প্রায় এক দশক আগে দেশে একটি তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তির উত্থান সম্ভাবনা নিয়ে সরব আলোচনা শুরু হয়েছিল। প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তির উত্থানসম্ভাবনা সম্পর্কে ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় আলোচনাতেই মুখর ছিল। তৃতীয় শক্তির সম্ভাবনা নিয়ে বেশি মুখর ছিলেন হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। পাশাপাশি আরও সরব ছিল বিভিন্ন উপদলে বিভক্ত বামপন্থীরা। এদের মধ্যে ছিলেন আ স ম আব্দুর রব (জাসদ), মোজাহিদুল ইসলাম সেলিম (বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি), মাহমুদুর রহমান মান্না (নাগরিক ঐক্য) প্রমুখ।
তারপর ১০ বছর পার হয়েছে। এখন দেখছি, সেই আলোচনা থিতিয়ে গেছে। টেলিভিশন এবং পত্র পত্রিকাগুলিও তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তি সম্পর্কে নীরব। ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসে বিতর্কিত নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হয়। তখনও এরশাদ জীবিত ছিলেন। তিনি মারা যান ২০১৮ সালের ১৪ জুলাই। এরশাদ জীবদ্দশায় এমনও বলেছিলেন যে, তার দল শুধু শক্তিশালীই হবে না, তারা সরকারও গঠন করতে পারেন। কিন্তু দেখা গেল, তার জীবদ্দশাতেই তার দল জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের লেজুড়বৃত্তি করছে। আজও সেই লেজুড়বৃত্তি অব্যাহত আছে। জনগণের মধ্যে এখন এই ধরনের আলোচনা হয়, দেশে সরকারি দল আওয়ামী লীগ ছাড়া আর তো কোনো দল আছে বলে মনে হয় না।
কেন বিএনপি?
বিএনপি তো থেকেও নেই। ২০১৪ এবং ২০১৮ সালে ভোটে ব্যাপক কারচুপি হলো। কিন্তু বিএনপি প্রতিবাদে সাংবাদিক সম্মেলন করেই খালাস। তাদের সুপ্রিম লিডার বেগম জিয়ার জেল হলো। তারপরেও তো তাদের কোনো নড়া চড়া নেই।
পাল্টা কথা, ‘সেটাইতো আসল সমস্যা। আর তো যাওয়ার জায়গা নেই।
আবার প্রশ্ন, ‘তাহলে ভোট দেবেন কাকে?’
উত্তর, ‘আর যখন কোনো দল নেই, তখন ঘুরেফিরে আওয়ামী লীগ না হয় বিএনপি।’
প্রশ্ন, ‘কেন তৃতীয় কোনো শক্তিকে কি ভোট দেয়া যায় না?’
উত্তর, ‘তৃতীয় শক্তির কথা তো শুনেছিলাম, এখন তো আর শুনি না। তাই ভোট দেবো কাকে?’
এই হলো রাজনীতির অবস্থা। অবস্থা বড়ই করুণ। মানুষ তৃতীয় শক্তির দিকে ভিড়তে চায়। কিন্তু তৃতীয় শক্তি তাদের দিকে আসে না। অথবা আসার ক্ষমতা নেই। কারা হতে পারত সেই তৃতীয় শক্তি? সাবেক প্রেসিডেন্ট এরশাদ কিছুদিন আগে বলে বেড়ালেন যে অন্যেরা নয়, তিনিই হবেন তৃতীয় শক্তি। হয়তো তার বলার পেছনে কিছুটা যুক্তি ছিল। কারণ, নেতা হিসেবে তিনিই একমাত্র ব্যক্তি ছিলেন, যিনি দেশব্যাপী পরিচিত ছিলেন। কিন্তু তার সংগঠন মোটেই শক্তিশালী ছিল না। রংপুর জেলার কয়েকটি আসনে তার দল জিততে পারে। এরশাদ কোনো সময় ‘আমার’ বলেন না, বলেন ‘আমি’। ভারত থেকে ফিরে এসে তিনি হুংকার দিয়েছিলেন যে, তৃতীয় শক্তি নয়, তিনিই হবেন প্রধান শক্তি। ভবিষ্যৎ সরকার গঠনের আশাও তিনি পোষণ করেছিলেন। তার হিসাব খুব ছোট্ট। প্রথমত, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয় দলই যদি ইলেকশনে অংশ নেয় এবং তিনি যদি ৬০টি আসন পান তাহলে দুই দলের কোনো দল সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না। সে ক্ষেত্রে তিনিই হবেন ব্যালান্সিং ফ্যাক্টর। এমনও তো হতে পারে যে, সেই ব্যালান্সিং ফ্যাক্টরই দেশে সরকার গঠন করবে। তার দ্বিতীয় আশাবাদ ছিলো এই যে, বিএনপি যদি ইলেকশনে অংশগ্রহণ না করে তাহলে তিনি এককভাবে ইলেকশন করবেন। সে ক্ষেত্রে বিএনপির ভোটগুলো তিনি পাবেন। ইলেকশনে সরকার গঠনের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা যদি তিনি নাও পান তাহলে বিপুলসংখ্যক এমপি নিয়ে তিনিই হবেন জাতীয় সংসদে প্রধান বিরোধী দলীয় নেতা। এরশাদের এসব হিসাব নিকাশের সাথে বাস্তবের কোনো মিল ছিল বলে আমার মনে হয়নি। ইংরেজিতে তার এই ধরনের চিন্তা ধারাকে বলা হয় ‘উইশফুল থিংকিং’।
এখন দেখা যাচ্ছে যে, তৃতীয় শক্তি হওয়ার দাবিদার অনেকে। সাবেক প্রেসিডেন্ট ডা. বি চৌধুরীর বিকল্প ধারা, আ স ম আব্দুর রবের জাসদ এবং কাদের সিদ্দিকীর কৃষক শ্রমিক জনতা লীগও তৃতীয় শক্তির দাবিদার। আ স ম আবদুর রব বলেন, আমরাই হলাম তৃতীয় শক্তি। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাইরে আমরা ছাড়া আর কে আছে? ওইদিকে বাম দলগুলো তৃতীয় শক্তির দাবিদার। এখানে রয়েছে হাসানুল হক ইনুর জাসদ, রাশেদ খান মেননের ওয়ার্কার্স পার্টি এবং বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি বা সিপিবি। মার্ক্সীয় দর্শন নিয়ে এরা এত মাথা ঘামায় যে, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান আমল মিলে বিগত ৭০ বছরেও এরা দেশের রাজনীতিতে কোনো ইম্প্যাক্ট রাখতে পারেনি। এদের কোনো জনভিত্তি নেই। আগামীতেও থাকবে বলে কোনো আলামত দেখা যায় না। বেশ কয়েক বছর আগে চরমোনাইয়ের পীর সাহেবের দল ইসলামী আন্দোলন দেশের বিভিন্ন ইসলামী রাজনৈতিক দলকে নিয়ে একটি আলাদা ঐক্যফ্রন্ট গঠন করার কথা বলেছিলেন। তিনি ইন্তেকাল করেছেন। তার ছেলে তার স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন। কিন্তু তাদের কোনো সংগঠন নাই।
এভাবে এই বিষয়টি সম্পূর্ণ থিতিয়েই পড়েছিল। আওয়ামী লীগের প্রাক্তন সাংগঠনিক সম্পাদক এবং ডাকসুর সাবেক ভিপি মাহমুদুর রহমান মান্না নাগরিক ঐক্য নামে প্রধানত বুদ্ধিজীবীদের একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। আদতে তাদের অনেকেই নাগরিক ঐক্যকে তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তি গঠনের প্রথম সোপান মনে করেছিলেন। এই সংগঠনটিতে ব্যারিস্টার রফিকুল হক, এবিএম মূসা, আসিফ নজরুলসহ আরো অনেক পরিচিত বুদ্ধিজীবী এসেছিলেন। আদতেই তাদের কোনো রাজনৈতিক পরিকল্পনা কি ছিল? নাকি বুদ্ধিজীবীদের একটি প্রেসার গ্রুপ হিসেবে তারা থাকতে চান? বিষয়টি সাধারণ মানুষের কাছে এখনো পরিষ্কার হয়নি।
বাংলাদেশ এবং পাকিস্তান মিলে ৭০ বছরের রেকর্ড পরীক্ষা করলে দেখা যায় যে, চরমপন্থী মতামত এদেশের জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। জনগণ সব সময় মধ্যপন্থার দিকে আকৃষ্ট হয়েছে। এই সুদীর্ঘ সময় জনগণের কাছে জামায়াতে ইসলামী অথবা বামপন্থী দলসমূহের কেউই জনভিত্তি গড়ে তুলতে পারেনি। এরা কেউই তৃণমূলে যেতে পারেনি। সংগঠন হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর শাখা প্রায় প্রতিটি জেলায় এবং উপজেলায় রয়েছে। কিন্তু গণসংগঠন হিসেবে তারা উত্থিত হতে পারেনি। এখনো শিক্ষিত মানুষরা জামায়াতকে ক্যাডারভিত্তিক সংগঠন মনে করে। কিন্তু বামপন্থীরা মূলত শহরভিত্তিক। তাও আবার সবগুলো জেলাভিত্তিক নয়। এরা প্রধানত ঢাকাকেন্দ্রিক। তাই এদেরকে কেউ আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বিকল্প হিসেবে তৃতীয় শক্তি রূপে কল্পনা করেন না।
২০১৮ সালে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হওয়ার পর থেকে লক্ষ্য করা গেল যে, ২০ দলীয় জোটের প্রতি বিএনপির আগ্রহ কমে যাচ্ছে এবং যুক্তফ্রন্টের প্রতি আগ্রহ বেড়ে যাচ্ছে। ঠিক এই সময় জামায়াত সম্পর্কে বি চৌধুরী এবং তার পুত্র মাহি বি চৌধুরীর তীব্র বৈরী মন্তব্য বিএনপির মনে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। ফলে তারা ড. কামাল হোসেনের সাথে যোগাযোগ করেন। এই যোগাযোগের ফলে বি চৌধুরীকে যুক্তফ্রন্টের শীর্ষ নেতার অবস্থান থেকে সরে যেতে হয় এবং তার স্থলে আসেন ড. কামাল হোসেন। ড. কামাল হোসেন এলে যুক্তফ্রন্টের নাম বদলে করা হয় ঐক্যফ্রন্ট। তার সাথে আসেন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের কাদের সিদ্দিকী এবং সাবেক আওয়ামী লীগার সুলতান মোহাম্মদ মনসুর ও মোস্তফা মহসিন মন্টু।
ঐক্যফ্রন্টের নতুন নেতা হয়েই ড. কামাল হোসেন সংলাপের আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে একটি চিঠি দেন। সরকার সংলাপের প্রস্তাব লুফে নেয়। সরকার ও ঐক্যফ্রন্টের মধ্যে দুই দফা সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। ঐক্যফ্রন্ট ৭ দফা দাবি ও ১১ দফা লক্ষ্য সরকারের কাছে পেশ করে। কিন্তু সরকার একটি দাবিও মানেনি। এমনকি নির্বাচনী তফসিল পেছাতে বললে সেটাও তারা মানেনি। এমন একটি পরিস্থিতিতে যেখানে দাবি আদায়ের জন্য ঐক্যফ্রন্টের দুর্বার গণআন্দোলনে যাওয়ার কথা, সেখানে তারা বিনা শর্তে নির্বাচনে যায়। তখন থেকেই শুরু হয় ২০ দলীয় জোটের সাথে বিএনপির ভুল বোঝাবুঝি। ২০ দলের সেন্টিমেন্টকে উপেক্ষা করে বিএনপি ঐক্যফ্রন্টকে বেশি করে মূল্য দিতে থাকে। ঐক্যফ্রন্টের সাথে আঁতাত করে বিএনপির কী লাভ হয়েছে সেটা বিএনপি ভালো করে জানে। কিন্তু এই করে বিএনপির অভ্যন্তরে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। প্রধানমন্ত্রীর সাথে সংলাপে বিএনপি দাবি করেছিল যে, নতুন করে যেন কোনো মামলা হামলা এবং গ্রেফতার করা না হয়। অন্যদিকে ইতোমধ্যে যেসব গায়েবি মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছে তাদেরকে যেন মুক্তি দেয়া হয়। কিন্তু সরকার কোনো কথা রাখেনি। বরং ঐক্যফ্রন্টের প্রতিটি নির্বাচনী প্রচারণা সভায় আওয়ামী লীগ এবং পুলিশ বাহিনী হামলা চালায়। সারাদেশে ঐক্যফ্রন্টের সমস্ত পোস্টার আওয়ামী লীগ ছিঁড়ে ফেলে।
বাংলাদেশে ভারতের স্বার্থ রাজনৈতিক এবং স্ট্র্যাটেজিক বা কৌশলগত ও সামরিক। এশিয়ায় চীনকে মোকাবিলা করা এবং বিশ্বসভায় পরাশক্তি হিসেবে উত্থিত হওয়ার জন্য বাংলাদেশকে ভারতের প্রয়োজন। কিন্তু গণচীনের স্বার্থ অর্থনৈতিক। পৃথিবীর ৬০টি দেশে গণচীনের ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড নির্মিত হওয়ার প্রস্তাব রয়েছে। বাংলাদেশ এই রোডে সংযুক্ত হওয়ার সম্মতি জানিয়েছে। বাংলাদেশের এই সম্মতিকে কেউ যদি মনে করেন যে, বাংলাদেশ ভারতের প্রভাব বলয় থেকে কিছুটা বেরিয়ে এসেছে এবং চীনের বলয়ে কিছুটা ঢুকে পড়েছে তাহলে সেটা রাজনীতির অতিরিক্ত সরলীকরণ হবে। ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোডে যুক্ত হওয়ার কারণে চীন বাংলাদেশকে ২৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থনৈতিক সাহায্য দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। চীন ছাড়া বাংলাদেশকে এত বিপুল পরিমাণে অর্থ সাহায্য করার আর কেউ নাই। আমেরিকার সাথে বিগত ৫০ বছরের সম্পর্কেও ২০ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ প্রকল্প সাহায্য বাংলাদেশ পায়নি। ভারত এই ৫০ বছরে ৩ বিলিয়ন ডলার সাহায্যও বাংলাদেশকে দেয়নি। তাই বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে বিএনপিও চীনের সাথে সর্বোচ্চ সম্পর্ক গড়ে তুলতো। সহযোগিতার ধরনের মধ্যেই বাংলাদেশে ভারত ও চীনের ভূমিকার মধ্যে মূল পার্থক্য বিদ্যমান। একটি অর্থনৈতিক এবং আরেকটি সামরিক ও রাজনৈতিক। বাংলাদেশে চীন ও ভারতের স্বার্থকে গুলিয়ে ফেলার কোনো অবকাশ নাই।
এসব ওপর তলার রাজনীতির দমকা হাওয়ায় সাময়িকভাবে হলেও তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তি ভেসে গেছে।
Email: journalist15@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন