ফলের রাজা আম ছোট-বড় সবার কাছেই প্রিয়। ইতিহাস বলছে আমের কলম ও জাত উন্নয়নে মুঘল শাসকদের অবদান অনেক। বাবর, হুমায়ুন, আকবর সবাই পছন্দ করতেন আম। মুঘল রাজধানী দিল্লিতে আকবরের নির্দেশে গড়ে ওঠে লাখ লাখ গাছের আম বাগান। রাজকীয় বাগানে এমনভাবে উন্নত জাতের আম গাছের সারি তৈরি করা হয় যেন বাদশার জন্য বছরের প্রতি মাসেই নিখুঁত পাকা আম খাওয়নোর ব্যবস্থা করা যায়।
বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নবাববাড়ি এবং যেসব এলাকায় মুঘলদের দুর্গ বা প্রাদেশিক রাজধানী ছিল সেসব এলাকায় দুর্লভ সব প্রজাতির উন্নতমানের আম গাছের দেখা মেলে। মুসলিম দরবেশদের মাজার শরীফ, দরগাহ এবং মশহুর পীরদের মধ্যে যাদের আগমন পশ্চিম ভারতের দিক থেকে তাদের খানকাতে দেখা মেলে ফজলি, ল্যাংড়া জাতের আম গাছের ।
পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ, মালদহ এবং বাংলাদেশের রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ মূলত নবাবদের হাত ধরেই বিখ্যাত হয়ে উঠেছে। আবার নবাব ও কিছু কিছু মুসলিম জমিদারদের বাড়ির আঙিনায় দেখা যায় রানী পছন্দ ও বেগম পছন্দ জাতের আম গাছের। বৃটিশ শাসনামলে বাংলাদেশে আমের পৃষ্টপোষকতা বন্ধ হয়ে যায়। বৃটিশ আমলে কোর্ট ও কালেক্টর অফিস কম্পাউন্ডে বিশাল বিশাল বট গাছ এবং থানা কম্পাউন্ডে ঝাউ ও দেবদারু গাছের চারা রোপন করা হয়।
অতি সম্প্রতি বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনিস্টিটিউটের (বারী) বিজ্ঞানীরা আম গবেষণায় ব্যাপক সফলতা অর্জন করেছেন। সুমিষ্ট আম্রপালি এবং গৌরমতি (বারী ১১) জাতের মতো আম উদ্ভাবন তারই জলন্ত প্রমান। গৌরমতি আম বারোমাসি জাতের। ভারত, পাকিস্তান এবং থাইল্যান্ড থেকে বিভিন্ন জাতের বারোমাসি আমের জাতের চাষও শুরু হয়েছে দেশে। কৃষি বিজ্ঞানীদের আশা আগামি ৫ থেকে ৭ বছরের মধ্যেই দেশে ‘অফ সিজনেই’ মিলবে ফলের রাজা আম।
বিদ্যমান বাস্তবতা ও চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে বগুড়ার এক নিভৃত পল্লীতে সীমিত পরিসরে গড়ে উঠতে শুরু করেছে অফসিজনের আমবাগান। শেরপুর উপজেলার খামারকান্দি ইউনিয়নের আগুনের তাইড় গ্রামের একেবারেই নিভৃত পল্লীতে শহীদুল ও মামুন নামে ২ ব্যক্তি প্রায় ৪০ বিঘা জমি লিজ নিয়ে গড়ে তুলেছেন অফসিজনাল আম ও পেয়ারার বাগান।
সম্প্রতি দুর্গম ওই পল্লীতে গিয়ে দেখা যায় ৪ থেকে ৫ বছর বয়সী কয়েক হাজার পেয়ারা ও আমগাছের বাগান। আমবাগানের সীমানায় আবার লেবুগাছের সারি। আমের চারাগুলো এখনো ছোট বলেই সাথী ফসল হিসেবে লাগানো হয়েছে অস্ট্রেলিয়ান বল সুন্দরী নামের কুল বরই।
বাগানের দুই মালিকের একজন মামুন জানান, আম গাছ আরও বড় ও ফলবান হয়ে ওঠার আগে লেবু ও কুল বরই চাষে মনযোগ দিয়েছেন। লেবু ও কুল বরই চাষ এবং আমের চারা বিক্রি করে তারা এনজিও এবং ব্যাংকের দায়দেনাসহ কর্মচারিদের বেতন পরিশোধ করছেন। পাশাপাশি সীমিত আকারে লাভের মুখ দেখছেন।
মামুন আরও জানান, ২০১৬ সালে তার মাথায় আইডিয়া আসে অফসিজনে আম ফলালে কেমন হয়? এরপর এই আইডিয়া শেয়ার করেন বগুড়া হটিকালচার সেন্টারের ডিডি আব্দুর রাজ্জাকের সাথে। তার পরামর্শ ও সহায়তায় ধীরে ধীরে গড়ে উঠছে ১৫ হাজার চারার অফসিজনাল আম বাগান। গত বছর থেকে খুবই সীমিত আকারে ধরতে শুরু করেছে অফসিজনাল থাই অরিজিনের কাটিমন ও বানানা এবং গৌরমতি (বারী -১১) আম।
তিনি জানান, রাজধানীর সুপার ও চেইনশপগুলোতে তারা এই আম ৫০০ থেকে ৮০০ টাকা কেজিতে বিক্রি করেছেন বলে জানান মামুন। আগামীতে গাছ বড় হয়ে উৎপাদন বাড়লে তারা সাশ্রয়ী মূল্যে আম বিক্রি করতে পারবেন।
মামুন জানান, থাইল্যান্ডের সাথে বাংলাদেশের পরিবেশ ও আবহাওয়ার মিল থাকায় এখানে থাই অরিজিন আমসহ বিভিন্ন ফলের চাষাবাদ বিস্তারের সম্ভাবনা উজ্জল। বাগান পরিদর্শন করে বগুড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মো. দুলাল হোসেন ইনকিলাবকে জানান, এমন একটি উদ্যোগ আসলেই প্রয়োজন ছিল। শহীদুল ও মামুনের মতো উদ্ভাবনী চিন্তার শিক্ষিত যুবকরা কৃষিতে মনোযোগি হলে দেশ স্বনির্ভর হতে খুব বেশি সময় লাগবে না।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন