গাছপালা ও জলাধার থাকায় সবচেয়ে কম দূষিত জেলার
শীর্ষে মাদারীপুর
বিষাক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস নিচ্ছে বাংলাদেশের মানুষ। দেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে ৫৪টি জেলার বাতাসই দূষিত। এর মধ্যে গাজীপুর, ঢাকা এবং নারায়ণগঞ্জের বাতাস চরম অস্বাস্থ্যকর। ভয়াবহ বায়ুদূষণের কারণে চরম স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে আছেন এসব শহরের মানুষ। দূষিত বাতাসের ফলে নানা রোগ-ব্যাধি ছড়াচ্ছে, অকালমৃত্যু হচ্ছে অনেকের। এ ছাড়া বায়ুদূষণের কারণে সারা দেশে মানুষের গড় আয়ু কমেছে প্রায় পাঁচ বছর চার মাস। তবে রাজধানী ঢাকায় কমেছে প্রায় সাত বছর সাত মাস। বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠন এ দাবি করেছে।
তবে জাতীয় প্রেসক্লাবে গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে দেশব্যাপী ৬৪ জেলার ‘বায়ুমান সমীক্ষা-২০২১’ শীর্ষক গবেষণার একটি প্রতিবেদন তুলে ধরে বায়ুমÐলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস)। স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান ও গবেষক অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার এ প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে বায়ুদূষণে শীর্ষে রয়েছে গাজীপুর। দূষণের দিক থেকে এখানে বায়ুমান প্রতি ঘনমিটারে ২৬৩ দশমিক ৫১ মাইক্রোগ্রাম। এছাড়া ঢাকা দ্বিতীয় ও নারায়ণগঞ্জ জেলা তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে। অপরদিকে প্রতি ঘনমিটারে ৪৯ দশমিক শূন্য ৮ মাইক্রোগ্রাম নিয়ে সবচেয়ে কম দূষিত শহরের শীর্ষে রয়েছে মাদারীপুর জেলা। এরপরই রয়েছে যথাক্রমে পটুয়াখালী এবং মেহেরপুর।
চলতি বছরের শুরু থেকে বিশ্বের মধ্যে বায়ুদূষণের শীর্ষ শহরের তালিকায় রয়েছে রাজধানী ঢাকা। গত জানুয়ারি মাসের ২১ দিনই ঢাকার বাতাস ছিল অস্বাস্থ্যকর। এর মধ্যে ১৯ থেকে ২২ জানুয়ারি এ ৪ দিন টানা বায়ুদূষণে বিশ্বের শীর্ষ দূষিত শহরের তালিকা ছিল ঢাকা।
তবে ক্যাপসের গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকাকে ছাড়িয়ে এবার বায়ুদূষণের শীর্ষ শহরের তালিকায় উঠে এসেছে গাজীপুর। বিআরটি প্রকল্পের কাজের জন্য দীর্ঘদিন যাবত টঙ্গী থেকে গাজীপুর এলাকার রাস্তার বেহাল দশা। রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি আর ভাঙাচোরার কারণে ওই এলাকা এখন ধুলায় ধূসর। এ ছাড়া বিভিন্ন শিল্প কারখানার কালো ধোঁয়া, ইটভাটার ধোঁয়া সব মিলিয়ে গাজীপুরের বাতাস এখন বিষাক্ত।
ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ জেলার বিষয়ে বলা হয়, এ দুই জেলার বাতাসও অস্বাস্থ্যকর। এ দুই শহরের বায়ুমান ছিল যথাক্রমে ২৫২ দশমিক ৯৩ এবং ২২২ দশমিক ৪৫ মাইক্রোগ্রাম। সবচেয়ে দূষিত তিনটি শহরের বায়ুমান ছিল বাংলাদেশের আদর্শমানের চেয়ে প্রায় ৪-৫ গুণ বেশি। গবেষণার ফল অনুযায়ী বায়ুদূষণে পরের অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে- হবিগঞ্জ, নোয়াখালী, টাঙ্গাইল, কক্সবাজার, চাঁদপুর, চট্টগ্রাম এবং কিশোরগঞ্জ।
অপরদিকে প্রচুর পরিমাণ গাছপালা ও জলাধার থাকায় সবচেয়ে কম দূষিত শহর অর্থাৎ বিশুদ্ধ বাতাসের জেলা হচ্ছে মাদারীপুর। যার বায়ুমান ছিল প্রতি ঘনমিটারে ৪৯ দশমিক শ‚ন্য ৮ মাইক্রোগ্রাম। এর পরের অবস্থানে রয়েছে পটুয়াখালী এবং মেহেরপুর জেলা। গবেষণা প্রতিবেদনে ৬৪ জেলার মধ্যে ১০টি জেলায় বায়ুমান ভালো, ৩৬টি জেলার বায়ুমান মধ্যম মানের এবং ১৮টি জেলার বায়ুমান অতিরিক্ত দূষিত বলে উল্লেখ করা হয়।
ভালো বায়ুমানের জেলা হচ্ছে কুড়িগ্রাম, নাটোর, জয়পুরহাট, রাজবাড়ী, রাজশাহী, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, মেহেরপুর, পটুয়াখালী এবং মাদারীপুর। মধ্যমানের দূষিত বায়ুর জেলা যশোর, মুন্সিগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, শেরপুর, নেত্রকোনা, বরগুনা, খাগড়াছড়ি, সিলেট, গোপালগঞ্জ, নরসিংদী, ময়মনসিংহ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ফেনী, ঠাকুরগাঁও এবং জামালপুর। অতিরিক্ত দূষিত বায়ুর জেলা: গাজীপুর, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, হবিগঞ্জ, নোয়াখালী, টাঙ্গাইল, কক্সবাজার, চাঁদপুর, চট্টগ্রাম, কিশোরগঞ্জ, মৌলভীবাজার, ল²ীপুর, পঞ্চগড়, ময়মনসিংহ, ব্রাক্ষণবাড়িয়া, ফেনী, ঠাকুরগাঁও এবং জামালপুর।
ক্যাপসের গবেষণা থেকে উঠে আসে ৮টি বিভাগীয় শহরের মধ্যে বায়ুদূষণের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে ঢাকা শহর, সেখানে গড়ে অতিক্ষুদ্র বস্তুকণার উপস্থিতির পরিমাণ ছিল প্রতি ঘনমিটারে ২৫২ দশমিক ৯৩ মাইক্রোগ্রাম। বিভাগীয় শহরগুলোর মধ্যে বায়ুদূষণের তালিকায় সর্বনিম্নে রয়েছে রাজশাহী শহর, সেখানে গড়ে অতিক্ষুদ্র বস্তুকণা ছিল প্রতি ঘনমিটারে ৫৬ দশমিক ১ মাইক্রোগ্রাম। দূষণ অনুযায়ী বিভাগীয় জেলা শহরগুলোর ক্রম হচ্ছে ঢাকা-চট্টগ্রাম-ময়মনসিংহে-সিলেট-বরিশাল-রংপুর-খুলনা-রাজশাহী।
বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ হিসেবে গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়- রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি, সংস্কার কাজ, মেগা প্রকল্প, আশপাশের ইটভাটা, ছোট-বড় কয়েক হাজার শিল্পকারখানা, ফিটনেসবিহীন যানবাহনের কালো ধোঁয়া এবং ময়লা-আবর্জনা পোড়ানো ইত্যাদি।
ক্যাপস এ ভয়াবহ বায়ুদূষণ রোধে ১৫ দফা সুপারিশ পেশ করেছে। এগুলো হচ্ছেÑ শুষ্ক মৌসুমে সিটি করপোরেশন, ফায়ার সার্ভিস, ওয়াসা এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের সমন্বয়ে দূষিত শহরগুলোতে প্রতিদিন ২-৩ ঘণ্টা পর পর পানি ছিটানো। নির্মাণ কাজের সময় নির্মাণ স্থান ঘেরাও দিয়ে রাখা ও নির্মাণ সামগ্রী পরিবহনের সময় ঢেকে নেয়ার ব্যবস্থা করা। রাস্তায় ধুলা সংগ্রহের জন্য সাকশন ট্রাকের ব্যবহার করা। অবৈধ ইটভাটা বন্ধ করে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার এবং বিকল্প ইটের প্রচলন বাড়ানো। ব্যক্তিগত গাড়ি এবং ফিটনেসবিহীন গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করে প্রয়োজনে নম্বর প্লেট অনুযায়ী জোড়-বিজোড় পদ্ধতিতে গাড়ি চলাচলের প্রচলন করা। সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে প্রচুর গাছ লাগাতে হবে এবং ছাদবাগান করার জন্য সবাইকে উৎসাহিত করা। আলাদা সাইকেল লেনের ব্যবস্থা করা। দূষিত শহরগুলোর আশপাশে জলাধার সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা। আগুনে পোড়ানো ইটের বিকল্প হিসেবে সেন্ড বøকের ব্যবহার ক্রমান্বয়ে বাড়াতে হবে। সিটি গভর্নেন্স এর প্রচলনের মাধ্যমে উন্নয়নমূলক কার্যকলাপের সমন্বয় সাধন করা। নির্মল বায়ু আইন-২০১৯ যত দ্রæত সম্ভব বাস্তবায়ন করা। পরিবেশ সংরক্ষণ ও সচেতনতা তৈরির জন্য পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক বাজেট বরাদ্দ বাড়াতে হবে। গণপরিবহনসহ ট্রাফিক ব্যবস্থার উন্নয়ন করা। গণমাধ্যমে বায়ুদূষণ সম্পর্কে আরো বেশি তথ্য-নির্ভর অনুষ্ঠান প্রচারের ব্যবস্থা করা। পরিবেশ ক্যাডার সার্ভিস এবং পরিবেশ আদালত চালু ও কার্যকরের ব্যবস্থা করা।
সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বলেন, গবেষণাটির গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন থাকার কথা নয়। সরকার এলাকাগুলো ক্যাটাগরি করে রেখেছে। সেটা মাথায় রেখেই ডাটা নিয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জসিম উদ্দিন বলেন, এটা একটি বেজলাইন স্টাডি। তাই এটি নিয়ে আরো কাজ করা উচিত।
সংবাদ সম্মেলনে আরো উপস্থিত ছিলেন স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের উপাচার্য অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী নকি, পরিবেশ অধিদফতরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক কাজী সারওয়ার ইমতিয়াজ হাশমি প্রমুখ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন