মসজিদ আল্লাহর ঘর। মুসলমানদের ইবাদত খানা। মহান রবের প্রিয় স্থান। মসজিদের সাথে সম্পর্ক যুক্ত হৃদয় শেষ বিচারের দিন আরশের ছায়ার নিচে স্থান পাবে। মহান মালিকের সন্তুষ্টির জন্য মসজিদ নির্মাণকারীর জন্য জান্নাতে মহান মালিক ঘর তৈরি করে দেন।
এই মসজিদের:
অনেক অনেক ফযিলত
অনেক অনেক মরতবা
অনেক অনেক বরকত
অনেক অনেক মুনাফা
এমন ব্যবসাকারীর শুধু লাভ আর লাভ।
মহান আল্লাহ কালামে হাকিমে এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বর্ণনা করেছেন। মুসলিম সমাজে এই মসজিদ কেন্দ্রিক সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হলে সমাজে শান্তি, সস্তি, স্থিতিশীলতা বিরাজ করে। যতদিন মুসলিম সমাজে মসজিদের প্রতি সকলের হৃদয়ের টান ছিল ততদিন শান্তিও ছিল। এর বিপরীতে এমন মসজিদের অস্তিত্ত্বও আছে যা খুবই নিকৃষ্ট। যে মসজিদ তার নির্মাতাকে, তার মধ্যে নামাজ আদায়কারীকে জান্নাতে নয় জাহান্নামে নিয়ে ছাড়বে। যাদেরকে মহান রব নিজেই মিথ্যাবাদী হিসেবে ঘোষনা দিয়েছেন। হ্যাঁ প্রিয় ভাই আজ এমন মসজিদ নিয়ে লেখার অবতারনা।
হযরত হানজালা রাঃ এর কথা আমরা জানি। যার শহীদ হওয়ার পর ফেরেস্তারা আকাশে নিয়ে তাকে গোসল করিয়েছিলেন। তার পিতার নাম আবু আমর। তিনি ছিলেন, খৃষ্টান পাদ্রি। মদিনার লোকজন তাকে সম্মান করত। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর আগমনে তার অন্তর জ্বালার শেষ ছিল না। তিনি মদিনার মুনাফেকদের শলা পরামর্শ দিয়ে মসজিদে কুবার খানিক দূরে একটি মসজিদ বানালেন। সেখানে ১২ জন মুনাফেক সংশ্লিষ্ট ছিল। মসজিদ বানানো শেষ হলে তারা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকট এসে বললেন, হে আল্লাহর রাসুল আমরা অসুস্থ আর দুর্বল লোকদের জন্য এই মসজিদ বানিয়েছি। যারা এত দূর থেকে মসজিদে কুবায় এসে নামাজ আদায় করতে পারে না। বৃষ্টি বাদলা আর প্রচন্ড শীতের সময় যাতে আমাদের মসজিদে আসতে কষ্ট না হয় ইত্যাদি ইত্যাদি। আমাদের নিয়ত খুব সহিহ। আপনি এসে নামাজের মাধ্যমে এই মসজিদটি উদ্ভোধন করে দিন, বরকতময় করে দিন। এই ঘটনাটি ছিল তাবুক যুদ্ধের কয়েকদিন আগে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাবুক যুদ্ধের প্রস্তুতির জন্য ব্যস্ততায় ছিলেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ঠিক আছে এখন আমি সফরে ও জিহাদের কাজে ব্যস্ত আছি। ফিরে এসে সেখানে গিয়ে আমি নামাজ আদায় করব। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাবুক যুদ্ধ শেষে ফিরে আসছেন। মদিনায় পৌঁছতে একদিনের পথ। তারা সে মসজিদে জুমুয়ার নামাজ আদায় করছে। ওয়াক্তিয়া নামাজগুলোও আদায় করছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদিনার নিকটবর্তী যু আওয়ান নামাক স্থানে পৌঁছতেই জিব্রাইল আঃ এর আগমন ঘটে এই মসজিদ সম্পর্কে সুরা তাওবার আয়াতগুলো নাজিল হয়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখনই দুই সাহাবীকে এই মসজিদটি জ্বালিয়ে দেওয়ার জন্য পাঠালেন। তারা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদিনায় পৌঁছার আগেই এই মসজিদ একেবারে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ধ্বংশ করে দেন।
মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, (মুনাফেকদের) যারা মসজিদে যেরার (ক্ষতিকর মসজিদ) বানিয়েছে, (তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে) কুফরি করা, আর ঈমানদারদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করা, আর তার ঘাঁটি স্বরূপ যে এর আগে আল্লাহ্ ও তাঁর রসূলের বিরুদ্ধে লড়াই করছিল, তারা নিশ্চয়ই হলফ করে বলবে ‘’আমরা সৎ উদ্দেশ্য ছাড়া অন্য কোন উদ্দেশ্যে এটি করিনি।’’ কিন্তু আল্লাহ্ সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে তারা ডাহা মিথ্যাবাদী।
তুমি কখনো এতে দাঁড়াবে না। নিঃসন্দেহ সেই মসজিদ যা প্রথম দিন থেকেই ধর্মনিষ্ঠার উপরে স্থাপিত তার বেশি দাবি রয়েছে যে তুমি সেখানে দাঁড়াবে। তাতে এমন লোক রয়েছে যারা (ঈমান ও আমলের ক্ষেত্রে) নিজেরা সব সময় পাক পবিত্র হওয়া পছন্দ করে। আর আল্লাহ্ পাক পবিত্র লোকদের ভালোবাসেন।
আচ্ছা! যে তা’হলে তার ভিত্তি গড়েছে আল্লাহ্র ভয় ও সন্তুষ্টির উপরে সে উত্তম, না যে তার ভিত্তি স্থাপন করেছে পতনপ্রায় গর্তের কিনারার উপরে, ফলে তা তাকে নিয়ে অচিরেই জাহান্নামের আগুনে গিয়ে পড়বে? আর আল্লাহ্ তায়ালা জালেম লোকদের পথ দেখান না।
তাদের যে ভবন তারা বানিয়েছে তা তাদের হৃদয়ে অশান্তি সৃষ্টি থেকে বিরত হবে না, যদি না তাদের হৃদয় ভেঙ্গে খান খান হয়ে যায়। আর আল্লাহ্ তায়ালা সর্বজ্ঞাতা, পরমজ্ঞানী। সুরা তাওবা আয়াত ১০৭-১১০।
এই আয়াতে কারীমাগুলো একবার পড়লেই কোন ঈমানদারের গায়ের লোম খাড়া না হয়ে পারে না। কোন হৃদয় আল্লাহর ভয়ে কম্পন না করে পারে না। এমন মসজিদ নির্মাণকারীকে মহান রব নিজেই মিথ্যাবাদী, জাহান্নামী বলে উল্লেখ করেছেন। আর সর্ব সাধারণকে এমন মসজিদে নামাজ আদায় করতে নিষেধ করেছেন। কেননা ওখানে নামাজ পড়লে নামাজ আর নামাজ থাকে না। নামাজ আদায় করা আল্লাহর আদেশ আবার এমন মসজিদে নামাজ না পড়াও আল্লাহর নির্দেশ। বুদ্ধিমান, চিন্তাশীল ঈমানদারদের আর কী প্রয়োজন?
হে প্রিয় ভাই, আমাদের সমাজে কত কত মসজিদ, আজানের সুরে আমাদের ফজরে ঘুম ভাঙ্গে। দিনে পাঁচ বার আজানের সুমধুর সুর আমাদের হৃদয় আন্দোলিত করে। মহান রবের সামনে হাজির হই। রবের সামনে মাথা পেতে দেই। নিজের প্রয়োজন, চাওয়া পাওয়া মাওলার নিকট নিবেদন করি।
আমাদের কারো সাথে একটু বনিবানা না হলে। আমার সামান্য নেতৃত্ব চলে গেলে, আমরা চটে যাই। সেই আবু আমেরের ইতিহাস জেনে দেখুন। সে তার বংশের সম্মানী ব্যক্তি ছিল। সকলে তাকে দরবেশ হিসাবে জানত। যখন দেখল তার সম্মানে আঘাত আসছে। তখনই সে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর পিছনে লেগে গেল। এবং সর্বশেষ মুনাফেকদের দিয়ে মসজিদ বানালো। আর মহান আল্লাহ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে সবকিছু জানিয়ে দিলেন। মসজিদ ধ্বংস করা হল। তাফসীরে আরো জানা যায়। যেখানে এই মসজিদটি ছিল। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই স্থানটি আসেম ইবনে আদী রাঃ কে দিতে চাইলেন, বললেন, তুমি এই স্থানে তোমার নিজের জন্য ঘর নির্মাণ কর। আসেম রাঃ বললেন হে আল্লাহর রাসুল সাঃ এই মসজিদ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা যে আদেশ দিয়েছেন, এরপর আমি এই স্থানে ঘর তৈরি করতে পারি না। আপনি সাবেত ইবনে আকরামকে এই স্থানটি দান করুন। তার কোন ঘরবাড়ি নেই। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাবেত রাঃ কে এই স্থানটি দান করেন। তিনি এখানে বসবাস করেন। কিন্তু সেখানে তার কোন সন্তান সন্তুতি জন্ম গ্রহন করে নি। এমনকি সেখানে কোন কবুতরের বাচ্চাও ফুটে নি, এমন কি কোন মুরগির ডিমের সেখানে বাচ্চা হয় নি। প্রিয় ভাই ভেবে দেখুন কী ভয়ানক চিত্র।
ইসলাম একতা আর ভ্রাতৃত্বের দীন। মুসলমানদের মধ্যে নিজের স্বার্থে বিভেদ সৃষ্টি করে, ফাটল ধরিয়ে, একে অপরের শত্রু বানিয়ে কল্যাণের, মুক্তির আশা করা যায় না। এর অর্থ এই নয় যে ভ্রাতৃত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য ইসলামী বিধান মানায় ছাড় দেওয়া যাবে। বিনাপ্রয়োজনে সমাজ, ভ্রাতৃত্ব বিভক্তিতে শুধু সওয়াবের আশায় মসজিদ নির্মাণ করলেই হবে না। মুসলিম সমাজের প্রয়োজনীয়তা, দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে হবে।
হ্যাঁ প্রিয় ভাই, আপনার অনেক টাকা থাকতে পারে, আপনি অনেক সম্মান আর মর্যাাদার অধিকারী হতে পারেন। নিজের স্বার্থে একটি মসজিদ বানাতে পারেন না। আমরা সকলে আমাদের নিজের কবরেই যাব। মহান আল্লাহ বলেন, “তারা তার ভিত্তি স্থাপন করেছে পতনপ্রায় গর্তের কিনারার উপরে, ফলে তা তাকে নিয়ে অচিরেই জাহান্নামের আগুনে গিয়ে পড়বে।” কত ভয়াবহ সতর্কবার্তা। দশ নম্বর মহা বিপদ সংকেত। মহান রব কত সুন্দর উপমা দিয়ে আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছেন। তাফসীরকারকগন এর ব্যাখ্যায় বলেন, যারা এমন মসজিদ নির্মাণ করবে, তারা যেন এমন, যে তারা নদীর কিনারায় ঘর নির্মাণ করল। ঘরটি সুন্দর করে সাজাল। নিজের সব মালামাল সেখানে জমা করল। অথচ সে জানেই না নদীর নিচ দিয়ে স্রোত মাটি কেটে নিয়ে যাচ্ছে। যে কোন সময় তার মাল সামানা সহ এই ঘরটি নদীর গর্ভে বিলীন হয়ে যাবে। অর্থাৎ তাকে সহ জাহান্নামে নিয়ে যাবে।
আল্লামা বগভী রাহঃ বলেন, বনী আমর ইবনে আউফের লোকেরা যারা মসজিদে কোবা নির্মাণ করেছিলেন, তারা খলিফা ওমর রাঃ এর নিকট হাজির হয়ে মাজমা ইবনে হারেসাকে মসজিদে কোবার ইমাম নিযুক্ত করার অনুরোধ জানালেন। হযরত ওমর রাঃ সাফ না করে দিলেন। আর বললেন তার নয়ন যুগল শীতল না হোক। সে কি মসজিদে জেরারের ইমাম ছিল না? মাজমা রাঃ সেখানে উপস্থিত ছিলেন, তিনি বললেন, হে আমিরুল মুমিনিন আমার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে তাড়াহুড়া করবেন না। তাদের নিয়ত কি ছিল, আমি জানতাম না। আমি যদি জানতাম তাহলে আমি সেখানে ইমামতি করতাম না। আমি অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছিলাম। কিন্তু আমি কোরআন পাঠ করতে পারতাম। আর এই লোকগুলো ছিল মুর্খ, বৃদ্ধ। এজন্য আমি নামাজ পড়িয়েছি। আমি মনে করেছিলাম মসজিদ নির্মাণে তাদের উদ্দেশ্য সৎ ছিল। তাদের মনের গোপন ইচ্ছা সম্পর্কে আমার জানা ছিল না। তারপর খলিফা তার ওজর কবুল করেন এবং তাকে মসজিদে কুবার ইমাম নিযুক্ত করেন।
উপরের আলোচনায় আমরা এই উপসংহারে পৌঁছতে পারি। মসজিদে জেরার বা ক্ষতিকর মসজিদ কেউ বানাতে পারে না, কেউ সাহায্য করতে পারে না, কেউ সেখানে নামাজ আদায় করতে পারে না, কেউ সেখানে ইমামতি করতে পারে না। তাহলে নামাজ আর নামাজ থাকবে না। এই নামাজ আমাকে আপনাকে আল্লাহর দিকে নিবে না। নিয়ে যাবে চরম লাঞ্জনাকর জাহান্নামের অতল গহবরে।
যে কেউ মনোকষ্ট পেয়ে, অর্থ বিত্তের দাপটে, সামাজিক পদ পদবী হারিয়ে, অহংকার হিংসার চাদর গায়ে প্রয়োজনহীন আরো একটি মসজিদ করে ফেলতে পারে, অনেক মানুষ তাকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে পারে। এরকম মসজিদে অনেক মুসল্লির সমাগম হতে পারে। সুবক্তা কোন মাওলানা সাহেব ইমাম হিসেবে চাকুরী নিতে পারেন। কিন্তু ভাবা উচিত যে আমাদের এ সবগুলো কাজ থেকে দূরে অনেক দূরে থাকা উচিত, যদি আমরা পরকালীন মুক্তির আশা করি। দুনিয়ার জীবনে কল্যাণ লাভ করতে চাই। নতুবা এই কাজে জড়িত কেউই মুক্তির আশা করতে পারি না।
আসুন আমরা সকলে কল্যাণকামী হই। সকলের ভাল চাই। দরম মাখা হৃদয় আর কথা দিয়ে অন্যকে রবের পথে ডাকি। মহান রব আমাদের ক্ষমা করুন, দয়া করুন। আমীন।
লেখক : শিক্ষাবিদ, গবেষক।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন