পূর্ব প্রকাশিতের পর
উল্লেখিত হাদিস দ্বারা বোঝা যায়, হিজরি শত বছর শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই ইসলাম ধর্ম তমসাবৃত হয়ে পড়বে এবং তখন বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ পূর্ণ ইলম সম্পন্ন কোনো এক আধ্যাত্মিক ব্যক্তির আবির্ভাব হবে, যার বাহ্যিক ও আধ্যাত্মিক প্রচেষ্টায় উক্ত তমসা বা অন্ধকার বিদূরিত হয়ে ইসলাম পুনর্জীবিত ও নতুন আলোকে আলোকিত হবে। উক্ত ব্যক্তিকে মোাজাদ্দেদে মিয়াত বা শতাব্দীর সংস্কারক বলা হয়ে থাকে। যুগের পরিবর্তনে যেসব কুসংস্কার, ধর্মান্ধতা, ফিৎনা এবং সময়ের সাথে ধর্মের ব্যবধান সৃষ্টি হয় এসবের মোকাবিলা তারা করে থাকেন। এরূপ মোজাদ্দেদ কোনো এক সময় একজন ও একাধিত হতে পারেন। প্রয়োজন অনুসারে আল্লাহ এ ধরনের আধ্যাত্মিক পুরুষ পাঠিয়ে থাকেন।
প্রত্যেক শতাব্দীর শেষে বা প্রথমার্ধে মুসলিম জাতির মধ্যে বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন দেশে এমন সব মহান ব্যক্তিত্ব জন্ম নিবে, যারা জাতির বিভিন্ন অধঃপতন এর সংস্কার সাধন করে জাতিকে নতুনভাবে উজ্জীবিত করে তুলবেন। ধর্মে প্রাণ সঞ্চার করবেন যুগোপযোগী করে। তাদের কার্যক্ষেত্র বা প্রভাব বলয় বিশেষ একটা এলাকায়।
সীমাবদ্ধ থাকবে, আবার কারো কারো বিশ্বজুড়ে তথা সমগ্র মুসলমানদের মধ্যে বিস্তৃত হবে। এ ধরনের সংস্কারকদের কর্ম সাধনা ও তার ফলাফলের ভিত্তিতেই নির্ণীত হবে কে কোন এলাকার সংস্কার করতে সমর্থ হয়েছেন। অনুরূপেভাবেই নির্ণীত হবে কে কোন দেশের বা সমগ্র জাতির বা সমগ্র বিশ্বের মোছাদ্দেদ ছিলেন। যেমন- নিকট অতীতে বাংলা ও আসামে ফুরফুরার হজরত আবু বকর সিদ্দিকী, উত্তর ভারতে মওলানা আশরাফ আলী মানবী, মওলানা মো: ইলিয়াস, জামালুদ্দীন আফগানী, মিশরের মুফতি আবদুহু প্রমুখ সংস্কার কার্য চালিয়েছেন। জ্ঞানী গুণিগণ তাদেরকে যুগের মোজাদ্দেদ বলে চিহ্নিত করেছেন।
প্রত্যেক শত বৎসর অতিবাহিত হবার পর ইসলামের মধ্যে যেরূপ তমসাচ্ছন্নতা ঘটে, তার চেয়ে বহুগুণ অধিক তমসাচ্ছন্ন হয়, সহস্র বৎসর অতিবাহিত হবার পর। এ জন্য সহস্র বৎসর পর যে সংস্কারক আগমন করেন তিনি শতাব্দীর সংস্কারক অপেক্ষা অধিক শক্তিশালী ও গুণসম্পন্ন হয়ে থাকেন।
হিজরতের দ্বিতীয় সহস্রকের প্রারম্ভ হতে, প্রকৃত আখেরি জামানার সূত্রপাত কাজেই এ সময় ইসলাম মৃত প্রায় হওয়াই স্বাভাবিক এবং উহাকে পুনর্জীবিত করার জন্য একজন যোগ্য সংস্কারকের প্রয়োজন ছিল এবং সেই প্রয়োজন মিটানোর উদ্দেশ্যে পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা হজরত শেখ আহমদ (র) কে দ্বিতীয় সহস্রকের মোজাদ্দেদ রূপে প্রেরণ করেন। তিনি তাঁর মকতুবাত শরীফে বলেছেনÑ ‘এই রূপ বুজুর্গ ব্যক্তি (সহস্রকের সংস্কারক) একই সময়ে একাধিক ব্যক্তি হন না’ (দ্রঃ ইমামে রব্বানী মোজাদ্দেদে আলফেসানী (র)। লেখক খো. মাওলানা মো. বশির উদ্দিন এম, এম)।
মোজাদ্দিদ কোনো দাবি করার বিষয় নয়, করে দেখানোর বিষয়। যার দ্বারা ঐ সময় ইসলামের সত্য সুন্দর রূপটির বিকাশ ঘটবে এবং যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে সক্ষম হবেন। তিনিই মোজাদ্দেদ।
রাসুল (সা.) বলেছেন, আমার উম্মতের অনেকেই ইসরাইলি নবীদের মতোই উচ্চ মর্যাদার। কিন্তু যেহেতু আমার পরে কেউ নবী নাই, সেহেতু তারা কেউ নবী হবেন। (আবু দাউদ)।
তাই সহস্রকের মোজাদ্দেদ বনি ইসরাঈল বংশীয় উলুল আজম নবীগণের সমমর্যাদা সম্পন্ন বা কামালিয়াত প্রাপ্ত ওলী আল্লাহ। যার সাথে অন্যান্য মোজাদ্দেদদের বা ওলী আল্লাহর তুলনা হয় না। মোজাদ্দেদিয়াত নবুয়তের ছায়া। এ উম্মতের মোেজাদ্দেদেরকে সেই মহাত্মা দান করা হয়েছে যা পূর্ববর্তী আম্বিয়াদের দান করা হয়েছিল।
হযরত আবুল বারাকাত বদরুদ্দিন শেখ আহমদ সেরহিন্দ (র) এর পূর্বে কেবল এক শতাব্দীর জন্য কেউ সংস্কারক হতেন। হাজার বছরের সংস্কারক কেউ হননি। এর পূর্বে দ্বিতীয় সহস্রকের শুরুই হয়নি। প্রথম সহস্রে রাসূলুল্লাহর পবিত্র সত্তাই বিদ্যামান ছিল। মোজাদ্দেদই আলফেসানীর পূর্বে যারা শতাব্দীর মোজাদ্দেদ ছিলেন তারা কেউই সকল বিভাগের মোজাদ্দেদ ছিলেন না। বরং তারা বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে সংস্কারের জন্য প্রেরিত হয়েছিলেন। এ কারণেই একই সময়ে কয়েকজন মোজাদ্দেদ দেখা গেছে।
কেউ হাদিস শাস্ত্রের মোজাদ্দেদ, আবার কেউ ফিকাহ শাস্ত্রের। তারপর আবার কেউ হানাফী ফিকহার, কেউ শাফেয়ী ফিকহার মোজাদ্দেদ। কেউ আবার তরিকত ও সুলুকের মোজাদ্দেদ। কিন্তু সকল বিভাগের মোজাদ্দেদ হবার সৌভাগ্য কেবল মোজাদ্দেদে আলফেসানীর জন্য আল্লাহর তরফ হতে নির্ধারিত ছিল।
তার পূর্বে যে সকল মোজাদ্দেদ অতিবাহিত হয়েছেন তারা রাসূলুল্লাহ (সা.) এর বিশেষ বিশেষ বিষয়ের মধ্যে তার প্রতিনিধিত্ব করেছেন। আর মোজাদ্দেদ সাহেব সকল ক্ষেত্রেই রাসূলুল্লাহর প্রতিনিধিত্ব করেছেন। মোজাদ্দেদ সাহেবের পূর্বের সংস্কারদের সংস্কারের ফল হতো এক শতাব্দীর জন্য। আর মোজাদ্দেদ সাহেবের সংস্কারের ফল এক হাজার বছরের জন্য।
(দ্রঃ বইঃ আলেম সমাজের বিপ্লবী ঐতিহ্য ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ)
ইসলাম ধর্মের জ্ঞানী ও চিন্তাশীলদের মতে ১৪০০ হিজরির পর ইমাম মাহদীর আবির্ভাব হবে, ইসলাম ধর্মের সংস্কার সাধন করতে ইসলাম বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত করতে। পূর্বের কোনো মোজাদ্দেদকে নবুয়তের সম্মান দেয়া হয়নি বা চেয়ার দেয়া হয়নি, কিন্তু ইমাম মাহদী (আ.) কে দেয়া হবে। কারণ, তিনি আল্লাহ ও রাসূলের নির্দেশে মোহাম্মদী তরিকা প্রচার করবেন যা দ্বীনের মতো তাই আলাইহে ওয়া সাল্লাম সম্মানে সম্মানিত হবেন।
খলিফা দ্বিতীয় ওমর (র.) কে আল্লাহর অনুগৃহীত একজন বিশেষ মোজাদ্দেদ হিসাবে গণ্য করা হয়। গবেষক ও তথ্যানুসন্ধানীদের দৃষ্টিতে এই শ্রেণির ধর্ম সংস্কারকদের মাঝে খলিফা দ্বিতীয় ওমরই ছিলেন প্রথম মোজাদ্দেদ। সর্বশেষ সংস্কারক হবেন। হযরত মোহাম্মদ (সা.) এর বংশধর হযরত ইমাম মাহদী (আ.)।
উম্মে সালমা (রা.) বলেন, ‘নবী করীম (সা.) বলেছেন, মাহদী আমার খান্দানের তথা ফাতেমার বংশ হতে জন্ম লাভ করবে।’(আবু দাউদ, মেশকাত ও ৫২১৯)।
লেখক, ইসলামী চিন্তাবিদ, গবেষক, আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন