আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা (র.) জন্ম ১২৭২ হি. (১৮৫৬ খ্রি.) ওফাত ১৩৪০হি. (১৯২১ খ্রি.) বিশ্বব্যাপী পরিচিত এক বিস্ময়কর অসাধারণ প্রতিভা। প্রাচ্য থেকে পাশ্চাত্যের সর্বত্র আজ তাঁর চিন্তাধারা শিক্ষা ও জীবন দশর্ন সম্পর্কে আলোচনা ও গবেষণা চলছে। তাঁর জীবন কর্ম মূল্যায়ন ও অবদান সর্ম্পকে বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩৬ জন গবেষক ৩৬টি শিরোনামে পি-এইচ.ডি. ডিগ্রী অর্জন করেছেন, ২৭ জন গবেষক এম.ফিল ডিগ্রী সম্পন্ন করেছেন। আরেক গবেষক ড. মুহাম্মদ মুকাররম আহমদ “ইমাম আহমদ রেযা কী আদবী খিদমত” শিরোনামে ভারতের দিল্লী জওহারলাল ইউনিভার্সিটি হতে ১৯৯৮ খ্রি. ডি. লীট ডিগ্রী অর্জন করেন। ১
ভারতের উত্তর প্রদেশের বেরেলী শহরে যদিও তাঁর আবির্ভাব; কিন্তু দেশ কাল ও ভৌগলিক সীমানার উর্দ্ধে তাঁর অবস্থান। এ জাতীয় মনীষীরা গোটা বিশ্বের সম্পদ। ১৩৪০ হিজরিতে বিশাল কর্মময় জীবনে মিল্লাত মাযহাবের জন্য জ্ঞান সমুদ্র রেখে তিনি ইহকাল ত্যাগ করেন। তিনি ইতিহাসের কিংবদন্তি। নবী মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুযোগ্য ইলমী উত্তরাধিকার হিসেবে তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণে জ্ঞানী ওলামা মাশায়েখসহ মুসলিম বিশ্বের এক বিশাল অংশের অন্তরাত্মা আজ তেজোদীপ্ত ও আলোকিত।
তরজমা কুরআন কানযুল ঈমান তাঁর শ্রেষ্ঠ কীর্তি
আ’লা হযরত অনূদিত তরজমা কুরআন কানযুল ঈমান-এর সূচনা প্রসঙ্গে আল্লামা আবদুল মুবীন নোমানী বর্ণনা করেন, “ কানযুল ঈমান লিখার সূচনা হয় জমাদিউল আখের ১৩৩০ হিজরিতে, অনুবাদ কর্ম সমাপ্ত হয় ২৮ জমাদিউল আখের ১৩৩১ হিজরিতে (মুতাবিক ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দে) মাঝখানে কিছু দিন বিরতি ছিলো। এক বৎসর বা দেড় বৎসর এর মধ্যেই অনুবাদ কর্ম সম্পন্ন হয়। ২
কানযুল ঈমান-এর উপর পি-এইচ.ডি.
আ’লা হযরতের জীবন ও কর্মের গবেষণা বিষয়ক, আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান এদারায়ে তাহকীকাতে ইমাম আহমদ রেযার সেক্রেটারী জেনারেল “মারেফে রেযা” মাসিক পত্রিকার সম্পাদক করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ে পেট্রোলিয়াম এন্ড টেকনোলোজি বিভাগের প্রফেসর ড. মজিদ উল্লাহ কাদেরী, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব খ্যাতিমান আ’লা হযরত গবেষক প্রফেসর মুহাম্মদ মাসউদ আহমদ (র.)’র তত্ত্বাবধানে ১৯৯৩ খ্রি. “কানযুল ঈমান আওর দিগর মারুফ উর্দু তারাজেমে কুরআন কা তাকাবুলি জায়েযাহ” শিরোনামে পি-এইচ,ডি. ডিগ্রী অর্জন করেন। এ পর্যন্ত বাংলা ভাষাসহ পৃথিবীর ৭টি ভাষায় যথাক্রমে ইংরেজী, হিন্দি, গুজরাটি, সিন্ধু, ডাচ, তুর্কী ও বাংলা ভাষায় মোট ১৪ জন খ্যাতিমান আলেম ও গবেষক কানযুল ঈমান-এর অনুবাদ প্রকাশ করেছেন।৩
বিশ্ববরেণ্য আলেমেদ্বীন বোখারী শরীফের ব্যাখ্যাকারক আ’লা হযরত গবেষক ফকীহুল হিন্দ হযরত আল্লামা মুফতি শরীফুল হক আমজাদী (র.) এর বর্ণনা মতে ১০ শাওয়াল ১২৭২ হিজরীতে তাঁর জন্ম, ২৫ সফর ১৩৪০ হিজরিতে তাঁর ওফাত। হিজরি সাল অনুপাতে তাঁর জীবনকাল ৬৭ বৎসর ৫ মাস ১৫দিন।
১৪ শাওয়াল ১২৮৬ হিজরিতে তিনি ফাতওয়া প্রণয়ন শুরু করেন। এ হিসেবে ১৩৪০ হিজরি পর্যন্ত সুদীর্ঘ ৫৩ বৎসর ৬ মাস ১১ দিন সময়কাল পর্যন্ত ফাতওয়া প্রণয়নে দক্ষতার স্বাক্ষর রাখেন। জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখা প্রশাখায় ৭৪ টির অধিক বিষয়ে সহস্রাধিক গ্রন্থ রচনার পাশাপাশি ফিক্হ হানফীর ইনসাইক্লোপিগিয়া তথা বিশ্বকোষ নামে খ্যাত “আল আতাআ আন্ নবভীয়্যাহ ফিল ফাতাওয়া আর-রিজভীয়্যাহ” নামে বিশাল ফাতওয়া গ্রন্থ গ্রণয়ন করেন। লক্ষাধিক ফাতওয়ার বিশাল সম্ভার বর্তমানে ত্রিশ খন্ডে বিভক্ত। পৃষ্ঠা সংখ্যা ২১৬৫৬। সর্বমোট প্রশ্নত্তোর সংখ্যা ৬৮৪৭ যা ২০৬টি ফাতওয়া সংক্রান্ত পুস্তিকার বিশাল সম্ভার। ফিকহে হানফীর জগতে তাঁর অনন্য অবদান “ফাতওয়ায়ে রিজভীয়্যাহ”।৪
এছাড়াও আ’লা হযরত দৈনিক গড়ে ৫৬ পৃষ্ঠা লিখা নিয়মিত লিখেছেন। সেই অনুপাতে পৃষ্ঠা সংখ্যা দাঁড়ায় ১০,৬৫৮৪৩ (দশ লক্ষ পয়ষট্টি হাজার আটশত তেতাল্লিশ) পৃষ্ঠা।
আ’লা হযরতের ফিকহী মানসের উপর পি-এইচ.ডি. অর্জন
আল্লামা হাসান রেযা খান আজমী “ফকীহে ইসলাম ইমাম আহমদ রেযা খান” শিরোনামে ড. আতহার শের-এর তত্ত্বাবধানে ভারতের পাটনা ইউনিভার্সিটি হতে ১৯৭৯ খ্রি. পি-এইচ.ডি.ডিগ্রী অর্জন করেন।৫
নবী প্রশস্তির এক অমর কাব্য গ্রন্থ হাদায়েকে বখশিশ
হাদায়েকে বখশিশ নবী প্রশস্তিতে লিখা আ’লা হযরত-এর অমর কাব্য সংকলন। তিনি রচনা করেন রসূলের প্রতি প্রেম ভালবাসার অপূর্ব নিদর্শন নাতিয়া কালাম।
“মোস্তফা জানে রহমত পেহ্ লাখো সালাম
শময়ে বযমে হেদায়ত পেহ্ লাখো সালাম।”
এমন শাশ্বত কাব্য পংক্তির কোন নজির নেই। শত সহস্রবার উচ্চারিত হয়েও এর আবেদন এতটুকু নিস্প্রভ হয়নি। রাসূলের সুমহান শান-মান, মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব অনুধাবন, আক্বিদাগত বিভ্রান্তি নিরসন ও ব্যাকুলতার স্বরূপ উম্মোচনে তাঁর লিখনী এক অব্যর্থ প্রতিষেধক। তাঁর রচিত কবিতার ছত্রে ছত্রে নবী প্রেমের যে অনন্য সূর অনুরণিত হয়েছে তা তাঁর অকৃত্রিম আনুগত্য ও মুহব্বতের অক্ষয় শ্রুত ধ্বনি।
পৃথিবী কবি ও কাব্য কম দেখে নি; কিন্তু ইমাম আহমদ রেযার অন্তরাত্মা ছিলো খোদা প্রদত্ত অসাধারণ প্রতিভা, আশ্চর্য প্রভা ও প্রজ্ঞায় আলোকিত। ইমাম বেরলভীর কাব্য মানসের উপর পৃথিবীর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বহু গবেষক এম.ফিল. ও পি-এইচ.ডি. ডিগ্রী সম্পন্ন করেন। বার্মিং হাম ইউনিভাসির্টি (যুক্তরাষ্ট্র) পাঞ্জাব ইউনির্ভাসিটি (পাকিস্তান) মুসলিম ইউনিভাসির্টি (ভারত) ময়শুর ইউনিভর্সিটি (ভারত)সহ বিশ্বের সর্বোচ্চ বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে গবেষণা কর্ম হয়েছে এবং হচ্ছে। সম্প্রতি প্রাচ্যের অক্সফোর্ড নামে খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষক মাওলানা নাসির উদ্দিন ড. প্রফেসর আবদুর রশীদ-এর তত্ত্বাবধানে বাংলা ভাষায় আ’লা হযরতের কাব্য সাহিত্যের উপর পি-এইচ.ডি.ডিগ্রী অর্জন করেন।
বিশ্ববরণ্যে বহু খ্যাতিমান আলেমেদ্বীনগণ হাদায়েকে বখশিশ-এর ব্যাখ্যা গ্রন্থ রচনা করেন। আল্লামা মুফতি নসরুল্লাহ খান (করাচি) শায়খুল হাদীস আল্লামা ফয়েজ আহমদ ওয়েসী (ভাওয়ালপুর) আল্লামা মুফতি মুহাম্মদ খান (লাহোর) আল্লামা গোলাম ইয়াসীন আমজাদী প্রমুখ। ইসলামী বিশ্বের প্রাচীনতম বিদ্যাপীঠ ইসলামী ঐতিহ্যের স্মারক মিসর আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয়-এর অধ্যাপক প্রফেসর ড. হাফেয মুহাম্মদ মাহফুয ইমাম আহমদ রেযা প্রণীত অমর কাব্যের ৩৫০ পৃষ্ঠা সম্বলিত এক বিরাট সংকলন প্রকাশ করেন যা “বাসাতিনুল গুফরান” নামে ১৯৯৭ সালে প্রকাশিত হয়েছে। (চলবে)
লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা-এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী) মধ্য-হালিশহর, বন্দর, চট্টগ্রাম।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন