সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) ভিসি প্রফেসর ফরিদ উদ্দিন আহমেদের পদত্যাগের দাবিতে টানা সাতদিন পর অনশন ভেঙেছেন শিক্ষার্থীরা। অনশনে অসুস্থ হয়ে পড়ায় শিক্ষার্থীদেরকে স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। গতকাল বুধবার সকালে অনশন ভাঙার পরও আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। তবে নতুন করে কি কর্মসূচি পালন করা হবে তা শিগগিরই বসে ঘোষণা করা হবে বলে জানিয়েছেন তারা। এদিকে শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের হামলা দুঃখজনক মন্তব্য করে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি বলেছেন, শিক্ষার্থীদের সাথে আলোচনা চলছে, তাদের দাবি বাস্তবায়নের চেষ্টা করা হবে। হলের সব সমস্যার সমাধান করা হবে, শিগগিরই ক্যাম্পাস খুলে দেয়া হবে। তবে ভিসি অপসারণ একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া, ভিসির থাকা না থাকা প্রেসিডেন্টের এখতিয়ার। এছাড়া আটক শাবিপ্রবির সাবেক ৫ শিক্ষার্থীর জামিন মঞ্জুর করা হয়েছে বলেও জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী ছাত্রী হলের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অসদাচরণের অভিযোগ তুলে গত ১৩ জানুয়ারি রাতে আন্দোলনে নামেন ওই হলের শিক্ষার্থীরা। এর জেরে পুলিশের লাঠিপেটা, কাঁদানে গ্যাস, রাবার বুলেট ও সাউন্ড গ্রেনেডে শিক্ষার্থীসহ ক্যাম্পাসের অন্তত অর্ধশত লোকজন আহত হন। সে ঘটনায় পুলিশ ‘গুলি বর্ষণ ও হত্যার উদ্দেশ্যে মারপিটের অভিযোগ’এনে অজ্ঞাতপরিচয় ২০০ থেকে ৩০০ শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে মামলা করে। তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করে শিক্ষার্থীদের হল ছাড়ার নির্দেশ দেয় কর্তৃপক্ষ। কিন্তু সেই নির্দেশ উপেক্ষা করে উল্টো ভিসি ফরিদ উদ্দিন আহমেদের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। একপর্যায়ে তারা অনশনে যান; ঘোষণা দেন ভিসি পদত্যাগ না করা পর্যন্ত অনশন চালিয়ে যাওয়ার। সাতদিন পর গতকাল বুধবার সকাল সাড়ে ১০টায় শিক্ষার্থীদের পানি পান করিয়ে অনশন ভাঙান শাবিপ্রবির সাবেক দুই শিক্ষক প্রফেসর মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও তার স্ত্রী প্রফেসর ইয়াসমিন হক।
এসময় জাফর ইকবাল বলেন, ছাত্রদের আন্ডার এস্টিমেট করবেন না। কে কাকে কার কার কাছে রেখে যাচ্ছি সেটা সময় বলে দিবে। এর আগে বুধবার ভোররাতে শাবির অনশনস্থলে অভুক্ত শিক্ষার্থীদের অনশন ভাঙাতে যান বিশ্ববিদ্যালয়টির সাবেক এই শিক্ষক। সেখানে মুহম্মদ জাফর ইকবাল বলেন, আমি তোমাদেরকে না খায়িয়ে এখান থেকে যাবো না। তোমরা জানো না তোমরা কি করেছো। ৩৪ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির ঘুম নষ্ট হয়ে গেছে।
তিনি বলেন, তোমরা যেটা করেছো, আমি আশা করি সেটা বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে একটা মোডিফিকেশন হউক। সবাই যেন নতুন করে অ্যানালাইসিস করে যে আমি যে মানুষটাকে ভিসি হিসেবে পাঠিয়েছি, তিনি কি ভিসি হওয়ার উপযুক্ত? তোমরা যেটা করেছো সেটার কোনো তুলনা নেই। তোমরা যে আন্দোলনটা গড়ে তুলেছো সারা বাংলাদেশের যুবক ছেলেপেলেরা তোমাদের সাথে আছে। গণমাধ্যমের সামনে জাফর ইকবাল বলেন, এই ধরণের আন্দোলন যেটা হয়েছে সেটা আমাদের দেশের কোনো রাজনৈতিক দল গড়ে তুলতে পারবে না।
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের দাবি শতভাগ যৌক্তিক দাবি করে তিনি বলেন, আমি জেনেছি ওরা একেবারেই সাধারণ শিক্ষার্থী। পুলিশ এদের ওপর এরকম নির্মমভাবে হাত তুলেছে কাজেই এদের মনের ভিতর একটা ক্ষোভ রয়েছে সংগত কারণে। সেজন্য তারা এই আন্দোলনটা করেছে। এর ভিতরে বিন্দুমাত্র বাড়াবাড়ি নেই।
ভিসির পদত্যাগের বিষয়ে জানতে চাইলে জাফর ইকবাল বলেন, সরকারের নিজস্ব টেকনিক্যাল ব্যাপার থাকে, রাজনৈতিক ব্যাপার থাকে। সেটার জন্য তাদের প্রক্রিয়া থাকে। আমি এখানে আসার আগে আমার সাথে সরকারের উপর মহলের কথা হয়েছে। তাদের সাথে কথা বলে আমি এখানে এসেছি। আমি তাদেরকে অনুরোধ করবো তারা আমাকে যে কথাগুলো দিয়েছেন সেগুলো যেন রক্ষা করে। আমি আর এই ছাত্রদের ভিতরে কোনো পার্থক্য নেই। কাজেই যদি আমার কথা রক্ষা করা না হয় তাহলে আমি বুঝে নিব তারা শুধু এই ছাত্রদের সাথে না আমার সাথে এবং এদেশের প্রগতিশীল যত মানুষ আছে সবার সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করেছে।
অনশন ভাঙার পর আন্দোলনকারী সবুর খান বলেন, রাতে কেউ ঘুমায়নি। শিক্ষার্থীরা সবাই ক্লান্ত, বিশ্রামে গেছে। অনশন ভাঙলেও আন্দোলন চলবে। নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। আমিনা নামের আরেক শিক্ষার্থী বলেন, অনশনরত ছিলেন ২৮ জন। এর মধ্যে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে রাগিব-রাবেয়া হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গেছে ২৪ জন; বাকি ৪ জন বাড়িতে গেছেন। তারা বাড়িতে থেকেই চিকিৎসা নেবেন। ভর্তি হওয়া ছয়জনের মধ্যে তিনজনের প্রচণ্ড জ্বর ও খিঁচুনি আছে। বাকিরা চিকিৎসা নিয়ে সন্ধ্যায় হাসপাতাল থেকে রিলিজ নেবে। অনেকে সাময়িক চিকিৎসা করে বাড়িতে গিয়ে চিকিৎসা নেবে বা অন্য কোথাও গিয়ে।
শিক্ষামন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলন:
শাবিপ্রবির চলমান ঘটনার মধ্যে গতকাল সন্ধ্যায় হেয়ার রোডের সরকারি বাসভবনে সংবাদ সম্মেলন করেন শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি। তিনি বলেন, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সমস্যাগুলোর সমাধান করা হবে। শিক্ষার্থীদের সমস্যা সমাধানের জন্য তাঁদের সঙ্গে বসে সমস্যাগুলো শুনে সমাধান করতে চান। এ জন্য শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বসতেও তিনি প্রস্তুত আছেন।
ভিসির পদত্যাগের বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, একজন ভিসি থাকলেন কি থাকলেন না সেটি কিন্তু তাদের (শিক্ষার্থীদের) সমস্যা সমাধানে প্রভাব থাকছে না। একজন ভিসি চলে গেলে, আরেকজন ভিসি আসবেন। কিন্তু তাদের সমস্যা যদি থেকে গেল, তাহলে তো তাদের কোনো লাভ হলো না। আমরা সমস্যার সমাধান করব।’
এ বিষয়ে দীপু মনি আরও বলেন, ভিসির ব্যাপারে অন্য নানা পদ্ধতি আছে। প্রেসিডেন্ট ও চ্যান্সেলর এ দায়িত্ব ন্যস্ত করেন। কাজেই এটা ভিন্ন প্রক্রিয়া। সেই প্রক্রিয়াকে ভিন্নভাবে দেখব। আমরা তাদের (শিক্ষার্থীদের) যত সমস্যা আছে সেগুলো সমাধান করব। আর এ ব্যাপারে (ভিসির পদত্যাগ বা সরিয়ে দেওয়া) আমরা দেখব, আমাদের পক্ষে কি করা সম্ভব।’
শিক্ষামন্ত্রী শিক্ষার্থীদের আন্দোলন থেকে সরে আসার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, আন্দোলনের সময় যে মামলাগুলো হয়েছে তা শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যতের ওপর কোনো প্রভাব থাকবে না। মামলাগুলো তুলে নেওয়ার বিষয়ে তিনি কথা বলবেন। এদিকে শাবিপ্রবির আন্দোলনে অর্থ সহায়তা প্রদানের অভিযোগ আটক সাবেক পাঁচ জন শিক্ষার্থী জামিন পেয়েছেন বলে নিশ্চিত করেছেন শিক্ষামন্ত্রী। ভিসি ফরিদ উদ্দিন আহমেদের পদত্যাগের আন্দোলনে অর্থ সহায়তা দেওয়ায় ঢাকা থেকে তাদের গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ।#
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন