ওহির দ্বারাই শতভাগ নিশ্চিত সত্য, ভালো ও ন্যায় খুঁজে পাওয়া সম্ভব।)
কেউ নিজেকে ন্যায়ের পথে মনে করে চেষ্টা করেও সফলতা পায় না। যদি সে সত্যি সত্যিই ন্যায়ের পথে হয়ে থাকে তা হলেই যে তার কাক্সিক্ষত জয় পেতেই হবে সেটিও কিন্তু সবসময় সত্য নয়। কেননা, এ দুনিয়া পরীক্ষা ও দৃষ্টান্তের জায়গা। এ হচ্ছে শিক্ষা, অভিজ্ঞতা ও উপদেশ গ্রহণ করে শোধরানোর জায়গা। পুণ্য কাজের বিনিময় পাওয়ার জায়গা নয়। সুকর্মের চ‚ড়ান্ত ফল প্রাপ্তির জায়গা নয়। ন্যায়ের প্রতিফল পাওয়ার জায়গা এ দুনিয়া নয়। এ জন্যই কেউ বলেছেন, ‘শত্রুরে ভরপুর করো তুমি বন্ধুরে কাঁদাও’ ইত্যাদি। আল্লাহর ওপর একজন ঈমানদারের বিশ্বাস এই যে, তিনি কখনো তাঁর বান্দার অমঙ্গল করেন না। যদি কোনো প্রিয় বান্দাকে তিনি ফেলে দেন, তা হলে তাকে আশু বড় কোনো বিপদের হাত থেকে রক্ষার জন্যই ফেলে দেন। তিনি কাউকে কাঁদালে, বড় ও স্থায়ী কোনো মহা কান্নার হাত থেকে রক্ষার জন্যই কাঁদান। বড় কোনো প্রসন্নতার জন্য তৈরি করতেই কাঁদান।
মানুষের কাজকর্ম যেমন সভ্যতা ও রাষ্ট্রের শৃঙ্খলায় সংঘটিত হয়। শরিয়তের বিধান বা সংগ্রাম যেমন বিভিন্ন পদবি ও পরিচয়ের ব্যক্তি দিয়ে সংঘটিত হয়, তেমনি প্রকৃতিগত বিবর্তনও বিশেষ খোদায়ী শৃঙ্খলায় সংঘটিত হয়। এ জগতেও রয়েছে বহু পদ, পদবি, বদলি, নিয়োগ, বরখাস্ত। পাহাড় ধস, ভ‚মিকম্প, নদীভাঙন, মরুকরণ, জলবায়ু ইত্যাদি বিষয়েও খোদায়ী পরিকল্পনা তদারকে নিযুক্ত আছেন আধ্যাত্মিক কর্মকর্তা। রয়েছেন মানুষের মনোভাব ও প্রবণতা নিয়ন্ত্রণের লোক। আছেন অভ্যুত্থান, বিপ্লব ও ষড়যন্ত্র বিষয়ে প্রভাববিস্তারী লোক। মানব জাতির দীর্ঘ ভ্রমণ, সভ্যতার উত্থান-পতন, জাতিসমূহের বিকাশ ও অধঃপতনে এসব কর্মীর নেপথ্য দায়িত্ব পালন ইতিহাসে ভরপুর। ইসলামের ইতিহাসও এ সংশ্লিষ্ট অধ্যায়ে সমৃদ্ধ। আধ্যাত্মিক জগতের এ রহস্যঘেরা পর্বটি নিয়ে আধুনিক যুগের মানুষদেরও আবার নতুন করে ভাবতে হবে। কেননা, বিশ্বে আগামী দিনের পরিবর্তনগুলো হবে আধ্যাত্মিক। পারমাণবিক উত্তেজনা, বস্তুবাদী বিরোধ বা উন্নত সময়ের যুদ্ধ শেষ হবে আধ্যাত্মিকতার মায়াবি স্পর্শে। বিশ্বাস, ভরসা, করুণা ও ঐশি আশিসের প্রত্যক্ষ পরশে।
বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার আর কতদিন ক্ষমতায় থাকবে, এ প্রশ্নটির আধ্যাত্মিক জবাব কী হতে পারে? প্রথমত এ জিজ্ঞাসার জবাব নেত্রী নিজেই বহু আগে সংসদে দাঁড়িয়ে দিয়ে রেখেছেন। সবসময় তিনি এ কথার পুনরাবৃত্তিও করে থাকেন। আল্লাহ ছাড়া তিনি কাউকে ভয় পান না। অতীতে বহুবার তাকে মেরে ফেলার চেষ্টা করা হলেও আল্লাহই তাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। তিনি প্রয়োজনে নিজের পিতা ও পরিবারের মতো জীবন দিয়ে হলেও দেশ ও জনগণের সেবা করে যাবেন। একবার তিনি সংসদের বক্তৃতায় কুরআন শরিফের ওই আয়াতটি পড়ে বলেছিলেন, (ভাবানুবাদ) ‘হে নবী আপনি বলুন, হে আল্লাহ ক্ষমতা ও সা¤্রাজ্যের মালিক, আপনি যাকে ইচ্ছা তা দান করেন, যার কাছ থেকে ইচ্ছা কেড়ে নেন, যাকে ইচ্ছা সম্মান ও প্রতিষ্ঠা দেন, আর যাকে চান পতন ও লাঞ্ছনা দেন, আপনার হাতেই সমুদয় কল্যাণ, আপনিই সর্বশক্তিমান।’ আল কুরআন ৩ : ২৬। সুতরাং মুসলমান মাত্রই বিশ্বাস করতে বাধ্য যে, তার জীবন-মৃত্যু-ভবিষ্যৎ একমাত্র আল্লাহর ইচ্ছার ওপর নির্ভর করছে। আর যতক্ষণ আল্লাহ না চান ততক্ষণ তার হাত থেকে ক্ষমতাও কেউ কেড়ে নিতে পারবে না। এ বিশ্বাস যাদের শক্ত তারা গত ৮-১০ বছর অস্থিরতায় ভোগেননি। যারা প্রধানমন্ত্রীর বিপক্ষে তারা দ্রæত তার ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়ার জন্য অস্থিরতায়, আর যারা তার পক্ষে তারা তার সরকারের পড়ে যাওয়ার ফলে সৃষ্ট ছন্দপতনজনিত অস্থিরতায় সমানভাবে ভুগেছেন। যারা অস্থিরতায় ভুগেছেন আধ্যাত্মিক বিচারে তাদের বিশ্বাসে ত্রুটি আছে। তারা সর্বশক্তিমানের নিয়ন্ত্রিত তকদির বা বিধিলিপিতে পূর্ণ আস্থাশীল নন। যারা প্রকৃত ঈমান, তাওয়াক্কুল, রিজা-বিল-কাজা ওয়াল কাদর, তাফবিজ ইত্যাদিতে দৃঢ়বিশ্বাস রাখেন তাদের জন্য গত ৮-১০ বছর শুধু নয়, তাদের গোটা জীবনকালটিই অস্থিরতাশূন্য ও নিস্তরঙ্গ। স্পন্দিত জীবনের শত ঝঞ্ঝা আর ঘটনাপ্রবাহের সহ¯্র আন্দোলনের অংশী হয়েও তারা আশ্চর্য এক প্রশান্তি ও স্থিরচিত্ততায় নিমগ্ন থাকেন।
যাকে ইচ্ছা করেন আল্লাহই ক্ষমতা ও রাজত্ব দান করেন। যার থেকে চান কেড়ে নেন। এ বিষয়টি কখন ঘটবে, কীভাবে ঘটবে তা সংশ্লিষ্ট মানুষেরা জানে না বলে অস্থির বা উদ্বিগ্ন হয়। কিন্তু যারা তা জানেন তাদের কেমন বোধ হয়? যাদের আল্লাহ এসব সিদ্ধান্ত আগেভাগে জানিয়ে দেন, এসব জেনে তাদের কেমন লাগে? অবশ্য এসব আগে কেউ জানতে পারে কিনা বা জানলে তারা কেমন অনুভব করেন এ প্রশ্নের উত্তর সাধারণ মানুষের সামনে সবসময়ই এক ধরনের ধাঁধাঁ হয়েই রয়ে গেছে। ইতিহাসের একটি ঘটনা বললে বিষয়টি বুঝতে আরো সহজ হতে পারে। মোঘল আমলে দক্ষিণের একটি রাজ্য দীর্ঘ দিন সেনাভিযানের পরও বিজিত হচ্ছিল না। বিজয়ে অস্বাভাবিক দেরী ও শক্তিশালী মোঘলবাহিনীর অবিশ্বাস্য ব্যর্থতা দেখে স্বয়ং বাদশাহ আলমগীর গেলেন অভিযানস্থলে। এক রাতে সৈন্যশিবিরে প্রবল ঝড় উঠল। সব ছাউনি উপরে শিবির লন্ডভন্ড। ঝড়ের একটু আগেই সেনাদের অবস্থা দেখার জন্য ছদ্মবেশে শাহী তাঁবু থেকে শিবিরে ঢুকেছিলেন বাদশাহ। ঝড় শুরু হলে তিনি ফিরে আসতে লাগলেন। সারা শিবির যখন তছনছ তখন একটি তাঁবুর অকম্প দৃঢ়তা দেখে তিনি একমুহূর্ত দাঁড়ালেন। ভেতরে উঁকি দিয়ে যা দেখলেন তা বিশ্বাস করার মতো নয়। একজন কর্মকর্তা পর্যায়ের সৈনিক মোমের আলোয় আল্লাহর কালাম পাঠ করছেন। না তার ঝড়ের খবর আছে আর না তার তাঁবুতে কোনো বাতাস লাগছে। এমনকি প্রচন্ড ঝড়ের রাতেও তার মোমের আলো নিষ্কম্প প্রভা বিকীরণ করছে অদ্ভুত সহজতায়। বাদশাহ আলমগীর কোনো শব্দ না করে ফিরে এলেন। বাকি রাত তার কেটে গেল আধা বিশ্রাম আধা ইবাদতে। ভোরে ডেকে পাঠালেন সেই সৈনিককে। একেবারে একা তাকে কাছে বসিয়ে সরাসরি জানতে চাইলেন, ‘আপনার মতো মানুষ এ বাহিনীতে থাকার পরেও এতটা বছর কেন লাগছে এই রাজ্যটি জয় করতে?’ পাঠক, এ সৈনিকটি ছিলেন একজন ছদ্মবেশী ‘আবদাল’। যিনি সৈনিকের চাকরি নিয়ে মানুষের সমাজে থাকলেও মূলত তিনি আল্লাহর সৃষ্টি ও নিয়ন্ত্রণ বিভাগের লোক। আল্লাহর ইচ্ছা ও সিদ্ধান্ত যারা সাধারণ মানুষের আগে জানতে, বুঝতে ও দেখতে পারেন। সৈনিকটি কথা না বাড়িয়ে বললেন, ‘আজই খোঁজ নিয়ে জানাবো জাহাঁপনা’। শেষে অনুরোধ করে বললেন, ‘জাহাঁপনা আপনি যা জেনেছেন তা অন্তত এখানকার দায়িত্ব শেষে আমি অন্য কোনো জায়গায় চলে যাওয়া পর্যন্ত আর কাউকে জানাবেন না’। বাদশাহ মৃদু হেসে বুকে বুক মিলিয়ে তাকে বিদায় জানালেন।
কিতাবে পাওয়া যায়, এই কর্মকর্তা সৈনিকটিকে পরের দিন আর শিবিরে দেখা গেল না। পাশের নির্জন বনভ‚মিতে তিনি হারিয়ে গেলেন। যখন ফিরলেন তখন তার মুখে উৎকণ্ঠার ভাব। তিনি একজন গুপ্তচরকে ডেকে তার হাতে হরিণের চামড়ায় লেখা দু’লাইনের একটি পত্র দিয়ে বললেন, ‘গলকুন্ডা বীজাপুর গিয়ে রাজপ্রাসাদের নিকটতম মোড় পর্যন্ত চলে যাবে। দেখবে একজন চর্মকার রাস্তার পাশে তার দোকান বিছিয়ে বসা। লোকেদের জুতা মেরামত ও কালি করছে। তাকে এ পত্রটি দিয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করবে। সে যে উত্তর লিখে দেয় তা নিয়ে সাবধানে ফিরে আসবে।’ যথাসময় গুপ্তচর খালি হাতে ফিরে এল। বলল, ‘সেই মুচিকে আমি তার দোকানেই পেয়েছিলাম। চিঠিটি তার হাতে দিতেই সে তা খুলে পড়ল। কোনো উত্তর লেখা বা কথা বলা কোনোটাই করল না। এক নিমেষেই সে তার তল্পিতল্পা গুটিয়ে শহর ছেড়ে দূরে কোথাও ছুটতে ছুটতে চলে গেল। আমি অনেকক্ষণ অনুসরণ করেও আর তার দেখা পেলাম না। এরপর সোজা ফিরে এলাম।’ সৈনিক বললেন, ‘ও কি কিছুই বলেনি?’ গুপ্তচর তখন বলল, ‘পত্র পাঠের পর থেকে আপন মনে সে ফার্সি ভাষায় একটি কথা বলে যাচ্ছিল। (বাংলায় যার অর্থ দাঁড়ায়) সেটা তো আমার জানা ছিল না। সেটা তো আমার জানা ছিল না।’ সৈনিকের চেহারায় তখন স্বস্তির চিহ্ন। উৎকণ্ঠা ভাব কেটে গেছে। একটু পরই তিনি বাদশাহর তাঁবুতে গেলেন। একান্তে বললেন, ‘আপনার নির্ধারিত রাজধানীযাত্রা শুরু করুন। আপনার পৌঁছার আগেই সৈন্যাভিযান হবে। আশা করি, পরের জুমায় আপনি দিল্লিতে শোকরানা অনুষ্ঠান করতে পারবেন।’ তাই হলো। একদিনের যুদ্ধে বিনা বাধায় খুব সহজেই পদানত হলো সেই রাজ্য; যা প্রায় ৯ বছর (অন্য হিসেবে ১৬ বছর) বারবার ব্যর্থ অভিযান চালিয়েও মোঘল বাহিনী জয় করতে পারেনি।
যথারীতি রাজধানীতে খবর পৌঁছল। শোকরিয়া অনুষ্ঠান হলো। সাধারণ মানুষ, শাসক শ্রেণি, সেনাবাহিনীসহ সবাই আনন্দিত। বিষয়টিকে সবাই স্বাভাবিক দৃষ্টিতেই নিলো। ভাবল, এতদিন হয়নি, এখন দখল হয়ে গেল। আল্লাহর ইচ্ছা এমনটিই ছিল। এতদিন তিনি চাননি বলেই আগের রাজাকে নামানো যায়নি। এবার আল্লাহ চেয়েছেন বলে তার রাজত্ব কেড়ে নিয়ে বাদশাহ আলমগীরের হাতে তুলে দিয়েছেন। বাহ্যিকভাবে দেখা যায়, মোঘল সৈন্যরা এতদিন সফল হয়নি, এবার হয়েছে। কিন্তু বাদশাহ আলমগীর বিষয়টির গভীরে যেতে চাইলেন। ওই সৈনিকরূপী আবদালকে নিয়ে একান্তে বসলেন। জানতে চাইলেন বিস্তারিত। গুপ্তচর পাঠিয়ে চর্মকারকে মেসেজ দেয়া থেকে বিজয় পর্যন্ত সব ঘটনা তাকে খুলে বললেন আবদাল সৈনিকটি। তিনি বললেন, ‘আমি বিশেষ কলবি ইবাদত, মনসংযোগ ও দিব্যদৃষ্টি (ধ্যান, মোরাকাবা ও কাশফ)-এর মাধ্যমে এ কথা জানতে চেষ্টা করেছি যে, শত চেষ্টা সত্তে¡ও কেন এ রাজ্য জয় করা সম্ভব হচ্ছে না? তখন আমাকে আল্লাহর সৃষ্টিজগতের উত্থান পতন ও বিবর্তন (তাকভীনিয়্যাত) বিষয়ক ব্যবস্থাপনা সূত্র এর রহস্য বলে দেয়। আমাকে জানানো হয়, ওই রাজ্যের অমুসলিম রাজা মৃত্যুকালে ‘হে পরম করুণাময়, তুমি আমার এ এতিম রাজকুমার ও তার রাজত্বের হেফাজত করো। আমি একে তোমার হাতে সঁপে যাচ্ছি’ এই দোয়া করে তার অপ্রাপ্ত বয়স্ক রাজকুমারকে সিংহাসনে বসিয়ে গিয়েছিলেন। আল্লাহর দরবারে এ দোয়া কবুল হয়ে যায় এবং আল্লাহর ইচ্ছা তার সপক্ষে থাকায় শক্তিশালী মোঘল বাহিনী বছরের পর বছর যুদ্ধ করেও রাজ্যটি দখল কিংবা রাজাকে হত্যা করতে পারেনি। এরপর আমি এ অবস্থা পরিবর্তনের কোনো সম্ভাবনা আছে কিনা জানতে চাইলে আমাকে বলা হয়, রাজকুমার যতদিন অপ্রাপ্তবয়স্ক অসহায় ও এতিম ছিলেন ততদিন এ হুকুম বহাল ছিল। বর্তমানে অবশ্য তিনি আর তেমনটি নেই। তিনি এখন পূর্ণ যুবক, অসহায় তো ননই বরং মহাশক্তিধর প্রতিপত্তিশালী, পাশাপাশি প্রজাদের ওপর জুলুমসহ নানা পাপাচারেও যুক্ত হয়ে গেছেন। তবে তার সুরক্ষার বিষয়টি আল্লাহর পক্ষ থেকে সমন্বয় করছেন ওই চর্মকার। তিনি আধ্যাত্মিক শৃঙ্খলা জগতের লোক, ওই রাজ্যের কুতুব। আমি তখন তাকে পত্র দিলাম, এ রাজ্যের সুরক্ষার শর্ত শেষ হওয়ায় তোমার কাজের মেয়াদও শেষ; তাহলে তুমি এখনো স্টেশন ত্যাগ করছ না কেন? কোনো ব্যাখ্যা থাকলে পত্রোত্তরে জানাও। জবাব না থাকলে পত্রপাঠ মাত্র এলাকা ছেড়ে চলে যাও। কুতুব তাই করল। তখন এ খবর পেয়েই আমি আপনাকে বলেছিলাম, ইনশাআল্লাহ এবারের অভিযানে আপনার বাহিনী সফল হবে।’ বাদশাহ আলমগীর সব শুনলেন। সৈনিকটি তখন বললেন, ‘আপনি আমাকে অন্য কোনো পেশায় চলে যাওয়ার অনুমতি দিন। যেখানে আধ্যাত্মিক পরিচয় গোপন করে আমি সাধারণ মানুষের মতো থাকতে পারব। সেনাবাহিনীতে এখন আমার বিষয়টি জানাজানি হয়ে যাওয়ায় আর থাকা চলবে না।’ আলমগীর তাই করলেন। পরবর্তীতে বাদশাহ আলমগীরের ইতিহাস লেখকেরা এ ঘটনাটি বিস্তারিত লিপিবব্ধ করেন।
বাংলাদেশসহ পৃথিবীর সব দেশে ক্ষমতার পরিবর্তন আল্লাহর হুকুমেই হয়। শুধু রাষ্ট্র কেনÑ ব্যক্তি, সমাজ, প্রতিষ্ঠান, পরিবার ও জগৎজুড়ে যত পরিবর্তন, প্রকৃতি ও পরিবেশে যত বিবর্তন সবই তাঁর পূর্বনির্ধারিত সিদ্ধান্ত মোতাবেক হয়। আমরা ঘটনা ঘটার পর জানি। আল্লাহ আগে থেকেই জানেন। তাঁর জানা থেকে প্রয়োজনীয় অংশটুকু তিনি তাঁর নিয়োজিত লোকেদের জানিয়ে থাকেন। এটি কারো মর্যাদা ও প্রতিষ্ঠা পাওয়া কিংবা লাঞ্ছনা ও পতনের ক্ষেত্রেও হয়ে থাকে। এ আধ্যাত্মিক শৃঙ্খলাটুকু তিনি করিয়ে থাকেন গাউস, কুতুব, আবদাল ও আওতাদদের মাধ্যমে। হাদিস শরিফে যাদের কথা এভাবে এসেছে যে, তাদের পদমর্যাদার কিছু লোকই শেষ জমানায় তওয়াফরত অবস্থায় হজরত ইমাম মাহদিকে খুঁজে পাবেন। যাদের দায়িত্ব ও শৃঙ্খলারীতি সারাবিশ্বকে ঘিরে রেখেছে। বাস্তবিকই নিজে কোনো আধ্যাত্মিক ব্যক্তি না হলে এসব কুতুব আবদালকে কেউ চিনতে পারে না। সামাজিক পরিচয় ও পেশার আলোকে তো অবশ্যই চিনে এবং রাতদিন তার সাথে ওঠাবসা করে কিন্তু আধ্যাত্মিক জগতে তার অবস্থান বুঝতে পারে না। বাদশাহ আলমগীর নিজেও একজন আধ্যাত্মিক মহর্ষী ব্যক্তি ছিলেন বলে আবদালের পরিচয় তার সামনে উন্মোচিত হয়েছিল।
আধ্যাত্মিক এসব বিশ্লেষণের উপকার অনেক। এতে মানুষের ঈমান মজবুত হয়। আস্থা ও আত্মবিশ্বাস বাড়ে। সকল ক্ষমতা যে আল্লাহর হাতে তা সে বুঝতে পারে। অবশ্য এর কিছু মন্দ দিকও আছে। যেমন, আধ্যাত্মিকতায় অবিশ্বাসী কিংবা ধর্মীয় বিষয়ে একমুখী শিক্ষিত কোনো কোনো লোক এ ব্যাপারগুলো তেমন গুরুত্ব দিতে চায় না। কারণ, তারা তাকভীনিয়্যাত বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করেনি। আল্লাহর জগত পরিচালনা সংক্রান্ত আধ্যাত্মিক প্রশাসন বিষয়ে তাদের কোনো ধারণাই নেই। তারা এ নিয়ে বিরূপ আলোচনা করে আল্লাহর রহমত থেকে আরো দূরে সরে যায়। আর অন্য একদল লোক বিষয়টি নিয়ে এমন স্থূল ও হালকা আলোচনা শুরু করে দেয় যা বিষয়ের ভাবগাম্ভীর্যকে নষ্ট করে।
যাক, এ নিয়ে ভাবী না। আমার ভয় তাদের নিয়েই, যারা ক্ষমতায় যাওয়ার অথবা ক্ষমতা হারানোর অস্থিরতার রোগে ভীষণভাবে আক্রান্ত। যারা আল্লাহর ক্ষমতা, তাঁর বিধিলিপি, তাঁর সিদ্ধান্ত ও ইচ্ছার বিষয়ে পূর্ণ সচেতন নন। তারা ভাবে, যা তারা চায় সেটাই হবে, যখন চায় তখনই হবে, যেভাবে চায় সেভাবেই হবে। আর যদি তেমন না হয় তাহলে হা-হুতাশ শুরু করে। কপাল ও বুক চাপড়ে বেড়ায়। এরা ভাবে না যে, মানুষের লাখো চাওয়ায় কিছুই হয় না। যদি কখনো কিছু হয় তাহলে তা আল্লাহর ইচ্ছা ছিল বলেই হয়। মানুষের কাজ চেষ্টা করা। চেষ্টার ক্ষেত্রে অবশ্যই নীতি, নৈতিকতা বজায় রাখা সর্বোপরি আল্লাহর ওপর ভরসা রাখা উচিৎ।
অতএব, যারা অস্থিরতায় ভোগেন না, তারা তাদের হৃদয়ে নেমে আসা ঐশি প্রশান্তির অনন্তধারা নিয়ে স্বস্তিতে থাকেন। যা ভাগ্যে নেই তা নিয়ে দৌড়ঝাঁপ না করাই বুদ্ধিমানের কাজ। তবে প্রশ্ন হচ্ছে এই যে, মানুষ তার ভাগ্যে বিষয়টি আছে কিনা তা জানবে কী করে? হাদিস শরিফে এসেছে, ‘আল্লাহ তাঁর ওই বান্দার চেষ্টা সাধনা ও সংগ্রাম দেখে মজা পেয়ে থাকেন (হাদিসের শব্দটি হলো: হেসে থাকেন) যে এমন বস্তুর জন্য জীবনবাজি রেখে লড়ছে বা নানা রকম ছলবল-কৌশল করছে, যা তার ভাগ্যে লেখা নেই।’
কিছু মানুষ হয়তো এমনও পাওয়া যাবে, যারা মোটা দাগে জানতে চাইবেন, প্রধানমন্ত্রীর ভাগ্যে ক্ষমতা কতদিনের জন্য আল্লাহ মঞ্জুর করেছেন? এটা আল্লাহই ভালো জানেন। আমরা কেবল অন্ধের মতো থাকি। ঘটনা বা পরিবর্তন সংঘটিত হওয়ার পরই কেবল বিষয়টি জানতে পারি। ভবিষ্যতের সকল বিষয়ে ঘোর অনিশ্চয়তায় ডুবে থাকাই আমাদের নিয়ম। আর এ জন্যই আমরা বান্দা। আর আল্লাহ আমাদের এক, একক ও অদ্বিতীয় মালিক। মানুষের গোটা জীবনের প্রতিটি মুহূর্তের নিয়মিত অনিশ্চয়তা তাদের এই দাসত্বেরই প্রমাণ। আমরা দাস। তিনি মহাপরাক্রমশালী প্রভু।
লেখক: সাংবাদিক, ধর্ম, রাষ্ট্র ও সমাজতত্ত¡বিদ
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন