একটি সরকার কত শক্তিশালী তা নির্ভর করে স্থানীয় পর্যায়ে দল কত সুসংগঠিত তার ওপর। স্থানীয় সরকারের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি)। এ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় হয়ে থাকে দলীয় মার্কায়। ফলে স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোর রাজনৈতিক গুরুত্ব আগের চেয়ে এখন অনেক বেশি। মাঠের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি স্থানীয় নির্বাচনগুলো বর্জন করায় গত কয়েক বছর ধরে আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকার প্রার্থীরা ব্যাপকভাবে নির্বাচিত হন। ‘নৌকার প্রার্থী হলেই বিজয়’ নির্বাচনগুলোতে নিয়মে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু সেই নিয়মে জ্যোতিচিহ্ন এঁকে দিয়েছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীরা।
দেশে কয়েক ধাপে অনুষ্ঠিত ইউপি নির্বাচনগুলো পর্যালোচনা করে দেখা যায়, প্রায় ৫০ শতাংশ স্বতন্ত্রপ্রার্থী চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হয়েছেন। এদের বেশির ভাগই আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী নৌকার বিপক্ষ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। তৃণমূল পর্যায়ে এত বিদ্রোহী প্রার্থীর বিজয় মাঠ পর্যায়ে ক্ষমতাসীন দলটির কোন্দলের চিত্র ধরা দিয়েছে। বিশিষ্টজনদের অনেকেই এজন্য টাকা নিয়ে দলীয় মনোনয়ন বিক্রি, তৃণমূলে চাঁদাবাজী, দখলবাজী, ঘুষ-দুর্নীতিকে দায়ী করছেন। কিছু বিদ্রোহী নেতা জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের নেতাদের রিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ তুলেছেন। তৃণমূল পর্যায়ে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে এত মতোভেদ দলাদলি দলটির নীতি নির্ধারকদের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে।
দীর্ঘদিন থেকে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের মাঠ পর্যায়ের সক্রিয় নেতাদের মূল্যায়ন করে দলটির বি-টিম হিসেবে পরিচিত জাতীয় সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি মহাসচিব মো. মুজিবুল হক চুন্নু এমপি বলেছেন, ‘বছরের পর বছর ধরে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা এমনভাবে লুটপাট করছেন যাতে আগামী বিশ-ত্রিশ বছরে তাদের আর অর্থের অভাব হবে না। আওয়ামী লীগ কর্মীরা লুটতরাজ ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারছে না’।
২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর বেশির ভাগ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা বিজয়ী হয়ে আসেন। দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে ধারণা জন্মে নৌকার প্রার্থী হলেই বিজয় সুনিশ্চিত। এবার সেই বিশ্বাসে ফাটল ধরেছে। নৌকার প্রার্থীরা আশানুরূপ ভালো ফলাফল করতে পারেনি। বিএনপি নির্বাচনে না আসলেও দলের নেতারা স্বতন্ত্রপ্রার্থী হিসেবে চেয়ারম্যান হয়েছেন। তবে বেশি ভালো করেছেন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীরা নৌকার বিরুদ্ধে লড়াই করে। প্রায় সাড়ে ৫ হাজার বিদ্রোহীর মধ্যে দলের বহিষ্কারের চাপ, প্রশাসনের চাপের পরও প্রায় ১৩০০ প্রার্থী নির্বাচিত হয়েছেন। দলের প্রতীকের বাইরে ব্যক্তি জনপ্রিয়তায় চেয়ারম্যান হয়েছেন তারা। তবে স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত প্রতিনিধি ও জনপ্রিয় এ নেতাদের চূড়ান্ত বহিষ্কার নিয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে রয়েছে আওয়ামী লীগের হাই-কমান্ড। আগামীতে দলের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে বিদ্রোহীদের প্রাথমিক ক্ষমা করা হবে এমন সিদ্ধান্ত আসতে পারে বলে আভাস পাওয়া গেছে।
তবে এ নিয়ে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে যাচ্ছে ক্ষমতাসীনরা। কারণ দলের সিদ্ধান্ত ছিল যারা দলের সিদ্ধান্ত না মেনে নির্বাচন করবে তাদের দল থেকে বহিষ্কার করা হবে। এ নিয়ে নির্বাচন চলাকালীন হাজারের বেশি নেতাদের প্রাথমিক বহিষ্কার করেছে আওয়ামী লীগ। দলের পরবর্তী কার্যনির্বাহী কমিটিতে বহিষ্কারের বিষয়ে চূড়ান্ত করতে হবে। তাহলে প্রায় ৫ হাজার নেতাকর্মীদের চূড়ান্ত বহিষ্কার করতে হবে আওয়ামী লীগকে। আবার নির্বাচনকালীন সময়ে বহিষ্কারের ঘোষণা দিয়ে এখন সে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হলে পরবর্তী নির্বাচনে দলের শৃঙ্খলা থাকবে কী না কিংবা ভবিষ্যতে দলের সিদ্ধান্ত সবাই মানবে কী না এবং জাতীয় নির্বাচনে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করবে কী না সে বিষয়েও শঙ্কা তৈরি হয়েছে। তাই প্রাথমিকভাবে বিদ্রোহীদের ক্ষমা করা হবে বলে জানা গেছে।
এছাড়া বিদ্রোহীদের যারা মদদ দিয়েছেন, যাদের কারণে নৌকার প্রার্থীরা হেরেছেন তাদের বিরুদ্ধেও কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না। যদিও নির্বাচনের সময় দলের হাই-কমান্ড কঠোর ছিলেন। বিদ্রোহীদের বহিষ্কারের বিষয়ে সরাসরি ঘোষণা দিয়েছেন। সেই ঘোষণা ও নির্দেশনার কারণে তৃণমূল সংগঠন হাজার হাজার নেতাকর্মীদের বহিষ্কারও করেছে।
দলীয় সূত্রে জানা যায়, বিব্রতকর এ অবস্থায় দলের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে যাচ্ছে আওয়ামী লীগের হাই কমান্ড। দলের নেতাকর্মীদের বিশাল একটি অংশকে বহিষ্কার করা কোনোভাবেই দলের জন্য মঙ্গলজনক হিসেবে দেখছে না দলের নীতিনির্ধারকরা। তাই প্রাথমিকভাবে বিদ্রোহীদের ক্ষমা করে দেয়া হবে বলে জানা গেছে। তবে দলের পরবর্তী কোনো নির্বাচনে নৌকা প্রতীক পাবেন না এবং দলের গুরুত্বপূর্ণ কোনো পদে থাকতে পারবেন না। তবে নৌকা প্রতীক নিয়ে যারা বিদ্রোহীর কাছে পরাজিত হয়েছেন সেইসব নেতাদের অভিযোগের কোনো জবাব থাকবে না কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে। সেই কারণেও বিব্রত কেন্দ্রীয় নেতারা।
তবে দলের এমন সিদ্ধান্ত জানার পর হতাশা ব্যক্ত করছেন দলের নেতাকর্মীরা। বিশেষ করে বিদ্রোহী প্রার্থী এবং তাদের ইন্দনদাতাদের কারণে যারা নৌকা প্রতীক পেয়েও হেরেছেন তারা খুবই হতাশ। তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অনেক ইউনিয়নে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীরা এত কম ভোট পেয়েছেন যে তাদের জামানত হারাতে হয়েছে।
সূত্র জানায়, ৬ ধাপে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী ৫২০০ জন, চেয়ারম্যান পদে বিজয়ী হয়েছেন ১২৩০ জন। এর মধ্যে নিজ দলের প্রার্থীকে হারিয়ে বিজয়ী হয়েছেন ১ হাজার দুইশত ৩০ জন। ষষ্ঠ ধাপে ২১৬টি ইউপিতে আওয়ামী লীগের ১১৭টি, স্বতন্ত্রপ্রার্থী ৯৫টি। ৬ জানুয়ারি পঞ্চম ধাপের ৬৯২টি ইউনিয়নের মধ্যে নৌকা ৩৪১টি, স্বতন্ত্রপ্রার্থী ৩৪৬টি ইউনিয়নে জয় পেয়েছেন। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহীই ৩৩৮ জন। চতুর্থ ধাপে ৭৯৭টি ইউপিতে নৌকা ৩৫০টিতে, স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জিতেছেন ৩৮৯টিতে। তৃতীয় ধাপে অনুষ্ঠিত ১০০৮ ইউপি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীরা নৌকা প্রতীক নিয়ে ৫২৫টি ইউপিতে চেয়ারম্যান পদে জয়লাভ করেছেন। বিপরীতে ৪৮৩টি ইউপিতে স্বতন্ত্রসহ অনান্য দল থেকে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। দ্বিতীয় ধাপের ৮৩৪টির মধ্যে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীরা নৌকা প্রতীক নিয়ে ৪৮৬টি ইউপি ও ৩৪৮টি ইউপিতে জয় পান স্বতন্ত্রসহ অন্যান্য দলের প্রার্থীরা। প্রথম ধাপে ২০৪ ইউনিয়ন পরিষদে নির্বাচনের ১৪৮টিতেই আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী নৌকা প্রতীক নিয়ে জয়লাভ করেছেন। অন্যদিকে স্বতন্ত্র থেকে ৪৯ জন এবং তিনটি বিরোধী রাজনৈতিক দল থেকে বাকি ৭ জন প্রার্থী চেয়ারম্যান পদে জয়লাভ করেন।
ইসির হিসাব বলছে, প্রথম ধাপে ২৪ শতাংশ ও দ্বিতীয় ধাপে ৪০ শতাংশ চেয়ারম্যান পদে স্বতন্ত্রপ্রার্থী জয়ী হয়েছিলেন। তৃতীয় ধাপে গিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জয়ের হার বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৪৫ শতাংশে। আর চতুর্থ ধাপে তারা জয় পান ৪৯ শতাংশ ইউপিতে। পঞ্চম ধাপে এসে স্বতন্ত্র প্রার্থীরাই ৫০ শতাংশ ইউনিয়নে জয় পেয়েছেন। তবে সে কয়টি এলাকায় নৌকার প্রার্থীরা ভালো করেছেন তার মধ্যে ঢাকা-১ আসন দোহার নবাবগঞ্জ অন্যতম। এ আসনের এমপি প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের রাজনৈতিক দূরদর্শিতায় দোহার ও নবাবগঞ্জ দুই উপজেলার ১৯টি ইউনিয়নের সবকটি’তে চেয়ারম্যান পদে নৌকার প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছেন।
দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের জানান, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের হাইব্রিডদের পরাজয় ঘটেছে। নৌকা প্রতীক নিয়েও আওয়ামী লীগে উড়ে এসে জুড়ে বসারা ইউপি ভোটে সুবিধা করতে পারেননি। জিতেছেন তৃণমূলের সঙ্গে সম্পৃক্ত রাজনীতিবিদরা। দলের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী হওয়ায় স্থানীয়ভাবে বহিষ্কার করা হয়েছে। ‘বহিষ্কৃত’ এই নেতাদের এবারও ‘ক্ষমা’ করার চিন্তা করছে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ। ‘শর্ত সাপেক্ষে’ তাদের ক্ষমা করা হলেও দিতে হবে মাশুল। বিগত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের মতো বহিষ্কৃত বিদ্রোহীদের আবেদন করতে হবে কেন্দ্রে। দলের সিদ্ধান্ত অমান্যকারীরা সাধারণ ক্ষমা পেলেও ফিরতে পারবেন না দলের আগের পদে।
এ জন্য অভ্যন্তরীণ কোন্দল নিরসন মিটিয়ে ফেলার পাশাপাশি ইউপি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বহিষ্কার ও যে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে, সেগুলো মিটিয়ে ফেলার পরিকল্পনা করছে আওয়ামী লীগ। এ জন্য ইউপি নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থীদের সাধারণ ক্ষমা করা হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের আরেক প্রেসিডিয়াম সদস্য আবদুর রহমান বলেন, ‘বিদ্রোহীদের নিয়ে মন্তব্য করার সময় এখনো আসেনি। ইউপি নির্বাচনে বৃহৎ একটি অংশ বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন। স্থানীয়ভাবে তাদের বহিষ্কারও করা হয়েছে। আমাদের দলের সভানেত্রীর সিদ্ধান্ত, যারা বিদ্রোহী প্রার্থী হবেন তারা কখনো নৌকা প্রতীক পাবেন না। এ নির্দেশনা এখনো বহাল আছে।
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম বলেন, যারা প্রার্থী হয়েছিলেন তাদের হয়তো বিগত উপজেলা নির্বাচনের মতো সাধারণ ক্ষমা করা হতে পারে। তবে এটা কিন্তু এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি। প্রার্থীরা সাধারণ ক্ষমা পেলেও দলীয় পদ-পদবিতে ফিরতে পারবেন না। আবার ভবিষ্যতেও কোনো নির্বাচনে তারা নৌকা পাবেন না।
এছাড়া ইউপি নির্বাচনের বিভেদ আগামী জাতীয় নির্বাচনে পড়বে কী না এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা সব সময় জাতীয় নির্বাচনের আগে ও শেষ মুহূর্তে ঘুরে দাঁড়ায়, ঐক্যবদ্ধ হয়, গুরুত্ব অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে কখনো ভুল করে না। এবারের যে স্থানীয় সরকারের নির্বাচন হয়েছে আসলে সেখানে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী কেউ ছিলেন না। অন্য কোনো দলের অংশগ্রহণ ছিল না। সে কারণে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে অংশগ্রহণ মূলক নির্বাচন চাওয়া হয়। এই নির্বাচনে জনগণ অংশগ্রহণ করেছে, যা আমরা সব চাইতে গুরুত্ব দিয়েছি। আবার দলের প্রার্থীর বাহিরেও নেতাকর্মীরা বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে দাঁড়িয়েছিল, সেটাতেও আমাদের কঠোর অবস্থান ছিল, শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও নেয়া হয়। সব মিলিয়ে ভালো-মন্দ বিবেচনা করেই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই দেশের জন্য, দলের জন্য এবং গণতন্ত্রের জন্য যেটা ভালো সেই বিষয়টি বিবেচনা নিয়েই সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন