ইসলাম একটি শাশ্বত, সর্বজনীন ও পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। সৃষ্টি জগতের এমন কোন বিষয় নেই, যে ব্যাপারে ইসলাম স্পষ্ট নির্দেশনা প্রদান করেনি। মহান আল্লাহ বলেন, আমরা এ কিতাবে কোন কিছুই অবশিষ্ট রাখিনি।
মানব জীবনের অতীব প্রয়োজনীয় কর্মকাণ্ডের অন্যতম হলো ব্যবসা-বাণিজ্য। ব্যবসা-বাণিজ্য সম্পর্কেও ইসলামে সুস্পষ্ট দিক-নির্দেশনা রয়েছে। এ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ বলেন, ‘হালাল সুস্পষ্ট এবং হারামও সুস্পষ্ট এবং এতদু’ভয়ের মধ্যে যা রয়েছে তা সংশয়যুক্ত।’
কুরআন ও হাদীসে যেসব বিষয় বৈধ বলে ঘোষণা করা হয়েছে শরী’আহর পরিভাষায় তা হালাল। আর যেসব বিষয় অবৈধ বলে ঘোষণা করা হয়েছে তা হারাম। হালাল-হারাম বিধানের উদ্দেশ্য হলো মানব জাতির কল্যাণ সাধন এবং ক্ষতি থেকে রক্ষা করা। কিন্তু ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ইসলামে যে নির্দেশনা রয়েছে সে সম্পর্কে সম্যক ধারণা না থাকায় বর্তমানে হালাল-হারামের বিষয়টি একেবারে উপেক্ষিত হচ্ছে। তাছাড়া এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী দ্রুত সম্পদশালী হওয়ার আশায় বিভিন্ন অনৈতিক ও গর্হিত কাজ করছে; প্রতারণা, ওজনে কম দেওয়া, কালোবাজারি, মজুদদারি, ভেজাল মিশ্রণ, মিথ্যা শপথ ইত্যাদির মধ্য দিয়ে অসুস্থ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে। ফলে কিছু মানুষ রাতারাতি ধনী হচ্ছে, অপরদিকে সমাজের অধিকাংশ মানুষ তাদের দ্বারা শোষিত হয়ে অর্থনৈতিক বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। ইসলামে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এসব বিষয়কে সম্পূর্ণরূপে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। ব্যবসায়ী মহলকে এসব বিষয়ে সচেতন ও সাবধান করা এখন সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে।
বাংলায় ব্যবসা ও বাণিজ্য ইংরেজি কমার্স এর প্রতিরূপ, যা ফরাসি কড়স’ৎবং শব্দ থেকে এসেছে। এর অর্থ জীবিকা, বৃত্তি, পেশা, কারবার, যত্ন, উদ্যম, চেষ্টা, অভিপ্রায়, উদ্দেশ্য, অনুসন্ধান, ব্যবহার, আচরণ, সওদাগরি ইত্যাদি। ব্যবসা শব্দের আরও একটি ইংরেজি প্রতিশব্দ ইঁংরহবংং, যা প্রাচীন ইুংরহম শব্দ থেকে এসেছে। যার অর্থ যে কোন কাজে ব্যস্ত থাকা। তবে সব ব্যস্ততাকে ব্যবসা বলা যায় না। শুধু অর্থ উপার্জনের উদ্দেশ্যে সামাজিক ও আইনগতভাবে বৈধ কর্মপ্রচেষ্টাকে সাধারণভাবে ব্যবসা বলা যায়। এ ধরনের কর্মপ্রচেষ্টা চাই ব্যক্তিগত পর্যায়ে সংগঠিত হোক কিংবা হোক প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে। ব্যবসার আরবী তিজারাত পরিভাষাটি বহুল প্রচলিত।
ইমাম রাগিব (রহ.) তিজারত শব্দের অর্থ করেছেন, মুনাফা লাভের উদ্দেশ্যে মূলধন বিনিয়োগ ও ব্যবহার করা। সাইয়্যেদ সাবেক রহ. বলেন, ‘পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে পণ্যের বিনিময়ে পণ্যের হস্তান্তর অথবা অনুমোদিত উপায়ে বিনিময়ের দ্বারা মালিকানার স্থানান্তরকে ব্যবসা বলে।’
ঐতিহাসিক ও সমাজবিজ্ঞানী ইবনে খলদুন রহ. বলেন, ‘সস্তায় পণ্য ক্রয় করে বেশি দামে বিক্রি করে মূলধনে প্রবৃদ্ধি ঘটানোর মাধ্যমে উপার্জনের প্রচেষ্টাই হল ব্যবসা।’
অর্থশাস্ত্রের পরিভাষায় ব্যবসা এক ধরনের সামাজিক কর্মকাণ্ড (বিজ্ঞান), যেখানে নির্দিষ্ট সৃষ্টিশীল ও উৎপাদনীয় লক্ষ্যকে সামনে রেখে বৈধভাবে সম্পদ উপার্জন বা লাভের উদ্দেশ্যে লোকজনকে সংগঠিত করা হয় ও তাদের উৎপাদনীয় কর্মকাণ্ড রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়। ব্যক্তির মুনাফা পাওয়ার আশায় পণ্যদ্রব্য ও সেবাকর্ম উৎপাদনের মাধ্যমে উপযোগ সৃষ্টি এবং মানুষের বস্তুগত ও অবস্তুগত অভাব পূরণের লক্ষে সেগুলো বণ্টন এবং এর সহায়ক সবরকম বৈধ, ঝুঁকিবহুল ও ধারাবাহিক কার্যকে ব্যবসায় বলে।
অবশ্য আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গিতে পণ্যদ্রব্য ও সেবাসামগ্রী উৎপাদন ও বিক্রয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত সবাই কোনো না কোনোভাবে ক্রয়-বিক্রয় কাজে জড়িত। তাই মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে সকল ধরনের ক্রয়-বিক্রয় কার্যকেই ব্যবসা বলা হয়।
হালাল শব্দের আভিধানিক অর্থ বিধিসঙ্গত, বিধিসিদ্ধ, আইনসঙ্গত, বৈধ। সাহাবীগণ রাসূলুল্লাহ্ এর কাছে হালাল সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বললেন, ‘আল্লাহ্ তাআলা পবিত্র কুরআনে যা কিছু বৈধ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন তাই হালাল।’ আল্লামা ইউসুফ আল-কারযাভী রহ. বলেন, ‘হালাল অর্থ মুবাহ, যা নিষেধের অর্গলমুক্ত এবং শরী’আহ প্রবর্তক যা করার অনুমতি দিয়েছেন।’
কুরআন ও হাদীসে যেসব বস্তুকে বৈধ বলে ঘোষণা করা হয়েছে, সেসব বস্তু ইসলামী শরী’আত প্রবর্তিত নিয়মানুযায়ী বাজারজাতকরণের মাধ্যমে পণ্য আদান-প্রদান করে উপার্জনের প্রচেষ্টাকে হালাল ব্যবসা বলে।
আল্লাহ্ তাআলা মানুষকে একমাত্র তাঁর ইবাদতের জন্যই সৃষ্টি করেছেন। শুধু নামায, রোযা, হজ্জ ও যাকাত আদায় করার নামই ইবাদত নয়; বরং আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের হুকুম অনুসারে যখন যা করা হবে তাই ইবাদতরূপে গণ্য হবে। ব্যবসা-বাণিজ্য হচ্ছে হালাল উপার্জনের অন্যতম পন্থা। তাছাড়া হালাল উপার্জন ইবাদত কবুলের আবশ্যিক পূর্বশর্ত। এজন্য রাসূলুল্লাহ্, খুলাফায়ে রাশেদীন, আশরায়ে মুবাশ্শারাসহ অধিকাংশ সাহাবী হালাল ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করতেন। কারো ব্যবসা-বাণিজ্য ও আয়-রোজগার যদি হারাম হয় তার কোনো আমল ও দু’আ আল্লাহর কাছে কবুল হয় না। এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ্ বলেন, হে লোকেরা, আল্লাহ্ তাআলা হলেন পূতঃপবিত্র। কাজেই তিনি পবিত্র ছাড়া অপর কিছুই গ্রহণ করেন না। আর তিনি মু’মিনদেরকে সে নির্দেশই দিয়েছেন, যা তিনি তাঁর রাসূলগণকে দিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘হে রাসূলগণ, তোমরা পবিত্র বস্তু ভক্ষণ করো এবং সৎ কর্ম করো। আমি তোমাদের কার্যকলাপ সম্পর্কে সম্যক অবহিত।’ তিনি আরো বলেন, ‘হে মু’মিনগণ, তোমরা আমার প্রদত্ত রিয্ক থেকে পবিত্র বস্তুগুলোই ভক্ষণ করো।’ তারপর তিনি এমন ব্যক্তির কথা উল্লেখ করেন যে দীর্ঘ সফর শেষে মলিন শরীরে দু’হাত বাড়িয়ে আল্লাহ্র কাছে প্রার্থনা করে, হে আমার রব, হে আমার রব! (এভাবে দু’আ করতে থাকে) অথচ তার আহার্য হারাম, তার পানীয় হারাম, তার পোশাক হারাম, অধিকন্তু সে হারাম দ্বারা পরিপুষ্ট হয়েছে, তা হলে কীভাবে তার দু’আ কবুল হতে পারে।
একজন মু’মিন হালাল ও বৈধ উপায়ে ব্যবসা-বাণিজ্য ও আয়-উপার্জন করবে এবং তাকে সন্দেহযুক্ত যাবতীয় বিষয় থেকেও বিরত থাকতে হবে। এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ্ বলেন, ‘নিশ্চয়ই হালাল সুস্পষ্ট এবং হারামও সুস্পষ্ট। তবে এতদুভয়ের মধ্যে কতিপয় সন্দেহজনক বিষয় রয়েছে, যা অনেক লোকেই জানে না। অতএব, যে ব্যক্তি সন্দেহজনক বিষয় থেকে নিজেকে রক্ষা করলো, সেই মূলত নিজের দীন ও ইয্যাত-আব্রুকে রক্ষা করলো।’
রাসূলুল্লাহ হালাল ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে উপার্জন সন্ধান করাকে ফরয হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘হালাল রুজি সন্ধান করা মৌলিক ফরযের পর একটি ফরয।’
অপর হাদীসে নিজ হাতে কাজ করা এবং হালাল পথে ব্যবসা-বাণিজ্য করে উপার্জন করাকে সর্বোত্তম উপার্জন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। হযরত রাফে ইব্ন খাদীজ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ এর কাছে জিজ্ঞেস করা হলো, হে আল্লাহর রাসূল! কোন ধরনের উপার্জন সর্বোত্তম? তিনি বললেন, ‘নিজ হাতে কাজ করা এবং হালাল পথে ব্যবসা করা।’
আল্লামা আশ-শারকাভী রহ. তার হাশিয়াতে বলেন, রাসূলুল্লাহ বলে হালাল ব্যবসার দিকে ইঙ্গিত করেছেন।
ইসলাম বিশ্বস্ত ও সত্যবাদী ব্যবসায়ীকে অত্যন্ত সম্মান প্রদর্শন করেছে। রাসূলুল্লাহ্ বলেন, ‘বিশ্বস্ত সত্যবাদী মুসলিম ব্যবসায়ী কিয়ামতের দিন শহীদগণের সঙ্গে থাকবে।’
একবার বিশিষ্ট তাবিঈ ইবরাহিম আন-নাখঈ রহ.-কে জিজ্ঞেস করা হয় যে, এক ব্যক্তি ব্যবসা-বাণিজ্য ছেড়ে কেবল আল্লাহ্র ধ্যানেই নিমগ্ন থাকে আর অপর এক ব্যক্তি ব্যবসা-বাণিজ্য করে, তাদের মধ্যে কে উত্তম? তিনি জবা দিলেন, ‘বিশ্বস্ত ব্যবসায়ীই।’
রাসূলুল্লাহ্ হালাল উপায়ে রুজি-রোযগার ও ব্যবসা-বাণিজ্য করাকে জিহাদের অন্তর্ভূক্ত বলে অভিহিত করেছেন। যেমন আবদুল্লাহ্ ইবনু আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘হালাল রুজি তালাশ করা (তথা হালাল উপায়ে ব্যবসা-বাণিজ্য করা) জিহাদের সমতুল্য।’
ব্যবসা-বাণিজ্য, লেন-দেন, ক্রয়-বিক্রয় ইত্যাদি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে ইসলামের সুনির্দিষ্ট দিক-নির্দেশনা রয়েছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, মুদ্রাস্ফীতি, লেনদেনে প্রতারণা, ব্যবসা-বাণিজ্যে অসাধুপন্থা অবলম্বন ইত্যাদি বিষয়ে ইসলামের এসব দিক-নির্দেশনার অনুসরণ মানুষের জাগতিক ও পারলৌকিক জীবনের সফলতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইসলামের এসব দিক-নির্দেশনা ক্রেতা-বিক্রেতা, শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, আমদানি-রপ্তানিতে নিয়োজিত লোকজনসহ সকল মানুষের জন্য অনুসরণীয়। ইসলামী অর্থব্যবস্থায় হালাল ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য যাবতীয় অন্যায় ও অনৈতিক কার্যাবলি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ইসলামের এসব দিক-নির্দেশনা অবলম্বনের মাধ্যমেই শোষণ-বঞ্চিত ও সুখী-সমৃদ্ধ একটি সুন্দর সমাজ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।
লেখক ঃ শিক্ষাবিদ, গবেষক।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন